মহা আশঙ্কা জপিছে মৌন মন্তরে
মৌনতার
ঠিক উলটো দিকে প্রণয় কি ঝলমলে আলো নিয়ে এসে হাজির করছে আজ?
এই
অসামান্য বঙ্গকোলাহল ধূসরতর পাণ্ডিত্যের চূর্ণ অবয়বে প্রতিনিয়তের যাপনে স্পর্শ দিচ্ছে অন্য একটা প্রণয়ের।ক্রমশ সচেতনশীল, মুক্তিকামী আত্মা, শরীরকে আরও আতঙ্কের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। পুংদণ্ড প্রসূত এই হাওয়া বারবার ছিঁড়ে দিচ্ছে মানুষের চেতনার ফুলসম ছবিগুলোকে, অপার সুগন্ধ-কে ছাই এর অবশেষ করে তুলতে চাইছে,আর এসব নিয়েই ঘুরে চলেছে আধাখেঁচড়া আধুনিক থেকে হাঁসজারু উত্তরাধুনিকের মোড়। শিল্প সাহিত্য ততোই ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে এই আত্মহননকারীর মুখোমুখি।
'আত্মহননব্রতী কবিতারা আমার' - ' প্রণয় সমুদ্রপায় ' নামক দুফর্মার কবিতার বই তে কবি চৈতালী চট্টোপাধ্যায়-এর এই উক্তি শুধুই স্বীকারোক্তি নয়। সভ্যতা যে প্রণয়কে চিনতে শেখাচ্ছে, ২০০ বছরেরও বেশি সময়ের আধুনিকতা, ঔপনিবেশিকতার কালো ছায়া যে প্রণয়কে ঢেলে দিয়েছে এ সভ্যতায়, কবির গায় সেই সমুদ্রপ্রায় বাতাস যেন আছড়ে পড়ছে। আর এই ইতিহাস চেতনা প্রসূত মানবিক চেতনার অসম্ভব বিষাদ গুলো ইতিহাসযানে চেপে হাজির হয়েছে এই ৩২ পাতার ছোট্ট বইতে।আর তাই, একটা আকস্মিক বোধ কীভাবে যেন স্বীকারোক্তি এবং তা থেকে ক্রমশ এক বিদ্রূপ-প্রতিবাদ মিশ্রিত বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে। যেমন
'একটা ছোট
উজ্জ্বলতা আঁকড়ে
ছিলে, সেই সকালে।
মূলত, নিন্দনীয়।
নিন্দে কেন?
দেখছ না
কি,
পরিবেশের আঁচড়ালে
গা
রক্ত ঝরে!
মুঠোর মধ্যে
মান-সম্মান লুকিয়ে
নিয়ে পালাচ্ছে
ঘর
আমিও আছি
এই প্রবাহে,
বিষণ্ণ আর
কালো জলের
ময়লা হয়ে।
'
নারীর
চেতনা থেকে উঠে আসা স্বাভাবিক মোক্ষণ গুলি যেমন ধরা আছে এই বইতে...তেমনই, পুরুষতান্ত্রিক জট ছাড়াতে ছাড়াতে শিকার হওয়া নানান বাতাস ঘোরাফেরা করছে তার সামগ্রিক ভাবনার ভিতরে।
'অপমান পথ করে দেবে রমণীকে' অথবা
'বিরহীণী মাথা পেতে নেবে' কিংবা
'তখন,
আমিও তৃষ্ণা মেটাব, বস্তুত/ পরদিন আবার শুকনো হব' ইত্যাদি টুকরো লাইন গুলো একেকটি বিচ্ছিন্ন কবিতার বিষয় হলেও, যেন সেই সুর বয়ে বেড়াচ্ছে অগোচরে। যাকে ছুঁতে চাইলেও ছুঁতে পারার যো নেই, বিষণ্ণ হতে হয়, , যতোই এই স্বর স্পষ্ট হয়ে ওঠে ততোই আমার সামনে প্রতিদিন ঘটে যাওয়া কালো ধূসর জায়গা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কবিতা আক্রান্ত করে বারবার
