Saturday 17 March 2018

কস্তুরী সেন


অথচ এ লেখাও হতে পারত সমালোচনা…


হিন্দোল ভট্টাচার্যের কবিতা বিষয়ে আনন্দবাজার পত্রিকায়, ২০১২ সালে একটি অনতিসংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছিলেন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। নতুন সহস্রাব্দের দ্বিতীয় দশকের দরজায় দাঁড়িয়ে হিন্দোলের কলমে বাংলা কবিতার একটি অভিনব স্বরক্ষেপণকে বরণ করে নিতে পারার আনন্দ, ফুল্ল হয়ে উঠেছিল তাঁর সেই লেখায়। হিন্দোল ভট্টাচার্যের কবিতার বইগুলির মধ্যে তখন রয়েছে ‘তুমি, অরক্ষিত’, 'আবার হেমন্তকাল', বা 'তারামণির হার' এর মত নাম এবং অবশ্যই 'জগৎগৌরী কাব্য' যা পরবর্তীতে  বীরেন্দ্র পুরস্কার এনে দেবে কবিকে।
                অলোকরঞ্জন পেয়েছিলেন একটি নবীন,  প্রতিভাময় স্বর। আর সহস্রাব্দের দুইয়ের দশক শেষের মুখে দাঁড়িয়ে, অনুজ আমরা যখন এই কবির নতুনতম বইটির পাতা উল্টোই আজ, সেই স্বরখানিই আমাদের আশ্চর্য করে দেয় তার বহুলবঙ্কিম গতিপথের মধ্যেও নিজস্ব একটি দর্শনের নিবিড় এবং প্রাত্যহিক উচ্চারণের ধারাবাহিকতায়।
              'আবহমান' এর এ সংখ্যার আলোচ্য বিষয় 'বই'। অস্যার্থে গ্রন্থসমালোচনা। দিনকয়েক আগে বইমেলা নিয়ে লিখতে গিয়ে একটি লেখায় বলেছিলাম, সর্বত্র অজস্র দারিদ্র্য লক্ষণ ফুটে ওঠা আজকের বাঙালিজীবনের যদি একটি শেষ ক্ষেত্র রয়ে যায় সমৃদ্ধির, তারতম্য  বিচারে না গিয়ে, নির্দ্বিধায় তা এই বাংলা বইয়ের প্রকাশনা। ৪৩তম কলকাতা বইমেলা শেষ হল সবেই, যথারীতিই এবারেও পাওয়া গিয়েছে মনোযোগ কেড়ে নেওয়ার মত বেশ কিছু নতুন বই। আমরা তার মধ্যে বিনাপ্রশ্নে শুরুর সারিতে রাখব হিন্দোলের সাম্প্রতিকতম কবিতাবই 'যে গান রাতের'-কে, প্রকাশক 'সিগনেট'।
             কথা হল শুরুর সারিতে রাখব বলে কাজ সেরে ফেলতে পারেন কবিতার পাঠক। বাকিটুকু সম্পূর্ণ নির্জনতায় কবির সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত আলাপচারিতা। ভালো বাসা, এবং/অথবা না বাসা।
             শুরুতেই বলা গিয়েছিল, কবিতার পাঠক যে স্বাধীনতা ভোগ করেন, সমালোচক তার সুযোগ পান না। তাঁর প্রধান দায়িত্বগুলির একটি হল নিজের প্রতিটি ভালো ও মন্দ লাগার সপক্ষে একটি করে যুক্তি দাঁড় করানো। আলাদা করে 'যে গান রাতের' নয়, যে কোন বইয়ের ক্ষেত্রেই, উপরন্তু তা যদি হয় কবিতাবই, তবে তা নিয়ে আলোচনা কেমন হতে পারে?... হিন্দোল ভট্টাচার্য কবিতার গঠন নিয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষায় সিদ্ধলেখনী, সনেটের ধারাগুলিতে তাঁর অবাধ বিচরণ, অথবা 'তারামণির হার' মনে করলে মিতবাক কবিতার ক্ষেত্রে তাঁর শক্তিমত্তা মনে পড়বেই, এ বইতে একাধিক কবিতায় তাঁর কলমে এসেছে মিশ্রবৃত্তের ভাঙা চলনের পাঠলোভন প্রয়োগ, গদ্যকবিতার অন্ত্যমিলহীন নিটোল ছন্দ; কিন্তু শুধু সনেট, গদ্যকবিতা, ইয়াম্বিক পেন্টামিটার বা অক্ষরবৃত্ত মিশ্রবৃত্ত দিয়ে কবিতার একটি বইকে বেঁধে ফেলতে চাওয়া তো অনভিজ্ঞ সমালোচকের পক্ষেও নিতান্ত দুর্বল হয়ে দাঁড়ায় বটেই।
