আর্যতর্কঃ পাঠপ্রতিক্রিয়ার চেয়ে কিছু বেশি
বছরখানেক আগে, মহাভারত পড়তে বসে, এ-বিষয়ে নতুন করে আগ্রহ জন্মাল। মনে
হল, যাদের নিয়ে এই মহাকাব্য, সেই কুরু, পাঞ্চাল বা বৃষ্ণিদের আসল পরিচয় কী? এই
যুদ্ধ ঠিক কোন সময়ের ঘটনা? কী এর ইতিহাস? কে এই ব্যাসদেব, যিনি আবার বেদ-বিভাজকও
বটে? এই প্রশ্নগুলোর সুবাদেই, ভারতবর্ষের প্রাগিতিহাস ঘেঁটে দেখা জরুরি হয়ে
দাঁড়াল। প্রয়োজন হল, আর্যদের আসল পরিচয় নিয়ে মাথা ঘামানোর।
এ-বিষয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে দেখেছি, বাংলাভাষায় আর্যতত্ত্ব নিয়ে তেমন
কোনো ভালো বই নেই। মৌলিক কাজ তো দূরস্থান, বিষয়টার সম্পর্কে একটা সার্বিক ধারণা
দিতে পারে, এমন বইও বাংলায় মেলা ভার। দেশে-বিদেশে এ-নিয়ে যে-বিপুল কাজ হয়েছে গত
কয়েক-দশকে—প্রত্নতত্ত্ব ও ভাষাতত্ত্ব থেকে আরম্ভ করে জেনেটিক্স অবধি—সে-সম্পর্কে
জানতে গেলে, বিদেশি বই ছাড়া, আগ্রহী পাঠকের আর কোনো গতি নেই।
এমতাবস্থায়, শ্রীসুজিত দাশের লেখা ‘আর্যতর্কঃ একটি তাত্ত্বিক
ক্রীড়াভূমি’ বইটির কথা শুনে, স্বভাবতই আমার আগ্রহ জন্মায়, এবং প্রকাশক শ্রীমানস
চক্রবর্তী-র সৌজন্যে, কলকাতার বাইরে বসেও, বইটি জোগাড় করা সম্ভব হয়। সত্যি বলতে, ‘আর্যতর্ক’
বইটি হাতে নিয়েই আনন্দ হয়েছিল,
কেননা এমন সুমুদ্রিত বই বাংলায় চট করে চোখে পড়ে না। গঠনসৌকর্ষে এই
বইয়ের মান যেকোনো বিদেশি প্রকাশনার সমতুল্য। এ-বাবদে,
প্রকাশকের একটি বিশেষ অভিনন্দন প্রাপ্য।
এবার আসি বইটির বিষয়বস্তুর কথায়। আগেই বলেছি, আর্যতত্ত্ব, বা আর্য-আগমন
তত্ত্ব নিয়ে বাংলায় ভালো বই নেই বললেই চলে। সেই কারণেই, এই বইটির কাছে আমার
প্রত্যাশা ছিল অনেক। বইটিতে চোখ বোলালে বোঝা যায়, এটি লেখার পিছনে, লেখকের
দীর্ঘদিনের অধ্যবসায়, পড়াশোনা ও শ্রম রয়েছে। ভাষাতত্ত্ব থেকে জেনেটিক্স অবধি,
আর্যতত্ত্ব-সংক্রান্ত প্রায় সমস্ত বিষয়কেই তিনি পর্যালোচনার আওতায় আনতে চেয়েছেন।
চেয়েছেন, প্রচলিত মতগুলিকে খতিয়ে দেখে, তাদের গ্রহণ বা বর্জন করে, নতুন কোনো
সম্ভাব্য বিকল্পের ভাবনায় পাঠককে ভাবিত করতে। সেদিক থেকে, এই বইটি একটি
গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। কিন্তু, দুর্ভাগ্য এই যে, এত আয়োজন-সত্ত্বেও, বইটি আমার
প্রত্যাশা পূরণ করতে পারল না।
আর্যতত্ত্ব বা আর্যতর্কের গোড়ার কথাঃ কী এবং কেন
১৭৯৬ খ্রীষ্টাব্দে, কলকাতায়
রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটির সভায়, ভারতীয় সংস্কৃতি নিয়ে একটি বক্তৃতা দেন তৎকালীন
প্রধান বিচারপতি ও সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়ম জোনস। সেখানে, আরো নানান বিষয়ের পাশাপাশি, তিনি একটি বিস্ফোরক মন্তব্য করেন, যা তুলনামূলক তথা ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্বের ক্ষেত্রে
আজও একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক বলে বিবেচিত হয়। তিনি বলেন,
"The Sanscrit language, whatever be its antiquity, is of a wonderful
structure; more perfect than the Greek, more copious than the Latin, and more
exquisitely refined than either, yet bearing to both of them a stronger
affinity, both in the roots of verbs and the forms of grammar, than could
possibly have been produced by accident; so strong indeed, that no philologer
could examine them all three, without believing them to have sprung from some
common source, which, perhaps, no longer exists; there is a similar reason,
though not quite so forcible, for supposing that both the Gothic and the
Celtic, though blended with a very different idiom, had the same origin with
the Sanscrit; and the old Persian might be added to the same family."
