Sunday 18 March 2018

বোধিসত্ত্ব ভট্টাচার্য

উইন্ডস্ক্রিন






একটি লোকের    ঘুম:-

সব দোষ সব আক্ষেপই যেন মেঘের ভিতর থেকে নেমে আসা এই সন্ধেটার, এমন নিঃসঙ্গ, নিশ্চুপ, নির্ভার আর ছায়াচ্ছন্ন হয়ে উঠল পৃথিবীটা আচমকা। জানালা দিয়ে খোলা মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে লোকটির চোখে ঝিমুনি নামতে শুরু করে দিল গলগল করে। সন্ধ্যার খুবলে খুবলে যাওয়া ছায়াগুলো অত্যাশ্চর্য এবং অস্বাভাবিক ফ্যাটফ্যাটে রঙের এক বিকট ফণা তুলে আঁধার হওয়ার ঠিক আগে আগেই ওই জানলার সামনেই একটা কালো ভূতুড়ে মুখ দেখে ধড়াস করে উঠল সে। মুখটিই কেবল রয়েছে। কোনও ধড় নেই। ধড়ের শূন্যতার মধ্যে দিয়ে ভুরভুর করে বয়ে যাচ্ছে তুলসীতলায় ধুনো দেওয়া বাতাস। সেই বাতাসে চোখটি কেমন বুজে আসে। লোকটি চোখ টকটকে লাল। বহুদিন ধরেই ঘুম হয় না তার ঠিকঠাক। ডাক্তার বলে দিয়েছে, ইনসমনিয়া। এত সহজে আসবে না আর ঘুম। বাড়িটিতে একা থাকে এই লোকটি। ঘুম পায় বড্ড। কিন্তু, তা স্থায়ী হয় না কখনও। একটু হয়তো চোখটা বুজে এল, হঠাৎ কানের কাছে বেজে উঠল- মাউথঅর্গ্যান। তার মোবাইলের রিংটোন। ফোনটি বাজেনি আসলে। কিন্তু, তার মনে হল, সেটি যেন বেজে উঠল। ফোনের এই রিংটোনটি তার কাছে অ্যালার্মের মতো। তন্দ্রা এলেই তার কানের কাছে সেটির শ্লেষ্মামিশ্রিত সুরেলা ঘড়ঘড়টি জেগে ওঠে। ফোন বন্ধ থাকলেও এই আওয়াজটি তার কানে চলতেই থাকে ঘুমের মুহুর্তগুলোয়। ছোটোবেলার মাটির বাড়ির দাওয়ায় বসে থাকা মায়ের কোলে শুয়ে শুয়ে কাগের ডিম বগের ডিম করে ভাত খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়ার দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ে…
খোলা জানলার বাইরে কালো ভূতুড়ে মুখটা সরে গিয়েছে। লোকটি জানে, ওটিই তার ঘুম। প্রতি সন্ধেতেই সেটি তার জানলার সামনে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু, ঘরের ভিতরে ঢুকতে পারে না কখনও…
ঘুমটি চলে যেতে থাকে সন্ধের রাস্তা ধরে। জানলার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি শুনতে পায় বাতাসের মধ্যে তিনবার বেজে ওঠা ‘যায় ঘুম, যায় ঘুম, যায় ঘুম’ ধ্বনি…


চড়াইপাখির ঘুম:- 

শহরের শেষ চড়াইটি সবে জন্মানো সন্ধের হাওয়ায় ঘুরতে থাকে,
উড়তে থাকে একা। চড়াইয়ের চোখ কখনও কেউ দেখেনি। দেখলেও মনে রাখতে
পারেনি। এত ছোট, এত অকিঞ্চিত, এত নির্গুণ...এত নির্ঘুম। শহরের মানুষ
নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তা, স্বাভাবিক। তবে, কাজ একবার থামিয়ে
চড়াইটিকে ভালো করে লক্ষ করার একটু চেষ্টা করলে বুঝতে পারত, তার চোখের
জায়গায় আর চোখটা নেই। যা আছে, তা আদতে রক্তের ড্যালা। গায়ে লেগে থাকা
ছোট ছোট পালকগুলো ক্রমে ঝরে পড়ে চড়াইটিকে একদম শকুন বানিয়ে দিয়েছে।
রাতের পর রাত না ঘুম হওয়ার  ফলে তার এই দশা। তাকে মাঝে মাঝে দেখা যায়
শহরের সন্ধে কিংবা মাঝরাতের হাওয়ায়। কখনও অতি আলো বা অতি শব্দের চোটে
সে আবছা হয়ে যায় বেমালুম। এই শহরের কাছে আর কোনও অন্ধকার নেই আর। আলোর
হৈ-হল্লার ভিতর চাপা পড়ে গিয়ে তা অন্তিম মুহূর্ত ঘনিয়ে আসা পশুর মতো
কেঁপে কেঁপে ওঠে।
এটি হল সেই অন্ধকার, যার গভীরে লুকিয়ে আছে চড়াইয়ের ঘুমের বাড়িটি। শহর
হারিয়ে ফেলেছে তার অন্ধকারকে। চড়াই হারিয়ে ফেলেছে তার ঘুমটুকু। আলো
দেখা সত্ত্বেও চোখ বোজার কৌশল প্রকৃতি তাদের জানায়নি...