              'যে গান রাতের' বইটিতে রয়েছে মোট ছাপ্পান্নটি কবিতা। কবিতাগুলি প্রসঙ্গে প্রথম যে কথা বলতে হয় তা এই, যে এ কবিতাগুলির কবি, ভাষার তাৎক্ষণিক কারুকাজ বিষয়ে আদৌ আগ্রহী নন। তাঁর প্রবণতার দিকটি তবে কী? এ বইতে দেখি, প্রায় প্রতিটি কবিতার ভাষায় কাজ করেছে একটি অভাবিতপূর্ব হিরণ্ময় নীরবতা। এই নীরবতা ঠিক কাকে বলছি বুঝতে গেলে সরাসরি দেখতে হবে কয়েকটি কবিতাকেই-- 'ঝরে যাবে বলে যারা ফুটে ওঠে, দিগন্ত তাদের হয়তো এক মাঠ, কিংবা একটি উঠোন' ( 'একা', পৃঃ ১০), অথবা, 'আকাশ যেখানে নামে সেখানেই নৌকা হওয়া ভাল!' ('শাস্তি', পৃঃ ১৫), কিংবা 'পৃথিবী পরিষ্কার হোক, গাছ হোক সব মন, তারপর উৎসব হবে।' ('সংক্রান্তি', পৃঃ ২৪)--- এই যে নির্মিত হচ্ছে একেকটি পঙক্তি, আপাতপক্ষে তীব্রতাহীন, প্রতিটি পঙক্তি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যে কোন উচ্চকিত আবেগের বিপরীতে গিয়ে পাঠকের কাছে ভেসে আসছে যেন একরকম সজল বাতাস! ক্রমাগত ভিড় ও কোলাহলের মধ্যে আকস্মিক যবনিকাপাত হলে যে নীরবতা, শহুরে হাইওয়ে ধরে এগোতে এগোতে আচমকা দুদিকে হু হু ধানক্ষেত চোখে পড়লে যে শীতলতা, পাঠক জানবেন এ বইয়ের ভাষার নীরবতা আসলে সেই নীরবতা, বলা ভাল ক্ষান্তিময় ভাষা এক, স্বতঃই নির্জন ও আত্মমগ্ন।
            হিন্দোলের কবিকৃত্যকে এ বইতে চালনা করেছে তাঁর দর্শকসত্তাও। দৃশ্যের পর দৃশ্য এঁকেছেন কবি। তত্ত্বের ভাষায় চিত্রকল্প বলব তাকে, নাকি লঘু/গুরু-তর কিছু, সে তর্ক বাদ দিয়ে দেখে নিই তিনি কী দেখেছেন, ---'এমন এক শহরে জন্ম নিয়েছি যার প্রেম ছিল, ভোরবেলা কয়েকশো পায়রা নেমে আসত মন্দিরের শীর্ষ থেকে, বকম বকম শব্দে ভরে যেত সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ', ('কোমা', পৃঃ ৩৪), দেখেছেন -- 'অথচ রোদ এসে পড়ছে জানলায়, বৃষ্টির ছাঁট এসে পড়ছে মাটির উপর, ডানা ভিজছে, রোদ শান্ত হয়ে আসছে, সকাল গড়াচ্ছে বিকেলের দিকে......ওই শোনো উৎসবের ঘণ্টা বাজল, এসো হাত ধরি' ('দয়িতাকে', পৃঃ ৬১)।
            ভাষা থেকে ছবিতে, ছবি থেকে অনুভবেই যেন বা প্রায়, একটি সার্বিক অনাড়ষ্ট প্রবহমানতা, পাঠককে মুখোমুখি হতে হচ্ছে না কোন প্রতিবন্ধের, কোন সিঁড়িভাঙার বিষয় নেই এ লেখাগুলিতে, কোন জটিল নিহিতার্থের ধাঁধায় একমুহূর্ত পাঠককে, বা দর্শককেই যেন বা তাঁর, পাক খাওয়াচ্ছেন না কবি। সমালোচনার বদলে যদি পাঠ অভিজ্ঞতা বলতে হয়, তবে বড় আনন্দিত হয়ে বলতে হয় হিন্দোল স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাঁর কবিতায় কোথাও কোন গভীর গম্ভীর দর্শনের অবতারণা করেননি, ভারী লঘু ও স্বচ্ছন্দ চালে এগিয়েছে সমস্ত লেখাই, অথচ গোপনে রয়েছে দীর্ণতা ও বেদনা, অথচ এই অনুচ্চকিত ভাষ্যেই কখনও কখনও তৈরি হয়েছে ধাক্কা মারার মত ক্ষমতাশালী একেকটি পঙক্তি।