ইয়োরোপীয় ভাষাগুলির মধ্যে, বিশেষত তাদের শব্দভান্ডারের মধ্যে,
আশ্চর্য কিছু সাদৃশ্য ও সমাপতন যে রয়েছে,
এটা অবিশ্যি সেই ষোড়শ শতক থেকেই ইয়োরোপীয় ভাষাতাত্ত্বিকরা লক্ষ করে
আসছিলেন, এবং ইয়োরোপীয় ভাষাগুলি যে
একটি সাধারণ আদি-ভাষা থেকে উদ্ভূত, এমন
ধারণাও তাঁদের মনে দানা বাঁধছিল। হয়তো, বাইবেল-বর্ণিত বাবেল-চূড়ার মিথ তাঁদের এমত সিদ্ধান্তে খানিকটা ইন্ধনও
জুগিয়েছিল। কিন্তু, উইলিয়ম
জোনস তাঁর বক্তৃতায় নির্দ্বিধভাবে জানালেন,
যদি অতীতে এমন কোনো আদি-ভাষা সত্যিই থেকে থাকে,
তবে তা শুধু ইয়োরোপীয় ভাষাগুলিরই নয়,
সংস্কৃত ও ইরানীয় (আবেস্তান) ভাষারও জননী বটে। ভাষাতত্ত্বের ফ্যামিলি
ট্রি-মডেল, বা ক্ল্যাডিস্টিক মডেলের
এই হল গোড়ার কথা। যদি বলি, জোনসের
এই বক্তব্য থেকেই আধুনিক তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের উদ্ভব ও বিকাশ, তাতেও বড় একটা অত্যুক্তি হয় না।
শুধু তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বই নয়,
এই বক্তৃতার সূত্রেই জন্ম নিল আর্যতত্ত্ব,
এবং সেই সংক্রান্ত এক দীর্ঘস্থায়ী বিতন্ডা,
আজ অবধি যার কোনো সন্তোষজনক সমাধান পাওয়া যায়নি। ব্যাপারটা এইরকম যে, কোনো একটি ভাষার অস্তিত্ব থাকলে, সেই ভাষাভাষী একটি জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব থাকাও
স্বাভাবিক। অর্থাৎ, অধুনাবিলুপ্ত
যে-ভাষা থেকে ইয়োরোপীয়, সংস্কৃত
ও ইরানীয় ভাষার উৎপত্তি বলে অনুমান করা হচ্ছে,
সত্যিই যদি তা কোনোকালে থেকে থাকে,
তাহলে সেই ভাষায় কথা-বলা একটি জনগোষ্ঠীও সে-কালে বিদ্যমান ছিল।
ভাষাগতভাবে, ইয়োরোপ ও এশিয়ার বর্তমান
জনগোষ্ঠীর একটি বড়-অংশকে এদের উত্তরসূরী বলে ভাবা যেতে পারে। ফলে, এরা কারা,
কোথায় থাকত, কেমন
ছিল এদের সমাজ ও জীবনচর্যা, তা
নিয়ে আগ্রহ জন্মানো খুবই স্বাভাবিক। ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে, একদল পণ্ডিত অনুমান করলেন যে, এই জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল ককেশাস অঞ্চলে। অন্য একদল
পণ্ডিত বললেন, এদের আদি-বাসভূমি এশিয়া
মাইনর। ম্যাক্সমূলার-সহ নানান ভারততাত্ত্বিক এদেরকে ঋগবেদ-বর্ণিত আর্যদের সঙ্গে এক
করে দেখতে চাইলেন। এর মধ্যে, উনবিংশ
শতকের শেষাশেষি, সিন্ধু-সভ্যতার অবশেষ
আবিষ্কৃত হল। জানা গেল, বর্তমান
পাকিস্তান ও ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে,
৩০০০-২০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ (বিসিই) নাগাদ,
এক উন্নত নগরসভ্যতা গড়ে উঠেছিল,