দাদুর কাছে শুনেছিল, আগে মানুষ এত নির্মম ছিল না। বাড়িতে থাকলে এগারোটার
মধ্যে শুয়ে পড়ত। শহরের অনেক রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টই ছিল না। যে সব
জায়গায় ছিল, তার মধ্যেও  কোথাও কোথাও সম্ভবত পাখিদের ঘুমের কথা ভেবেই
ল্যাম্পপোস্ট থেকে আলো খুলে নিয়ে চলে যেত কোনও নিদ্রাবিলাসী চোর।
লোকে অন্ধকারে দাঁড়িয়েই করে ফেলত কত অমোঘ-গোপন।
এখন হয়ে গিয়েছে তার উলটো।
দাদু বলেছিল, বহু কিছুর সঙ্গে যখন একসঙ্গে বসবাস করতে হয়, তাকে বলে
পৃথিবী। ক্রমশ বাড়তে থাকা মোবাইলের টাওয়ারের জন্য দাদু,বাবা, মা-সহ
সহস্রাধিক চড়াই পেয়েছে হেঁজিপেঁজি মৃত্যু। পাখিদের সৎকারের কোনও
ব্যবস্থা নেই। তাই মরে গেলে রাস্তায় পড়ে থাকতে হয় একা। লোকে মারিয়ে
চলে যায়।
এমন বাড়িও নেই তেমন এখন, যেখানে বড়ো ঘুলঘুলি রয়েছে।
থাকলেও সকালে সেখানে মেগা-সিরিয়াল চলছে। দুপুরে মেগা-সিরিয়াল চলছে।
রাতেও মেগা-সিরিয়ালই চলছে। আগে রাতে মানুষ ঘুমোত। এখন তো তাও নয়। তার
ওপর মোবাইল। নাক খুঁটতে গেলেও এদের মোবাইল লাগে। কারও ঘরে গিয়ে বাসা
বাঁধতে চাইলেও একই ব্যাপার।  সারারাত হয় মোবাইলের আলো অথবা কমপিউটারের
আলো...
এই সমস্যা কাকেরও। এই একই সমস্যা ঘুঘুরও। এই একই সমস্যা আর সব পাখিরই।
সূর্য ডুবলেই রাস্তা থেকে আলো এসে সটান পড়ে তাদের বাসায়। যতবারই আলো
এসে পড়ে, মনে হয়, সূর্যটা বোধহয় পুরোপুরি ডুবল না। বাসা থেকে বেরিয়ে
আবার তখন উড়তে শুরু করে কেউ কেউ।
ক্লান্ত তখন তারা। চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে। তবু উড়তেই হয়। শহরের
মানুষ আর আকাশ দেখে না। দেখলে বুঝত, কত  পাখি কত  সন্ধেবেলায় উড়ে চলে
গেল তাদের মাথার উপর দিয়ে সংক্রান্তির দিকে...


প্রত্যেকদিন খুঁটে খুঁটে যা খায় চড়াইটি, তা এই ঘুমহীনতার জন্য আর হজম
হয় না। মলত্যাগ করে দেয় চড়াইটি তখন, শহরের সমস্ত আলোর উপর। যে দিন
যে'কটা আলো পারে...সন্ধের হাওয়ায় শহরের আলোগুলোর উপর মলত্যাগ করতে করতে
উড়তে থাকে চড়াইটি। সময়ের কোন অদৃশ্য কোণ থেকে এই শহরে তখন হিসাবের বাইরের এক রাত নেমে আসছে...


