Saturday 17 March 2018

রঞ্জিত সিংহ


দহনের কবিতা


“প্যাভলভের ঘণ্টা"-র "ভূমিকাকল্প কৰিতাঢির প্রথম পঙক্তি, 'ভিক্ষাপাত্রে পৃশ্নির আহ্বান নিয়ে হে ক্ষুধা/অতিনিবেশ ভৃলে যেও না ' এবং অন্তিম পঙক্তি ‘প্যাভলভের ঘণ্টা বাজলে জিভে|জল তো আসবেই’  দেবকীর গর্ভে কৃষ্ণ আসছেন, মাতা পৃশ্নি বা দেবকী ভিক্ষাপাত্র হাতে ঐশী ক্ষুধাকে আহ্বান জানাচ্ছেন ৷ 'অতিনিবেশ’ শব্দটিও লক্ষণীয় ৷ ছোট কয়েক পঙক্তির  এই ভূমিকাকল্প কবিতাটি পাঠককে প্রস্তুত করে তুলছে-এই কবিতাঢিৱ ভাবসম্পদ ও রূপসম্পদ পাঠককে কেথায়ে নিয়ে যাবে 
তৎসম, তৎভব, দেশি, বিদেশি শব্দের রসায়নে সমস্ত কবিতাটি নির্মিত  পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, এ কবিতার গতিপথ পূর্বপরিকল্পিত নয় ৷ নদীর প্রবাহ পাথরে ধাক্কা খেলে গতিপথ পালটে নতুন পথে চলতে থাকে ! অনুরূপ এই কবিতাটির গতিপথ ৷ কবিতাঢির প্রারম্ভেও কবি স্বয়ং বলে দিচ্ছেন :
 “কোকমুখা দুর্গার কক্ষপখেৱ
বশংবদ ঠিকলো কাউকে বলছি না”
‘দূর্গা' শব্দের ব্যুৎপত্তি বিবিধ ৷ 'দুর্গ’-এর স্ত্রীলিঙ্গ ‘দৃর্গা' ৷ অর্থ – অশক্য> গমন, দুর্গম  তাছাড়া, মহাবিঘ্ন, ভববন্ধ কুকর্ম; শোক, দুঃখ, নরক, যমদণ্ড, জন্ম, মহাভয়, অভিরোগ, (দুর্গাব্যুৎপত্তিবৃত্ত নানার্থ ৷ হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ ভ্রষ্টব্য) ৷ সুতরাং কবি বলছেন, ঠিকানা বলতে তিনি রাজী নন ৷ সম্ভবত কবিতাটির অন্তিম ঠিকানাটি যে কোথায় হয়তো কবিও জানেন না ৷
এইটিই এই দীর্ঘ কবিতাঢির গুহ্য বা গুপ্ত কথা 1 কাউকেই, এই কবিতার ঠিকানা বলা যায় না  অল্প পোড়ানো পাথুরে কয়লার মতো দুর্গার (এখানে ‘দৃর্গ’ অর্থেও নেওয়া যেতে পারে) কক্ষপথে কবিতাটি প্রবাহিত  একটি ‘চেতনা স্রোত (Stream of consciousness) টেনে নিয়ে যাবে পাঠককে ৷ চেতনাস্রোত জল স্রোতের  মতই অনির্ণীত ৷ সংঘাতময়, ঘূর্ণিপ্ৰধান ৷ অথচ দ্রুতগতির চলমানতা ৷ কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতে কবি বলছেন “গন্ধে বুঝতে পারছি/মন কোথায় সেদ্ধ হচ্ছে ৷ ’ অরিজিতের কাব‍্যাত্মা
ধ্রুপদী ঢং-এ গড়া অন্তত এই দীর্ঘ কবিতাটি পড়ে তাই মনে হয় ৷ স্থাপত্যশিল্প; বাড়তি শব্দ নেই, ঘনত্ব প্রধান পঙক্তিতে সংশ্লিষ্ট ৷ আর এই সংশ্লেষই টেনে আনছে নানা বিপ্রতীপ চিত্রকল্প ৷ নদীর সঙ্গে এই কবিতাটির স্রোতধারাকে উপমিত করলে কবিতাটির চিত্রকল্পের ধরনধারণ বোধগম্য হয় ৷ নদী আকাশের বিচিত্র রূপের প্ৰতিবিম্বন যেমন বহন করে, তেমনি সে বহন করে জলের নিম্নের প্রস্তর,বালি, গুল্মরাশির বৈচিত্র্যকে ৷