অসহায়
করে তোলে।
আর
এখানেই লুকিয়ে থাকে কবির অভিপ্রায়। শুধুই আচ্ছন্ন ক্লেদ গুলো যে বিচ্ছিন্নতা জন্ম দিচ্ছে তা নয়, স্বাভাবিক প্রণয়ের মধ্যে ঢুকে পড়েও কবি চৈতালী চট্টোপাধ্যায় তৈরি করছেন এক বিচ্ছিন্নতা বোধ। বসন্তের কালো গায়ে মেখে কবি যেন বসন্তকেই 'অলৌকিক' বলে দাবী করছেন। ৩২ পাতার ছোট্ট বইটির সবচেয়ে আক্রান্তকারী কবিতা হলো এইটিই, নাম 'বোধহয়,অলৌকিক কবিতা'।
"আকাশ, নক্ষত্রমুখি ভেসে যায়।
সঙ্গে, মেঘ চলে।
তুমি তো
নক্ষত্র হয়ে
শুয়ে আছ।
আমি,
বৃষ্টি।
ওখানে ঝরে
পড়ব,
আর,
দেখাসাক্ষাৎ হবে
আমাদের।
হাসিকান্না হবে।
তারপর, মৃত আলো
সহস্র আলোকবর্ষ
পার করে
এ-দেশে পৌঁছলে
একদিন,
বিরহিণী মাথা
পেতে নেবে
"
উদ্ভ্রান্ত
শীতের বসন্তকালীন টানকে যেমন আমাদের অবচেতনা এড়িয়ে যেতে পারে না, স্বাভাবিক ভাবে কবি মনও ঢুকে পড়ে সেই প্রেমের অন্দরে-বাহিরে, কিন্তু কবি চৈতালী চট্টোপাধ্যায়ের এই অবিচেতন মন-ই হয়তো তাকে এই অলৌকিক প্রেম থেকে সচেতন পরিবিশের দিকে যাত্রা রেখে যেতে চান। তাই 'পরিবেশ' কবিতায় তিনি বলছেন
"
ঘটেছে যা,
ঘটে গেছে!
বিষজলে ঢেই
নাচছে, প্রেতিনীপ্রমাণ!
চলে যাব,
উড়ে যাব,
আর, তার আগে,
সবুজ ছড়িয়ে
দেব
তোমাদের চাঁদের
শহরে "
তাই তাঁর পরিবেশ কখনোই শাদা হতে পারে না, অথবা অসম্ভব কালোর ভিতরে টেনে তুলতে চান শাদা পায়রার
মৃত অবয়ব গুলিকে, হাসতে
হাসতে রামধনুর মতন ফুটে ওঠে এই লাইন গুলো।
“কষে প্রতিবাদ করি,
আর, যুদ্ধ যুদ্ধের মনে নরমাংস খায়। “
কিংবা
“লেন, বাইলেন ভুলে গেছি
বলে
রহস্য দূরে সরে যায়।
নিশিকুকুরেরা গায়ে কামড় দিতেও ভুলে যায়। “
এখন তরুণ পাঠক হিসাবে আমার প্রত্যেকদিনের যাপন আমি মিলিয়ে নিতে
পারি এই তরঙ্গে ।বিশুদ্ধ চেতনার
খোঁজে কী অলৌকিক আর কী বিজ্ঞানসম্মত তাও যেমন মূর্ত হয়ে ওঠে, তেমনি এই বোধ আত্মস্থকরণ করতে
গিয়ে দৈনিক মুখোমুখি হই মানুষের বানানো এক কুহরের। তাই ‘আধখানা ঘুমিয়ে, আধখানা
জেগে' কবিতা
গুলি মূর্ত হয়ে ওঠে আমার বোধের ভিতরে।
হিরণ মিত্র'র নীল-সাদা প্রচ্ছদ বিশেষ প্রশংসার দাবী রাখে, এবং অবশ্যই প্রকাশক
‘কাগজের ঠোঙা'কে
অশেষ ধন্যবাদ, এরকম
একটা বইকে আমাদের উপহার দেবার জন্য।
প্রণয়,সমুদ্রপ্রায়
– চৈতালী চট্টোপাধ্যায়
প্রকাশকাল- ২০১৮
প্রকাশক- কাগজের ঠোঙা
প্রচ্ছদ – হিরণ মিত্র
দাম – ৪০ টাকা