যা ১২০০ বিসিই নাগাদ হঠাৎ বিলুপ্ত হয়ে যায়। জন মার্শালের মতো পণ্ডিত
জানালেন, সম্ভবত বহিরাগত আর্যদের আক্রমণই
এই সভ্যতার ধ্বংসের কারণ।
বিংশ শতাব্দীর সূচনায়, এই
তত্ত্বের ক্ষেত্রে একটি পালাবদল ঘটল। গোড়ায় যা ছিল নিছকই একটি ভাষাতাত্ত্বিক ও
নৃতাত্ত্বিক সমস্যা (খ্রীষ্টীয় ধ্যানধারণা,
ও ঔপনিবেশিক মনোবৃত্তির সম্ভাব্য প্রভাব মেনে নিয়েও), ধীরে ধীরে তা-ই হয়ে উঠল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধনের
একটি হাতিয়ার এবং বর্ণবৈষম্যের ‘বৈজ্ঞানিক
ভিত্তি’। জার্মানিতে নাৎজিদের হাতে, এই আর্য-তত্ত্ব ক্রমশ এক ভয়ানক মারণাস্ত্রের চেহারা নিল। এতটাই
সুদূরপ্রসারী হল তার প্রভাব যে, দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের পর, দীর্ঘকাল
যাবৎ, এ-বিষয়ে যে-কোনো রকম
আলোচনাকেই পাশ্চাত্য পণ্ডিতমহলে বিশেষ সন্দেহের চোখে দেখা হত। ‘আর্য’ শব্দটিও বিষবৎ পরিত্যাজ্য বলে বিবেচিত হল।
অবিশ্যি, ঋগবেদ থেকে আহৃত এই শব্দটি, ভাষাতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক দিক থেকে, খুব একটা সুপ্রযুক্ত ছিল এমন নয়। বরং, আদি-ভাষা ও সেই ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী, এই দুটিকে যুগপৎ বোঝাতে,
পণ্ডিতরা ‘প্রোটো-ইন্দো-ইয়োরোপীয়ান’ শব্দটি ব্যবহার করাই সমীচীন বোধ করলেন।
১৯৬০-৭০ নাগাদ, ‘প্রোটো-ইন্দো-ইয়োরোপীয়ান’
ভাষা ও জনগোষ্ঠী নিয়ে আবার নতুন করে কাজ শুরু হল। প্রত্নতাত্ত্বিক
মারিয়া গিম্বুতাস নিয়ে এলেন ‘কুরগান হাইপথেসিস’। স্লাভিক ভাষায় ‘কুরগান’ শব্দের অর্থ মাটির ঢিপি। ইউরেশীয় স্তেপ অঞ্চলে,
আদি-ব্রোঞ্জ যুগের অনেকগুলি কবর তিনি আবিষ্কার করেছিলেন, যাদের ওপরে এমন মাটির ঢিপি দেখতে পাওয়া যায়। তাঁর
অনুমান, কবর বানিয়ে তার ওপর একটি
উঁচু মাটির ঢিপি নির্মাণ করাই ছিল এই বিশেষ জনগোষ্ঠীর অন্তিম সৎকারের রীতি। এইসব
কবরে প্রাপ্ত সামগ্রী ও অন্যান্য নিদর্শন থেকে তিনি এও অনুমান করেন যে, এরা ছিল যাযাবর,
বা প্যাস্টরালিস্ট। এরাই প্রথম ঘোড়াকে পোষ মানায়, ও আবিষ্কার করে ঘোড়ায় টানা দ্রুতগামী রথ। আর, ঘোড়া ও রথের সহায়তায়,
৫০০০-২৫০০ বিসিই-র মধ্যবর্তী কালখণ্ডে,
স্তেপ অঞ্চল থেকে এরা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে থাকে পশ্চিমে আর পূর্বে।
গিম্বুতাসের মতে, এরাই
ছিল প্রোটো-ইন্দো-ইয়োরোপীয়ান ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী। আর এদের হাতেই, পূর্ব ইয়োরোপের নিওলিথিক কৃষি-সভ্যতার অবসান হয়।
গিম্বুতাসের এই প্রতিপাদ্যের পেছনে অবশ্য তাঁর নারীবাদী অবস্থানের একটা প্রভাব