কবিতাটির গতিপথ কখনো ঊচ্চভূমিতে; কখনো নিম্নভূমিতে ৷ কখনো সে আকাশগঙ্গা, কখনো জনপদ মধ্যবর্তী খরস্রোতা গঙ্গা ৷ কখনো “তথাগত অহিংস টীকাভাষ‍্যে হচ্ছেন শহীদ  কখনো বা “অ্যামিবার গমন পথের সমাহারটুকু” কবিকে পখ চেনাচ্ছে বা কবিতাটির গতিপথ নির্ণয় করে দিচ্ছে ৷ কখনো বা কবিতাকে ক্রোধের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি আবার কখনো “আপৎকালীন ধর্ষণ দৃশ্যে পূর্বরাগ দু’চোখের কলঙ্ককালো/আমাদের ভুলিয়ে রাখে মুহূর্তের শপিংমলের মতো | ” চেতন স্রোতের এই যে উচ্চগামিতা ও নিম্নগামিতা-এর থেকেই উৎক্ষিপ্ত হচ্ছে মণিমানিক্যের নানা চিত্রকল্প ৷ এই রকম অদৃষ্টপূর্ব চিত্রকল্প এই চেতনস্রোত কবিতাঢির খরস্রোতে পথ আগলে এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকে যে, পাঠককে সেইখানে কিছুক্ষণের জন্যে স্থিরীভূত করে রাখবে, পাঠকচিত্তকে উলটেপালটে টেনে নিয়ে যাবে অনির্দিষ্ট পথে ৷
‘অবিরাম হাতুড়ি ঠোকার শব্দে পাখি ডাকল, অথচ,
মেহেরগড়ের প্ৰত্নখননের মতো তোমার উৎকর্ষ ভাবিনি সেদিন, '
কারণ,
‘চতুর্দিকে জল ছাড়া আর কোনো সীমানা দেখছি না"
এই সীমানাহীন জলস্রোত বা চেতন স্রোত টেনে আনছে মুকুন্দরামের পূজিত চণ্ডী দেবীকে, কখনো বা চোখে বল্লুকা নদী, “যেন নদীর মধ্যরাত্রি জন্ম থেকে অর্হত্ত্বপ্রাপ্তি মৈত্রেয় আধার” 
অরিজিতের এই দীর্ঘ কবিতাটি পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে, তাঁর কবিতার উৎসমুখ বৌদ্ধধর্ম ৷ ফলে তাঁর কবিতার চিত্রকল্পে জড়িয়ে আছে বৌদ্ধচিত্নার সূক্ষ শাখা-প্ৰশাখা ৷ এরই কারণে এক একসময়ে কবিতাটির বহু পঙক্তি উচ্চারিত হয়েছে আপ্তবাক্যের মতো ৷ যেমন, “বোধিবৃক্ষের মাথা থেকে নেমে আসা দৈব বালক”  কোথাও যেমন মুকুন্দরামকে দেখতে পাচ্ছি, তেমনি আবার লোচনদাসকে দেখছি "পাতাজাড়া
অক্ষরে গান লিখছেন”  বৌদ্ধভাবনা প্রাচীন বাংলার কবি-এক রূপান্তরিক প্রাচীনতার ঘ্রাণ আধুনিক মেধায় ঐ চেতন স্রোত অবলম্বন করে মিশে যাচ্ছে 
কবিকণ্ঠে আবার ধ্বনিত হচ্ছে আপ্তবাক্যের মতো পঙক্তি :
“ওগো, একটিবার বিশ্বাস করো
মানুষ মরে না, তাকে চক্রান্তসূচক মেরে ফেলা হয়
আমি শ্মশান  জাগানো
আমার ত্যাগ আর ভোগের গল্প প্রতিদিন একই সূর্যের উৎস্রোত”
এই চেতনস্রোতকল্প কবিতাটি সময়ের বহু ক্ষতকে বহন করে সময়ের বাইরে চলে যাচ্ছে ৷ যেখানে দেখি “ইঁদুর খেয়ে ফেলছে বিগ্রহের প্রসাদ”, তারপর কিছুক্ষণ স্তব্ধতা, তারপরই উচ্চারিত হচ্ছে “আমার ভারতবর্ষ”  সময়ের ক্ষত যা দেশকাল জুড়ে অবস্থান করছে, অনিবার্যতাবেই তার অবস্থিতি কবির ব্যক্তিগত কষ্টেও ৷ “অন্ধের স্থাপত্যে বসে থাকা কুকুর/চ্যাপলিন টুপি খুলে শূন্যে ওড়াই/আর দখলের নামে লিখে ফেলি ভালোবাসাএই পঙক্তি গুলিকে সময়ের যাবতীয় ক্ষত ৷ ‘অন্ধের স্থাপত্য’, ‘কৃকুৱ আমি’ , দখলের নামে” লিখে ফেলা ভালোবাসা’ - এই শব্দস্রোতের মধ্য দিয়ে সময় যেন বিক্ষুব্ধ ধ্বনি তুলে এগিয়ে চলেছে  তার মধ্যে থেকে শুশুক যেমন মাথা তোলে, তেমনি দেখতে পাচ্ছি ‘খাদ্যলোভী নীলিমাৰিড়াল’, ‘চুম্বনকাতর মাছ’, যোনিমুখো ফেঊ’, ‘শিশ্নতরু তেড়োপাখি' ৷ এইভাবেই এই দীর্ঘ কবিতাটিতে উৎক্ষিপ্ত হয়ে চলেছে নানা চিত্রকল্প 1 আর এরই ভিতর দিয়ে এগোতে এগোতে হঠাৎ কবিকণ্ঠে শুনতে পাই আত্মস্বীকারোক্তির বেদনা-
একটা জীবন্ত মানুষ পুড়ে যাচ্ছি'

