Wednesday 28 March 2018

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে




‘সবিনয় নমস্কারপূর্ব্বক নিবেদন,
অক্ষয়বাবু আপনার উপর রাগ করিয়া আমাকে আঘাত করিয়াছেন এ কথা আপনি ঠিক ঠাহর করেন নাই। অচলায়তন সমালোচনায় আপনি একেবারে মৃত্যুবাণ ছাড়েন নাই বলিয়া তিনি আপনাকে উপলক্ষ করিয়া আমাকেই লক্ষ্য করিয়াছেন। তিনি আপনাকে পরামর্শ দিয়াছেন, যে, হয় এসপার নয় ওসপার – ল্যান্সেট লইয়া ফোড়াকাটা সমালোচনা নয় – খাঁড়া লইয়া একেবারে নিঃশেষে সারিয়া ফেলাই সনাতনী চিকিৎসা। ক্ষত্রিয় মতে সমালোচনা কেমন করিয়া করিতে হয় ব্রাহ্মণকে তিনি তাহার উপদেশ দিয়াছেন এবং তাহার নমুনাও দেখাইয়াছেন। কিন্তু এরূপ সাহিত্যিক গুণ্ডাগিরি যাহারা নূতন হঠাৎ ক্ষত্রিয় হইয়াছেন তাঁহাদিগকেই শোভা পায়, ইহা বুনিয়াদি ঘরের কায়দা নহে। কোনো বিষয়ের দুই দিক দেখিয়া সত্য বিচার করা অকর্ত্তব্য এরূপ অদ্ভুত উপদেশ সনাতনী বা নূতনী কোনো সংহিতায় আজ পর্যন্ত দেখা যায় নাই। ইহা নিতান্তই ক্রোধান্ধতার উন্মত্ত প্রলাপ।
এরূপ রচনা পড়িলে আমার লজ্জা বোধ হয়। কারণ, যিনি লেখক তিনি বয়োবৃদ্ধ। তিনি হঠাৎ অসংবৃত হইয়া উঠিলে অত্যন্ত অশোভন হয়। মানুষ বিচলিত হইলেই তাহার দুর্বলতা প্রকাশ হইয়া পড়ে – কিন্তু সেটা যদি সরলভাবে প্রকাশ পায় তবে তাহাতে তেমন দোষ হয় না; যদি স্বরচিত বিচারকের আসনের উপর চড়িয়া বসিয়া বিচারকের ভড়ং করিয়া অন্তর্দাহকে অসংযতরূপে ব্যক্ত করা হয় তবে সেটা লজ্জাকর হইয়া পড়িবেই। কারণ, নির্লজ্জতার মতো লজ্জাজনক আর কিছুই হইতে পারে না। তিনি ছাড়া বঙ্গসাহিত্যে আর কেহ সমালোচনা করিতে জানেন না এই অভিমান এমন প্রগলভভাবে লেখক যদি প্রকাশ না করিতেন তবে তিনি রাগের মাথায় যাহা তাহা যেমন তেমন করিয়া বলিলেও আমাদের পক্ষে এমন সংকোচের কারণ হইত না। বাদী প্রতিবাদীতে মাথা ফাটাফাটি হইয়াই থাকে কিন্তু ন্যায়পরতার অহংকার ঘোষণা করিয়া জজ সাজিয়া কেহ লাঠি হাতে দাঙ্গা করিতে আসিলে তাহাতে যত বড়ো দুর্ঘটনা ঘটুক তথাপি তাহা প্রহসন হইয়া দাঁড়ায়।
অক্ষয়বাবু যাহাকে যথার্থ সমালোচনা বলিয়া প্রচার করিতেছেন সেরূপ সমালোচনা আমি যত সহিয়াছি এমন বোধ হয় আর কেহ নহে। তাহার দ্বারা সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি সাধন হইয়াছে কিনা সে বিচার আমি করিতে চাই না; কিন্তু আমার তাহাতে অনিষ্ট হয় নাই, ভালোই হইয়াছে। একান্ন বৎসর বয়স নিতান্ত কম নয় – আশা করি, আরো যখন বয়স হইবে তখন প্রবীণ বয়সের প্রগলভতার অধিকার দাবি করিয়া নিজের চিত্তচাঞ্চল্যকে সাহিত্যের প্রকাশ্য সভায় অনাবৃতভাবে উপস্থিত করিতে লজ্জাবোধ করিব। দেশের প্রবীণ সমালোচকদের হাতে যদি প্রশংসা লাভ করিতাম তবে বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যক্ষেত্রে আত্মসংবরণ করা হয়তো উত্তরোত্তর অসাধ্য হইত।…'
ইতি ২৭শে অগ্রহায়ণ, ১৩১৮ [১৩ ডিসেম্বর, ১৯১১]
শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

উদ্ধৃত, শোভনলাল গঙ্গোপাধ্যায়-সম্পাদিত, পত্র-প্রসঙ্গ, রবীন্দ্রবীক্ষা : ১০ পৌষ, ১৩৯০, পৃ ২১-২২।

সম্পাদকীয় দপ্তর - বেবী সাউ   মণিশংকর বিশ্বাস   শ্যামল ভট্টাচার্য   
                                           হিন্দোল ভট্টাচার্য

No comments:

Post a Comment