ছিল। তাঁর চোখে, প্রোটো-ইন্দো-ইয়োরোপীয়
জনগোষ্ঠী ছিল পুরুষতান্ত্রিক এবং যুদ্ধবাজ। আর,
পূর্ব-ইয়োরোপের কৃষিভিত্তিক সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক
(কুকুতেনি-ত্রিপোলাই সভ্যতায় প্রাপ্ত অসংখ্য মাতৃকামূর্তিকে তিনি মাতৃতন্ত্রের
প্রতীক হিসেবে ব্যাখ্যা করেছিলেন)। ফলে, প্রোটো-ইন্দো-ইয়োরোপীয়দের হাতে এই সভ্যতার পতন আসলে পুরুষতন্ত্রের হাতে
আদিম মাতৃতান্ত্রিক সমাজের পরাজয়। ১৯৮০ সাল নাগাদ,
এই তত্ত্বের বিপরীতে, কলিন
রেনফ্রিউ তাঁর ‘আনাতোলিয়ান হাইপথেসিস’-এর প্রস্তাবনা করেন। তিনি বলেন, ৭০০০-৫০০০ বিসিই-র মধ্যবর্তী সময়ে, আনাতোলিয়া (বর্তমান টার্কি) থেকে নিওলিথিক কৃষকরা
ক্রমশ ইয়োরোপের দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। এদের ভাষা ছিল প্রোটো-ইন্দো-ইয়োরোপীয়ান। প্রত্নতাত্ত্বিক জেমস
প্যাট্রিক ম্যালরি, ডেভিড
অ্যান্থনি প্রমুখ, নতুন
কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের সাপেক্ষে,
গিম্বুতাসের মূল তত্ত্বটিকে খানিকটা পরিমার্জনা করে, ‘মডিফায়েড কুরগান হাইপথেসিস’-এর প্রবর্তন করলেন। তাঁরা বললেন, ‘ইনভেশন’ বা আক্রমণ নয়,
প্রোটো-ইন্দো-ইয়োরোপীয়ানদের সম্প্রসারণ ঘটেছিল ছোট-ছোট স্বল্পদূরত্বের ‘মাইগ্রেশন’ বা অভিবাসনের মাধ্যমে। উন্নত অস্ত্র, ঘোড়া এবং রথের ব্যবহারের কারণে, অন্য জনগোষ্ঠীর নেতাদের সঙ্গে সমঝোতা করতে বা
সেইসব গোষ্ঠীর যোদ্ধা ও শাসকশ্রেণীর সঙ্গে মিশে যেতে এদের অসুবিধে হত না। ম্যালরি
বা অ্যান্থনি একে ‘এলিট
রিক্রুটমেন্ট’ বলে অভিহিত করেছেন। এভাবেই, ধারাবাহিক অভিবাসন ও সংমিশ্রণের মাধ্যমে,
প্রোটো-ইন্দো-ইয়োরোপীয়রা তাদের স্তেপ-অঞ্চলের আদি বাসভূমি থেকে ক্রমশ ইয়োরোপ ও
দক্ষিণ এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল। এদের সর্বশেষ শাখাটি,
যাকে ইন্দো-ইরানিয়ান শাখা বলা হয়,
আনুমানিক ২০০০-১৮০০ বিসিই নাগাদ ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিমে
সিন্ধু-সভ্যতার সংসস্পর্শে আসে। সেই সময়ে,
সম্ভবত আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণেই,
নদীমাতৃক সিন্ধু-সভ্যতার অবক্ষয়ের সূচনা হয়েছিল। ফলে, এই নবাগত জনগোষ্ঠী, সিন্ধু-সভ্যতার মানুষদের
সঙ্গে মিশে, ক্রমশ পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। লক্ষ করা যাক, ‘ইনভেশন’ হোক,
বা ‘মাইগ্রেশন’, এই সমস্ত তত্ত্বই,
প্রোটো-ইন্দো-ইয়োরোপীয়দের আদি-বাসভূমি হিসেবে,
ভারতের বাইরের কোনো জায়গাকে চিহ্নিত করছে। সেই কারণে, ভারতের সাপেক্ষে,