সোনার ডিম:-

ঘরের জানলার সামনে পাঁচিল। তারপর একটা ছোটো ফাঁকা মাঠ। এই মাঠে একটি বহু পুরনো বিদেশি মডেলের গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে সবসময়। গাড়ির মালিক অনেক বছর আগে গাড়িটাকে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল এখানে। আর ফিরে আসেনি। সৃজনশীল ও সমকালীন ধুলো গাড়ির শরীরে চাক হয়ে বসে রয়েছে অনন্তকাল ধরে। জীবনের অর্ধেকের বেশি খরচ করে ফেলা মানুষ দাঁত মাজতে মাজতে বছরের পর বছর ধরে লক্ষ করে গিয়েছে, তাদের স্মৃতি কেমন নৈতিকতার অপরপ্রান্তের মতো দাঁড়িয়ে আছে জবুথবু হয়ে আজ্ঞাবাহী রোদের তলায় কিংবা গন্ধমদির অন্ধকারের পকেটে। 
এখানেই এসে দাঁড়িয়েছিল ওরা দুজন। যার ঘরের জানালার সামনের মাঠ, সে এবং আরো একটি অল্পবয়সী ছেলে। দ্বিতীয়জন একটি গ্যারাজে কাজ করে। রোগা ফরসা চেহারা। চুল পেতে আঁচড়ানো। অর্ধেকটা আলো, অর্ধেকটা অন্ধকার তখন। ঝুমুর গান কেটে যাওয়ার পর ‘চাবুক মারো, চাবুক মারো’- ধরনের হাওয়া দিয়েছে কারও কারও উঠোনে। সেই হাওয়ায় ভোর লেগে আছে। প্রথমজনের মাথাটি গোল আর ছোট্ট। কিন্তু শরীরটা তার লম্বা। কাঠামোতে অল্প হাড় আছে। খানিকটা গোস্তও আছে। মাঠটার পাশেই একটি ছোট ডোবা। সেই ডোবার সর-জমা জলের উপর জড়িয়ে গিয়েছে অপরিজ্ঞাত আলো-অন্ধকার। তারা দুজন ওই জলে মুখটা ধোয়। কোথাও যাওয়ার নেই। তবু মুখটা ধুয়ে নেয়। এই অলৌকিক সময়ে কেউ যদি জেগে ওঠে, অনিবার্যভাবেই তার মনে পড়বে একটি ছায়াপথের কথা অথবা প্যালিওলিথিক যুগ থেকে গড়িয়ে আসা একটি পাথুরে রাস্তার কথা অথবা অন্য কোনও ক্ল্যাসিক বিবর্তনের কথা। আর ওদের দুজনকে দেখলে তার মনে পড়ত ঈশ্বরের কথা...ওরা দুজনে গাড়িটার দিকে এগোয়। দ্বিতীয়জন একটু বেশি সাহসী। সে আগে যায়। গাড়িটার ভিতরে সোনার ডিম আছে... বহুদিন ধরে গাড়িটি এই মাটিতে থাকতে থাকতে কিছু মিথের জন্ম দিয়েছে। অথবা, কিছু সত্যির। সত্যির ভিতর ভৌতিক সত্যিরা পচেগলে ঢুকে গিয়েই তো মিথের জন্ম দেয়...ওরা ছুরি শাবল ছেনি বাটালি নিয়ে সেটি খুঁজতেই এসেছে...দ্বিতীয়জন শাবলের চাপ দিয়ে বনেটটা খোলার চেষ্টা করতে লাগল। প্রথমজন তখন গাড়ির জংধরা দরজার গায়ে ফেকলু হয়ে লেগে থাকা ধুলো হাতে মেখে নিচ্ছিল। একসময় বেশ জোরে শব্দ করে বনেটটা খুলে গেল। শব্দটা মাঠ পেরিয়ে ডোবা পেরিয়ে আকাশে চলে গেল। বনেটের কলকবজার ভিতর মাথা ঢুকিয়ে ডিমের খোঁজ শুরু করে দুজন। অনেকদিন ধরেই শুনে এসেছে ব্রিটিশ আমলের সোনার ডিম লুকিয়ে রাখা হয়েছে এখানে। খোঁজার শুরুর দিকে দুজনের মাথায় মাথায় ঠোকা লেগে যাচ্ছিল। এখন সব শান্ত। কলকবজাগুলো একটু ঠোকা খেয়েই রক্তারক্তি শব্দ করে ভেঙে পড়ল। ওদের মাথা অন্ধকারের একদম ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে ক্রমশ। এই অন্ধকার গর্ভ থেকেই কোনও একসময় জন্ম হয়েছিল পৃথিবীর। জন্ম হয়েছিল দুজন মানুষের। একটি ডিমের খোঁজে যে গর্ভ থেকে এসেছিল সেই গর্ভেই আবার ফিরে যাচ্ছে তারা। মাথাটি আর কখনওই বের করা যাবে না সম্ভবত। অন্ধকারে আরো ডুবে যেতে থাকে দুটো শরীর। ভোরের আলো ধীরে এসে পড়ছে তাদের নিতম্বে। দম আটকে আসে। দুজনেরই দম আটকে আসে। অক্সিজেন-নি:স সময়টির ভিতর ক্রমে তলিয়ে যেতে যেতে একজন ভাবছিল তার লোভের কথা। আরেকজন ভাবছিল তার চাকরি চলে যাওয়ার কথা...

No comments:

Post a Comment