দোহাই গীটাব্ বাজিও না’

কোকমুখা দুর্গার বশংবদ  ঠিকানা
কাউকে বলছি না’ 
ধ্রুপদের মতো কবিতাটির প্রারম্ভিক পঙক্তি যেন সাংগীতিক সমে

ফিরে এল 
সময় যে কীরকম ঐভাবে  জীবন্ত মানুষকে পোড়ায় বাইরে তার
হদিশ নেই “অনেকটা হাঁটার পর হঠাৎ মনে হলো কেউ হাঁটছে  বুঝতে পারা দুরূহ “কীভাবে আগামীর ভিতর প্রবিস্ট হচ্ছে অতীত” 
শেষ পর্যন্ত বুদ্ধের শরণাগতি নিয়েছেন:
হা বুদ্ধ-ছায়া হয়ে দেখা
দিল রিক্তের পূর্ণিমা য়'
এই সমগ্র চেতনস্রোতে কবিতাটি এই দুটি পঙক্তিতে এসে শিখরসন্ধিতে পৌঁছেছে ৷ ‘রিক্তের পূর্ণিমা' : আর্থাৎ রিক্ত হতে হবে, নিঃস্ব হতে হবে, অহং বিসর্জন দিতে হবে তবে যুক্ত হবে পরিনির্বাণেৱ পথ 
এই স্থাপতাধর্মী কবিতায় এত বিভিন্নরকমের স্থাপত্যশিল্প কবির
চেতনস্রোতে হঠাৎ আবির্ভূত হচ্ছে আবার হঠাৎই নিরুদ্দেশ-একটা
অবিরাম দহন প্রক্রিয়া-প্যাভলভের  ঘণ্টাধ্বনি নিরন্তর বেজে চলছে - নিয়ে যাচ্ছে :
‘পৃথিবীর চরম স্থিতি
কিংবা পরমগতি

অবশিষ্ট মাটির. ...
ঔপনিষদিক ভাবনায় যা জঙ্গম তাই স্থিতি, যা শূন্য তাই পূর্ণ 

তারপর মৃত্তিকায় অবশেষ ৷ সমস্ত প্রাণস্বরূপের অবশিষ্ট মৃত্তিকা ৷ কবি অরিজিৎ চক্রবর্তী এই কবিতার পর নিশ্চয়ই থেমে যাবেন না-এই আমার বিশ্বাস ৷ তাঁর দহনপ্ৰক্রিয়া আরও প্রস্তরসঙ্কুল,আরও গগনমার্গী হোক-এটাই প্রত্যাশা 

প্যাভলভের ঘণ্টা/ অরিজিৎ চক্রবর্তী/ বইতরণী/ ৬০ টাকা

No comments:

Post a Comment