              আশ্চর্য মুনশিয়ানা দেখি কবিতার শেষগুলিতে। অথবা তাঁর মানের কবির থেকে প্রত্যাশিতও এ মুনশিয়ানা। তবু মন ভালো হয়ে যায়ই যখন একটি নিটোল চলনের পর প্রায় প্রতিটি লেখাই শেষ হয় অপ্রত্যাশিত এবং অনাস্বাদিতপূর্ব একেকটি পঙক্তিতে। লোভ সংবরণ নিরর্থক বলে উদাহরণই আবারও, যেমন 'জার্নাল' (পৃঃ ১৬) কবিতার শেষ লাইন--- 'কেমন বৃষ্টি পড়লে আশ্চর্য সোঁদা গন্ধে ভরে যায় বাতাস। এর নাম জীবন। একে প্রণাম কোরো, সময় পেলে।' যেমন --- 'যেখানে বাঁশি বাজে, আর তুমি ভাব রাখাল, আমি দেখি কৃষ্ণ এসেছেন।-- তার চোখে খিদে নেই কোনও।' ('কবি', পৃঃ ১৮)। এবং যেমনও, 'সাবধানে থেকো, আর হারমোনিয়ামের রিডে বেজে ওঠো কখনও কখনও। রাত তো তোমাকে চায়, তোমাকেও জেগে থাকতে হবে। যেন আমি ভোরবেলা উঠে দেখি প্রথম ট্রামের মত কেউ এল তোমার সংসারে।'('যে গান রাতের', পৃঃ ৬১)
                কবিতায় ছন্দ নিয়ে খুব বেশি পরীক্ষানিরীক্ষা রয়েছে এ বইতে, এমন নয়।মূলত গদ্যছন্দের কবিতাগুলির মধ্যে ব্যক্তিস্তরে ছন্দলোভী পাঠকের জন্য তারই মধ্যে উপহার হতে পারে  'ভুবনায়ন'(পৃঃ ৩৬) বা 'পরশপাথর'(পৃঃ ৪৭) এর মতো কয়েকটি কবিতা।
            সমালোচনার একটি অলিখিত দস্তুর এই যে অনুসন্ধান করে অন্তত খানকয়েক অপ্রাপ্তির জায়গা, যে কোন দিকেই, বার করা না গেলে সে রিভিউ- কে তেমন মান্যতা দেওয়া চলে না। মজাটা দাঁড়াল এই, এ বিষয়ে সৎ চেষ্টার তত অভাব ছিল না, স্বয়ং কবির তথা সম্পাদকেরও,ইন্ধন ছিল যথেষ্ট। তবু এ বইয়ের ক্ষেত্রে দেখা গেল Book Review এর নির্বিকার সরেজমিন জরিপ, কোনওখানে পরাজিত হয়েছে পাঠকের আনন্দের কাছে।  
         'যে গান রাতের' আসলে আমাদের পীড়িত চোখদুটি ধুইয়ে দেবার কাজ করে কোথাও। মন্দিরের একটি অপ্রতিম ঘণ্টাধ্বনির কাজ করে যেন।কোথাও এক বুভুক্ষু সময়ের সামনে এসে কাজ  করে সন্ন্যাসীর স্নিগ্ধ করতল প্রসারণের।
          অলোকরঞ্জন নবীনকে বরণ করে নিয়েছিলেন সহস্রাব্দের প্রথম দশকের পর পরই, হিন্দোল ভট্টাচার্যের কবিতাচর্যা যে ২য় দশকের শেষভাগে এসে অনুজ প্রজন্মের কাছেও সমান এবং আরও বেশি করে বরণীয় প্রতিমুহূর্তেই, 'যে গান রাতের' তার সার্থকতম প্রমাণ মাত্র। কম বেশি কিছু নয়।
কিন্তু রাত কেন? ভোর নয় কেন? তা কি এই জন্য যে রাত হল বিশুদ্ধতম সময়?

যে গান রাতের/ হিন্দোল ভট্টাচার্য/ সিগনেট প্রেস/ ১০০টাকা

2 comments:

  1. আলোচনাটি পড়ে ভালো লাগলো । লেখকের গদ্য রমণীয় । দৃষ্টিভঙ্গি সুন্দর ।

    ReplyDelete
  2. ভালো লাগলো। বইটি সংগ্রহের ইচ্ছে রইলো।

    ReplyDelete