Friday 16 March 2018

রঞ্জন মৈত্র


ঢেউচিঠি ও একজন পোস্টম্যান

                                       



দ্বিতীয় জীবনের তীব্র আকাঙ্খা নিয়ে একজন মানুষ তার চলতি জীবনের পথ গলি সড়কগুলো পার হয় ক্রমাগত। যখন চিন্তায় মননে দ্বিতীয় জীবনের নির্মান চলতেই থাকে। যার অনুষঙ্গগুলিকে সে স্পষ্ট করে চেনে কি চেনে না। কেবল নানা ভ্রমণে, নানা সুন্দর ও অসুন্দরে নিজেকে বসিয়ে মুগ্ধ হয়, বিষণ্ণ হয়। নিজের রূপান্তর নিজেই বিস্ময়ে উপভোগ করে। মনে রাখে, ভুলে যায়। ফটো তোলে আর অ্যালবামটি  বেভুল হয়ে যায় একদিন। প্রথম জীবনের লক্ষ্য উপলক্ষ্যে ভেসে যাওয়া মানুষ কোন একদিন ঘরসাফাইয়ে মেতে হঠাৎ খুঁজে পায় সেই অ্যালবাম। আর তার চিরনির্মীয়মান দ্বিতীয় জীবনের অনুষঙ্গগুলি হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে তার উপর। আনন্দ-বেদনায় হাসি-দীর্ঘশ্বাসে সে বস্তুতই জড়িয়ে ধরতে চায় সেইসব সুর ও কোলাহল, সূর্যাস্ত ও মোমবাতি, তরাই ও বরফ, জমানো উল আর আলোড়িত শিশুদের। মাত্র একটি হলুদ তোয়ালে, ডাকনাম হয়ে ওঠে অপরিসীম সমুদ্রের। একজন সৃষ্টিশীল কবি আরও তীব্র ও তীক্ষ্ণভাবে স্পর্শ পায় এইসব অনুভবের। সে প্রত্যক্ষত আরেকটি অধ্যায় নির্মান করতে চায় দ্বিতীয় জীবনের। “সৃষ্টিসুখ” প্রকাশিত কবি সৌমনা দাশগুপ্তর “ঢেউ এবং সংকেত” কাব্যগ্রন্থটি পড়তে পড়তে এইসব কথা মনে হল।

মিথ এক মহার্ঘ পোষ্য। যেমন, কবি মানেই ঋষি। এবং সেইমতো কার্যক্রম। যত মহৎ বাক্য স্তোত্র, যত দর্শন এবং বিবেকবাণী, যত গনৎকারী এবং তদ্ভব ভবিষ্য, যত তথাকথিত অসুন্দরের জন্য ধিক্কার এবং দিকদর্শন, এই সব দিয়ে নির্মিত এক স্থানু প্রতিমা। যেন সে-ই। যেন সেই-ই কবি। নিশ্চিত। এবং সেইমতো হুলিয়া সাকিন এবং খেতিবাড়ি। অথচ রাজদ্বার থেকে শ্মশান পর্যন্ত প্রথমত একজন সাধারণ মানুষ যে এক বহমান ট্রেকরুটের সন্ধান পেয়েছে, স্পর্শ পেয়েছে ব্যাকরণ পেরোনো অনন্তের, নিরলস অভিযাত্রী যে ভাবনাপথের, শব্দ যার সুদ-উদ্রেককারী সঞ্চয় নয় বরং অভিজ্ঞান, শব্দের আঁশ ও উপল সবই ওই অভিজ্ঞা্‌ন, সেই কবিকে টের পেতে কবিরই বেলা যায়। কিন্তু যে টের পায়, তার নীরবতা ও খোলা গলার গান, স্তিতি ও ভ্রমণ, সন্তুলন এবং হযবরল, সবই হয়ে ওঠে আপাত জটিল এবং তীক্ষ্ণ অনুভবী এক নির্মানের মালমশলা। নক্ষত্র আর বরফ, পাখি ও অঙ্গার, সবই নির্মিত। এই রহস্যে মোড়া এবং তীব্র আকর্ষণ তাকে প্রথম জীবনের সম্পর্কময় পুনরাবৃত্তি থেকে টেনে নিতে চায় কোন এক জ্যোৎস্নায়, স্বাধীনতায়, সামুহিক রহস্যে। কবি নিজের জন্যই প্রশ্ন তৈরি করে। “চলো জ্যোৎস্নায় ফিরি। কিছুটা স্নান আমার এই মুহূর্তেই প্রয়োজন। আমি কি ঝরনার কাছে যাব? আমি কি বিজ্ঞাপনের দিকে যাব?” নিজেই উত্তর খোঁজে আর আবিষ্কার করে, “মাঝেমধ্যে পাখিদের সঙ্গে দেখা হওয়া ভালো। পাখিদের সঙ্গে দেখা হলে বরফ ফেটে যায়। তখন আয়নার সামনে তুমি সম্পূর্ন নিজেকে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে পারো” সে টের পায় “জলের স্বপ্নে তুমি ক্রমেই নদীর কাছাকাছি পৌঁছে যাবে।“ এই জল, এই নদীর সঙ্গে প্রথম জীবনের অর্থে সমার্থে পাওয়া জল ও নদীর কোন সংলগ্নতা নেই, একথা কবি জানে। আমরা পাঠকেরা তার স্পর্শ পাই। আমাদেরও কবিতাভ্রমণ শুরু হয়।

