Saturday 17 March 2018

রাজর্ষি দে


ভাতফুল ও মায়াজীবন


যদিও বাংলা কবিতার দশকভাগ কোনো নিখুঁত বিজ্ঞান নয়, তবুও কবিতার প্রবণতা এবং বাঁক বদল অনেক সময় সহজে বোঝা যায় এই দশক বিচারে। সেলিম প্রথম দশকের কবি। তাঁর প্রথম বই নিয়ে কথা বলতে গেলে আমাদের সুবিধে হবে প্রথমে এই দশকের সাধারণ প্রবণতাগুলোর দিকে যদি আমরা নজর দিই। প্রথম দশকে যেই তরুণ কবিরা লিখতে শুরু করেছেন তাদের মধ্যে থেকে যদি আমরা সাধারণ প্রবণতাগুলো তুলে আনতে চাই, প্রথমেই আমাদের চোখে ধরা পড়বে বিমূর্ত দৃশ্যকল্পের ব্যবহার। একটি কবিতা অনেকসময় যেন শুধুমাত্র  একঝাঁক  মুহূর্তকে ধরতে চাইছে এই দৃশ্যকল্পের মাধ্যমে। এই দশকের প্রেম যেন শুধুমাত্র দুজন মানুষের মধ্যের কিছু মুহূর্ত। সেই প্রেমের আধার হিসেবে যে সামাজিক পটভূমি থাকে তা যেন অস্বীকার করছে এই সময়ের কবিতা। মানুষী প্রেমের বিস্তৃতির বদলে অনেকসময়ে যেন তা আরো সংকুচিত হয়ে শুধুমাত্র নিজের মধ্যে ধারণ হচ্ছে, প্রেমের পাত্রেরও প্রয়োজন তার হচ্ছে না। এছাড়াও সমাজ-রাজনৈতিক পরিস্থির প্রভাবও এই দশকের কবিতার ওপর প্রায় শূন্য। এককথায় বলতে গেলে বিমূর্ত পরাবাস্তব রূপকল্প, শীতল মানুষী প্রেম, এবং সামাজিক-রাজনৈতিক কনটেক্সট বিহীনতা এ সময়ের কবিতার রুটম্যাপ। এই চালচিত্রে দাঁড়িয়ে সেলিমের কবিতা যেন এক ঝলক টাটকা হওয়া। আবহমান বাংলা কবিতার সোঁদা জমির গন্ধ। অযথা অতিরিক্ত দৃশ্যকল্পের আরোপিত স্মার্টনেস নেই। সম্পর্কের গাছের শিকড় ভালোলাগার মানুষী থেকে পরিবার, পরিজন, পরিবেশ সবাইকে আকড়ে ধরে গভীরে যাত্রা করেছে। আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশ সুস্পষ্টভাবে ছুঁয়ে যায় তাঁর কবিতা, কিন্তু কখনই কবিতাকে মেনিফেস্টো বানায় না।
তাঁর প্রথম বই "মায়াজন্ম" ২০১৮র বইমেলায় প্রকাশ পেল সৃষ্টিসুখ প্রকাশনা থেকে। উৎসর্গ পাতাতেই পরিষ্কার তাঁর কবিতা আর যাই হোক "অরাজনৈতিক" নয়- "... আমরা তিন অভুক্ত প্রাণী/ রাষ্ট্র নামক কোনো কুয়োর ভিতর আটকে আছি/ আরও অনেক প্রাণীর সাথে"। একইসঙ্গে এই পাতা থেকেই বুঝতে পারা যায় সেলিমের কবিতা পরিবার থেকে শুরু করে প্রেম, ভাষা থেক শুরু করে আমাদের প্রতিবেশী গাছ প্রত্যেক সম্পর্ককে ছুঁয়ে যায় এক রক্তমাংসের মানবিক যাপনে। এই বইয়ের একের পর এক কবিতায় ফিরে ফিরে এসেছে পরিবার আর তার মানুষগুলোর মধ্যেকার সম্পর্কের জটিল বুনন। "মা গাছ ভালবাসে না/ কারণ, বাবাকে পোড়ানো হয়েছিল চ্যালা দিয়ে/...../ আজ খিদে পেলে, মা উনুন জ্বলায়/ শৌখিন আসবাব পোড়ে/.."। এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যেদের মধ্যেকার সম্পর্ক জটিলতা বারবার উঠে এসেছে এক সরাসরি নির্মোহ অতিরিক্ত আবেগবিহীন ভাষায়। "বাবার ইচ্ছে একবার আরবে যাবার/.../ কিন্তু ঘরে আছে কবিপুত্র/ সঞ্চয় ফুরালে চরম দুর্ভিক্ষ নেমে আসতে পারে"।  আবার এই ব্যক্তিগত কথনই বিস্তৃত হয়ে কখনো চিনিয়ে দিয়েছে বৃহত্তর সমাজ বাস্তবতা, এক সংখ্যালঘু পরিচয়ের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকার অসহায়তা "খুব ভোরে আজান শুনে কেঁদে ফেলে যে পাখি/ সে কি অসহিষ্ণু? শিসে বুক নিয়ে জন্মেছিল এদেশে/ এখন এ হিঁদুর দেশ, তার মুসলমানের বাড়ি"
সেলিমের কবিতায় প্রেম বারবার ফিরে এসেছে তার সমস্ত রক্তমাংসের স্বাদ নিয়ে। কোনো দুরূহ দৃশ্যকল্পের মোহে আটকে থাকেনি তাঁর ভাষা। মৃদু কিন্তু ঋজু, অযথা গ্যাদগ্যাদে আবেগ নেই, এক নির্মোহ অলংকারহীন সৎ ভাষা। "মুনাই, তোমার হাতঘড়িটা আমার মৃতদেহের পাশে রেখ/....../ আর হ্যাঁ, আমার মৃত্যুর দিন স্নান কোরো না/ ঘড়িতে তোমার স্পর্শ লেগে থাকে যেন"। দুরূহ কে পাশে সরিয়ে রাখলেও চামড়ার আটটা স্তরের মতন সেলিম ভালবাসার প্রতি স্তরে নেমেছেন যেন এক আপাত নিরুত্তাপ ভাষায়- "স্বপ্নে আজকাল খুব অঙ্ক দিদিমণি আসে। বন্ধুরা ওটাকে বলে স্বপ্নদোষ। আমি দোষ খুঁজে পাই না। এমন সুন্দর.... " কিংবা "মায়ের জ্বর এলে/ পাশেরবাড়ির মেয়েটি ঘন ঘন আমার বাড়ি আসে/ ওর মা নেই/ সামনাসামনি মেয়েটিকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি/ (হয়তো ইচ্ছে করেই!)"।
সেলিমের কবিতা পরাবাস্তব বিমূর্ত দৃশ্যকল্পের মোহে আটকে না থাকলেও, প্রয়োজন মতন তাঁর কবিতা যে কী ভীষণ যথোপযুক্ত দৃশ্যকল্প তুলে আনতে পারে, তার সবচেয়ে ভাল নিদর্শন বোধহয় 'ভাতফুল' কবিতার সিরিজটি। এক নিম্নমধ্যবিত্ত পারিবারিক পটভূমিকায় ভাত কেমন করে ফুল হয়ে ফুটতে পারে তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় পাঠককে। এই ‘ভাতফুল’ শব্দটি সেলিমের নিজের, কোনো অভিধানে পাওয়া যাবে না। আর কিছুর জন্য না হোক শুধু এই শব্দের জন্য বাংলা কবিতা এই বইকে মনে রেখে দেবে। "মৃতদেহের উপর উনুন ধরিয়ে বলবে/ 'ভাত ফুটে গেছে। খেয়ে নে'?/..../ খিদে তো মাতৃত্বের দাবি করে/ তবুও প্রণম্য ফুলটি পায়ে পায়ে এত দামি!"
এই প্রচণ্ড ব্যথাতুর বেঁচে থাকা, পায়ের তলা থেকে মায়ার শিকড় চারিয়ে যাওয়া, এক পকেট ভর্তি কমলালেবু নিয়ে হেঁটে যাওয়া, এক দালান জ্যোৎস্না থেকে ভাতফুল কুড়িয়ে নেওয়া এই নিয়েই তো আমাদের মায়াজন্ম সেই জন্মের পথে রাস্তা চিনিয়ে পাঠককে নিয়ে গেছেন সেলিম সেই সঙ্গে পাঠকের প্রত্যাশা আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন তাঁর প্রতি
গ্রন্থ – মায়াজন্ম/ সেলিম মণ্ডল/ সৃষ্টিসুখ

No comments:

Post a Comment