এই তত্ত্বগুলিকে সাধারণভাবে Aryan Immigration Theory (সংক্ষেপে, AIT) বলা যেতে পারে, অন্তত লেখক তেমনই বলেছেন। ১৯৯০-এর পর থেকে,
মূলত ভারতে, আরেকদল তাত্ত্বিকের উদ্ভব ঘটল,
যাঁরা দেখাতে চাইলেন প্রোটো-ইন্দো-ইয়োরোপীয়দের আদি বাসভূমি ছিল ভারতীয়
উপমহাদেশ, এবং এই উপমহাদেশ থেকেই
তারা ধীরে ধীরে ইয়োরোপ ও এশিয়ার অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল। এঁরা বললেন, পূর্বপ্রচলিত সমস্ত তত্ত্বই আসলে পশ্চিমি
পণ্ডিতদের ইয়োরোপ-কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গীর ফসল। এঁদের প্রস্তাবিত তত্ত্বটিকে Out of India (সংক্ষেপে, OIT)
মডেল বলা হয়ে থাকে।
এ-পর্যন্ত গোটা আলোচনাটিকে ধান ভানতে শিবের গীত বলে মনে হলেও, ‘আর্যতর্ক’
বইটির আলোচনায় এই ভূমিকাটুকুর প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে, বিশেষত এ-বিষয়ে অনভিজ্ঞ নবীন পাঠকের ক্ষেত্রে।
কেননা, আলোচ্য বইটিতে লেখক, এই সমস্ত তত্ত্বকেই খারিজ করে, সম্পূর্ণ ভিন্নধারার কোনো সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিতে
সচেষ্ট হয়েছেন। লেখকের বক্তব্যের সার কতকটা এইরকম—১) প্রোটো-ইন্দো-ইয়োরোপীয়রা
বাইরে থেকে ভারতে এসেছিল বা ভারত থেকে বাইরে গিয়েছিল,
এই দুই মতবাদের কোনোটাই সঠিক নয়,
২) সংস্কৃত ভাষা আদতে সিন্ধু-সভ্যতার ভাষা,
৩) একটি মূল-ভাষা থেকে বিভিন্ন অপত্য ভাষার জন্ম হয়, তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের এই মূল দাবিটি অসার; একাধিক ভাষা দীর্ঘদিন ধরে একে অপরের সংস্পর্শে
আসার ফলে, একটি ভাষার শব্দ বা বাক্যগঠনের রীতি অন্যভাষাকে প্রভাবিত করতে পারে, বা
নতুন ভাষার উদ্ভব হতে পারে, ৪)
পূর্বে সিন্ধু-সভ্যতা থেকে শুরু করে, পশ্চিমে ক্যাস্পিয়ান সাগর অবধি বিস্তৃত
অঞ্চলে ভিন্ন-ভিন্ন ভাষাভাষী-গোষ্ঠী বসবাস করত; কয়েক-হাজার বছর ধরে, তাদের
পারস্পরিক আদান-প্রদানের ফলে, তাদের
ভাষাগুলিও একে-অপরের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়;
আজ ইন্দো-ইয়োরোপীয় গোষ্ঠীর ভাষাগুলির মধ্যে যে-মিল আমরা প্রত্যক্ষ করি, তা আসলে সেই গভীর আন্তঃক্রিয়ার ফল।
সন্দেহ নেই, লেখকের
উদ্দেশ্য মহৎ, এবং প্রশংসার্হ। মনে রাখতে
হবে, প্রচলিত মতবাদগুলির
কোনোটিই সম্পূর্ণ ত্রুটিহীন নয়, এবং
প্রতিটি মতবাদেরই নিজস্ব কিছু সীমাবদ্ধতা ও ফাঁকফোকর আছে। ফলে, একটি নতুন বিকল্প তত্ত্বের সম্ভাবনায়, আগ্রহী পাঠক-মাত্রেই উৎসাহী হবেন, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হল, লেখক কি তাঁর দাবির প্রতি যথাযথ সুবিচার করতে
পেরেছেন?