এবার সেই ভ্রমণের প্রাপ্তি হিসেবে পাঠক আমি কিছু উদ্ধৃতিতে যাব যা অচেনা মীড় হয়ে ঘুরছে মাথায় –
“আজ সারাদিন জলের কলের ভেতর হাওয়া ঢুকে গেছে। এসব পেরিয়ে যাও দেখবে সমুদ্র একটা আখাম্বা জাহাজ নিয়ে বসে আছে তোমার জন্য”

                                                                
“ট্রেন নেমে যাচ্ছে আলপথে। ধান ভিজে যাচ্ছে। আর আমার কলম শুকিয়ে উঠছে বারবার। আজ আমরা খালি গলাতেই গান গাইব”
“তাহলে কি আগুনও পৌঁছে যাচ্ছে শেষ দিনে? উত্তর আসে না। শুধু হলুদ হয়ে হয়ে ওঠে শেড ট্রি। তাহলে কি আর চিঠি আসবে না? উত্তর আসে না। তারারা বাড়ি চলে গেলে আর ডাকঘর থাকে না। তারারা বাড়ি চলে গেলে মেঘের অসুখ হয়”
“নীল পুলোভারে তোমাকে গাছ বলে মনে হয়। অনেক সালোকসংশ্লেষের গল্প”
“তুমি হরিণ কুড়িয়ে আনছ, আর ধীরে ধীরে তোমার ভেতর জন্ম নিচ্ছে দৌড়”
“একটু লবণ দিলে দেখবে বাড়ি কেমন ঝলমল করে উঠছে। আর লেবু লংকা হলে তো আর কথাই নেই, বাড়ি তখন সম্পূর্ন একটা চড়ুইভাতি”

সৌমনা দাশগুপ্তর এই কবিতার বইটি পড়তে পড়তে, পাঠক আমার, যা মনে হল তা হল একটিমাত্র মানসিক স্থিতি, খুশি এবং দীর্ঘশ্বাস, হারিয়ে ফেলার বিষণ্ণতা এবং পেতে চাওয়ায় পৌঁছতে চাওয়ার স্বপ্ন ও উদ্বেগ, এই একটিমাত্র ভাবনাস্তরকে নানা দিক দিয়ে খুঁড়ে দেখা ছুঁয়ে দেখা, আবিষ্কার করা, তার প্রাপ্তি ও সম্ভাবনাই এই গোটা বইটার চালিকাশক্তি। কিন্তু উচ্চারণ এবং উপস্থাপনার আলাদাত্ব দিয়ে প্রথম কুড়ি পৃষ্ঠা এবং পরবর্তী চুয়াল্লিশ পৃষ্ঠার বেশিটাকেই একটু অন্য করতে চাওয়া হয়েছে। এই অংশটি আরও সংক্ষিপ্ত, আরও তীক্ষ্ণ এবং তীব্র মরমী। তোমরা কি প্রস্তুত, যেন এই প্রশ্নও উড়ে বেড়ায় বাতাসে। এবং আশ্চর্য যে, যেসব অনুভব এবং হঠাৎ-পাওয়া ঝলক ও ভাবনাসূত্র থেকে “চাঁদের শিফন ছিড়ে” অংশের নির্মান, সেই একই সব সূত্রের ছায়া-অভিযান এবং সেই অভিজ্ঞতার বিমূর্ত প্রক্ষেপ, পরবর্তী অংশে রেখেছেন সৌমনা। “ছুরি” কবিতাটা পুরোটাই তুলে ধরা যাক-
“ঘুমের ভেতর ওষুধ ঢুকে গেছে                                                           
ঘুমের ভেতর একটা ছুরি
ঢুকছে বেরোচ্ছে
রক্ত পড়ছে না