অভিবাসন-তত্ত্বের সমালোচনার পদ্ধতি, উদ্দেশ্য ইত্যাদি
আমি যদি কোনো তত্ত্বকে খারিজ করতে চাই, তাহলে আমার উচিত, সেই তত্ত্বের
মূল প্রতিপাদ্যগুলিকে খতিয়ে দেখে, যথাযথ প্রতিযুক্তির মাধ্যমে তাদের অসারত্ব
প্রতিপাদন করা। যেহেতু আলোচ্য বইতে, লেখক শ্রীসুজিত ঘোষ, AIT
ও OIT দুটি তত্ত্বকেই নাকচ করতে
উদ্যোগী হয়েছেন, ফলে আশা করা গিয়েছিল, এই দুই তত্ত্বের যাবতীয় ত্রুটিবিচ্যুতি তিনি
পাঠকের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবেন। অথচ কার্যক্ষেত্রে, তেমনটা ঘটল না। গোটা
বইজুড়ে, AIT-র প্রতিপাদ্যগুলিকে তিনি OIT-সমর্থকদের প্রস্তাবিত যুক্তি দিয়ে খন্ডন করলেন
বটে, কিন্তু তার উল্টোটা কদাচ
নজরে পড়ল না। বরং,
ভাষাতত্ত্ব নিয়ে লেখকের আলোচনা পড়তে গিয়ে,
প্রায়শই মনে হল, লেখক
যেন সত্যস্বরূপ মিশ্র বা শ্রীকান্ত তালাগেরি-র মতো OIT-সমর্থকদের মতকে সন্দেহাতীত সত্য বলেই মেনে নিয়েছেন; এই মতগুলিও যে নিছক
‘মত’ বা ‘হাইপথেসিস’-মাত্র, যার
খণ্ডন সম্ভব, সে-ব্যাপারে কোথাও আলোকপাত
করেননি।
একটা উদাহরণ দিই। ঋগবেদে উল্লেখিত নদী ও স্থাননাম প্রসঙ্গে আলোচনা করতে
গিয়ে (যার মাধ্যমে OIT-সমর্থকরা
প্রমাণ করতে চান, ঋগবেদের রচয়িতারা ভারতের পশ্চিম থেকে পূর্বে নয়, বরং পূর্ব থেকে
পশ্চিমের দিকে যাত্রা করেছিলেন), ঋগবেদের
মণ্ডলগুলির যে-কালক্রম তিনি অনুসরণ করেছেন,
তা একান্তভাবেই তালাগেরি-র নিজস্ব মত। তালাগেরির দাবি, ২ থেকে ৭ নং মণ্ডলগুলির মধ্যে (যেগুলিকে ‘ফ্যামিলি
বুক’ বলা হয়, এবং যেগুলি ঋগবেদের
প্রাচীনতম অংশ বলে সমস্ত গবেষকরাই অনুমান করেন),
৬, ৩ এবং ৭ অধিক প্রাচীনতর। প্রাচীন মণ্ডলগুলির মধ্যে
এইভাবে ‘অপেক্ষাকৃত প্রাচীনতর’ মণ্ডল খোঁজার প্রচেষ্টা যে খুব একটা ফলপ্রসূ
না-ও হতে পারে, সে-বিষয়ে ঋগবেদ-বিশেষজ্ঞরা
বারবার আমাদের সাবধান করে দিয়েছেন। কেননা,
একই মণ্ডলে সংকলিত শ্লোকগুলির মধ্যেও, অনেকক্ষেত্রেই,
বিস্তর কালিক ব্যবধান লক্ষ করা যায়। ২ থেকে ৭ সামগ্রিকভাবে প্রাচীন হলেও,
বাকি মণ্ডলগুলির (১, ৮, ৯, ১০)
কিছু কিছু শ্লোকও যে এই প্রাচীন মণ্ডলগুলির সমসাময়িক বলে ধরা যেতে পারে, সে-কথাও স্মরণ রাখা উচিত। কিন্তু লেখক এই বইতে
এমনভাবে তালাগেরি-র মতকে উপস্থাপন করেছেন,
যেন তা শুধু তালাগেরি-র মত নয়,
বরং ঋগবেদ-চর্চার ক্ষেত্রে তা-ই সর্বজনমান্য কালক্রম। এ-বিষয়ে
বিস্তারিত আলোচনার জন্যে, এডুইন
ব্রায়ান্টের "The Quest for the Origins of Vedic
Culture" বইয়ের ৬৫-৬৭ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য। এই বইটির কথা লেখক
মাঝেমধ্যে উল্লেখ করেছেন বটে, কিন্তু
তা মূলত AIT-র বিরুদ্ধ প্রমাণ সরবরাহ
করার ক্ষেত্রেই।
আমি নিজে ভাষাতাত্ত্বিক নই, প্রত্নতত্ত্ববিদও নই। এমনকী, ইতিহাসের ছাত্রও নই। এমতাবস্থায়,
আমাকে নির্ভর করতে হয় এমন লেখকদের ওপর,
যাঁরা এ-ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ বলে স্বীকৃত এবং মান্য। 'বিগ