শেষ ঠিকানা মিসিংলিঙ্ক হয়ে
ঝুলে আছে আমাদের উঠোনে
টোম্যাটোর খেত
শেষবার রক্তপাত

ভিজে যাচ্ছে সমস্ত পতাকা”

                                                                                                                                                                                                         
ঘুম থেকে পতাকা পর্যন্ত একটা হারানো ঠিকানা ছুরির মতো ঢুকছে বেরোচ্ছে যখন, রক্ত পড়ছে কি পড়ছে না, এক অসীম উঠোন হয়ে উঠছে রক্তরঙা টোম্যাটোরঙা খেত। এই উঠোন কবির নির্মান। ওষুধমাপা ঘুম থেকে উজাগর পতাকার ভেজাপথ কবির নির্মান। এই পরবর্তী চুয়াল্লিশ পাতার অংশে বারবার মনে পড়ে সেই ম্যাজিক কলমকে যার জাগতিক নাম শ্যামল সিংহ। এই মরপৃথিবী তাঁকে বেশিদিন ধরে রাখতে পারেনি। আপশোস। আর আনন্দ এই যে, তাঁর কবিতার ওই অত্যাশ্চর্য বিমূর্ত জগৎ, কম্পোজিশনের ধরন, শুধু সংকেত আর ইশারা দিয়ে ভাবনার বিগঠন এবং গঠন, এই অপরূপ বাতাসটি বহতা হয়ে রইল কতজনের কবিতায়! আনন্দ আরও যে, তাঁরা কেউ শ্যামলের অনুকারক নন। শ্যামল সিংহ-র অনুকরণ সম্ভব নয়। সদ্য হারিয়ে ফেলা প্রিয় বারীনদাকে মনে পড়ে। যা ঘটে গেছে তা অবাস্তব হয়ে গেছে, যা সম্ভাবনায় রয়েছে তা-ই বাস্তব। পাঠক আমি টের পাই, সমস্তরকম জীবনময়তার খরগোশটি বারেবারে নতুনতর নির্মানে, চেতনায়, রূপে ফেরত আসবে বলে সাদা খাতা হয়ে অপেক্ষা করে একজন কবির জীবন। মনোরম প্রিন্সেপ ঘাট ও একলা পোস্টম্যানের জন্য অপেক্ষা করে। যখন আলো স্তিম হয়ে এল, তারারা মৃতপ্রায় তখনও। “খরগোশ” আর “তারাদের মৃত্যু হলে” – এই কাব্যগ্রন্থের দুটি আশ্চর্য লেখা। যারা একাধিক পাঠে নতুন নতুন রূপে ধরা দিতে পারে যোগ্য পাঠকের চেতনায়।

হে মহাকবিগন, যাঁরা মাঝে মাঝেই, কবিতার জন্য এখন এক অন্ধকার সময়, নরককুন্ড, মাজরায় খাওয়া ধানখেত ইত্যাদি কান্নাকাটি শাপশাপান্ত করছেন, মার্জনা করবেন, আমি সহমত নই আপনাদের সঙ্গে। আর আনন্দ হয় কবিতার এক সত্যিকার নির্মাণমুখর সময়ে বেঁচে আছি বলে। “দাও প্রাণ” কবিতার ৬নং টুকরোটি পড়ি একটু
“এক লাইন ঠোঁট লিখতে লিখতে দু লাইন শরীর
লেখা হল। শরীরের ভেতর যে মেঘ গর্জন করে
উঠল তাকেও লিখলাম। মাঝরাতের হাইওয়েতে
একলা ট্যাক্সি লিখতে লিখতে ঢুকে গেছি ধানের
ভেতরে। তুলে ধরেছি মুখ, চুম্বন নেবে না”

আর কথা নয়। আহা ব’লে চুপ করে যাই এবার
   

ঢেউ এবং সংকেত/ সৌমনা দাশগুপ্ত/ সৃষ্টিসুখ প্রকাশন


No comments:

Post a Comment