ব্যাং' তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা জানতে
গেলে, সেইজন্যেই, আমি ভরসা করি কোনো স্বীকৃত জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী, যেমন নারলিকর,
ফ্রেড হয়েল প্রমুখের লেখাপত্রের ওপর। এ-ব্যাপারে, আমেরিকার কোনো ধর্মযাজকের বক্তব্য আমি গ্রহণ করতে
নারাজ।
ঠিক একইভাবে, যখন আমি ইন্দো-ইয়োরোপীয় অভিবাসন তত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করি, তখন লক্ষ করি, এই তত্ত্বের প্রবক্তাদের মধ্যে
রয়েছেন একাধিক প্রখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক—মারিয়া গিমবুতাস, জে পি ম্যালরি, ডেভিড অ্যান্থনি,
কলিন রেনফ্রিউ, মারিয়া
ইভানোভা, ভিক্তর সারিয়ানিদি, কুজমিনা,
সান্দর বোকোনি এবং আরো অনেকে; রয়েছেন প্রথমসারির ভাষাতাত্ত্বিক—ইয়ানোস হারমাত্তা, হান্স হেনরিখ হক,
কোলম্যান, লেভিট; আছেন ভারততত্ত্ববিদ আসকো পারপোলা, এডুইন ব্রায়ান্ট,
মাইকেল উইটজেল, এফ
বি জে কুইপার, থমাস বারো প্রমুখ। আন্তর্জাতিক
স্তরে, এঁরা প্রত্যেকেই নিজ-নিজ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এঁরা সকলেই
যে ধ্রুপদী আর্য-আক্রমণ তত্ত্বকে নির্বিশেষে সমর্থন করছেন,
এমন নয়। বরং প্রত্যেকেই একে অপরের মতকে খন্ডন করছেন, এবং প্রোটো-ইন্দো-ইয়োরোপীয়দের বাসভূমি নিয়ে
একেকরকম মত পোষণ করছেন। বস্তুত, শুধুমাত্র এঁদের লেখাপত্রগুলি মন দিয়ে পড়লেও, প্রচলিত
মতগুলির সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে একটা ধারণা করে নেওয়া সম্ভব।
উল্টোদিকে, OIT-তত্ত্বের
সমর্থক হিসেবে যাঁদের কথা লেখক উল্লেখ করেছেন, তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই শখের গবেষক,
এবং এ-বিষয়ে তাঁদের যোগ্যতা ও উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে বলেই
আমার মনে হয়। কোয়েনরাড
এলস্ট এবং ডেভিড ফ্রলি-র কথাই ধরা যাক। সেই কোয়েনরাড এলস্ট, যাঁর বই প্রকাশ করে একটি বিশেষ হিন্দুত্ববাদী
রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় পুষ্ট প্রকাশন-সংস্থা Voice
of India, যিনি ১৯৯১ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর ‘Ayodhya and After’ প্রবন্ধে লেখেন, ‘সময় এসেছে ভারতীয় মুসলমানদের নিজেদের
পূর্বপুরুষের সংস্কৃতিতে ফিরে আসার, যা
থেকে তারা এতদিন বিচ্ছিন্ন ছিল’, বা
বাবরি মসজিদের ঘটনাকে যিনি ‘It is thus an exercise
in national integration’ বলে চিহ্নিত করেন, OIT-বিষয়ে তাঁর যাবতীয় মতামতের পেছনে যে একটি গভীর রাজনৈতিক
উদ্দেশ্য থাকবে, তা অনুমান করা দুঃসাধ্য নয়, অযৌক্তিকও নয়। একই কথা ডেভিড ফ্রলি-র সম্বন্ধেও
খাটে। ইনি একজন স্বঘোষিত হিন্দু-গুরু, বেদাচার্য, বৈদ্য
ও জ্যোতিষী! এনার আদৌ কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা আছে কি না,
তা নিয়েও আমি নিশ্চিত নই। যদিও,
২০১৫ সালে, বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার এনাকে পদ্মভূষণ পুরস্কারে বিভূষিত করেছেন!
এই দুজন মহারথী ছাড়া, আর যেসব তাত্ত্বিকের মতামত লেখক এই বইতে উদ্ধার
করেছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন শ্রীকান্ত তালাগেরি, মিশেল দানিনো, সুভাষ কাক, বি এন
এন আচার, সত্যস্বরূপ মিশ্র এবং নিকোলাস কাজানাস। আসুন, এঁদের সম্বন্ধে কিছু তথ্য
জেনে নেওয়া যাক।
শ্রীকান্ত তালাগেরি সম্বন্ধে ব্রায়ান্ট তাঁর বইতে লিখেছেন—“At the time of my research, Shrikant Talageri was a bank clerk in
Bombay actively involved with Hindu nationalist groups. The first part of his
book Aryan Invasion and Indian Nationalism (1993), explicitly promotes Hindu nationalistic themes (which he considers
to be synonymous with Indian nationalism). The remainder of the book reveals a
very keen mind examining the basis of the whole Aryan invasion theory (this
part of the book is at its most vulnerable, I should note, when he attempts to
promote Maharashtra as the homeland)." এনার
সম্পর্কে আর বেশি কিছু বলার প্রয়োজন আছে কি?
মিশেল দানিনো এবং আর্যতত্ত্বের দুনিয়ায় তাঁর ধূমকেতুসম আবির্ভাব আরেক
রহস্যময় ব্যাপার। ইলেক্ট্রিকাল এঞ্জিনিয়ারিং-এর স্নাতক হঠাৎ কী করে আর্কিওলজিস্ট
তকমা পেয়ে যান, এবং আই আই টি গান্ধীনগরে
আর্কিওলজি বিভাগ প্রতিষ্ঠার জন্যে তাঁকে ডেকে আনা হয়,
সে-রহস্য আমি কিছুতেই বুঝতে পারিনি। আমার বন্ধু, আই আই টি গান্ধীনগরের অধ্যাপক, আমাকে কিছু কথা জানিয়েছে,
তবে তা এখানে বলার প্রয়োজন দেখি না। ভারতীয় আকাদেমিয়ার হাঁড়ির হাল ও
রাজনীতির গতিপ্রকৃতি, আমরা
সবাই কমবেশি জানি। আর্কিওলজি, ভাষাতত্ত্ব,
ইতিহাস, কোনো
কিছুতেই দানিনো-র কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না-থাকলেও,
AIT-কে খণ্ডন করতে গিয়ে সুজিতবাবুকে যে তাঁরই
শরণাপন্ন হতে হল, এ
ভারি হতাশাব্যঞ্জক ঘটনা।
বইয়ের গোড়ার দিকে, সুভাষ
কাকের প্রসঙ্গে লেখক লিখেছেন, “প্রখ্যাত
আর্কিওলজিস্ট সুভাষ কাক”, যা
পড়ে আমি বাস্তবিকই হতবাক! সুভাষ কাক একজন মার্কিন-প্রবাসী কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ। অবসর সময়ে, বা মৌকা বুঝে,
আর্কিওলজি নিয়ে শখের গবেষণা করে থাকেন। আর সেই গবেষণা, এ-দেশের একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের মুখপাত্ররা,
শতকন্ঠে, নিজেদের পত্রপত্রিকায় বা ওয়েবসাইটে প্রচার করেন। মেমফিস
বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক বি এন নরহরি আচার সম্পর্কেও একই কথা।
বরং, এঁদের তুলনায়, সত্যস্বরূপ মিশ্র এবং নিকোলাস কাজানাসকে নিজ-নিজ
ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ বলা যেতে পারে। ডক্টর মিশ্র বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে
ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক ছিলেন। ৭০-এর দশকে তিনি আর্য-আক্রমণ তত্ত্বকে সমর্থন করলেও,
৯০-এর দশকে এসে আচমকা ‘আউট
অফ ইন্ডিয়া’ তত্ত্বের পক্ষে সওয়াল শুরু
করেন। কাজানাস একজন ইন্ডোলজিস্ট। তিনি অবশ্য বহিরাগত আর্যতত্ত্বকে পুরোপুরি খারিজ
করেননি, শুধু বলেছেন, ভারতবর্ষে এরকম কোনো অভিবাসন ঘটে থাকলে তা ২০০০ বিসিই নয়,
বরং ৫০০০ বিসিই-র পূর্বে ঘটতে পারে।
আগেই বলেছি, AIT এবং OIT-র
তুলনামূলক আলোচনার ক্ষেত্রে, এডুইন ব্রায়ান্টের “The
Quest for the Origins of Vedic Culture” বইটি অপরিহার্য। এখানে তিনি, ধরে ধরে,
দুটি তত্ত্বেরই যুক্তিকাঠামোর ফাঁকগুলোকে তুলে ধরেছেন। এবং এই আলোচনার
প্রসঙ্গে, তিনি বলেছেন, “Indian scholars, for
the most part, simply do not have the training to embark on a scholarly
critique or evaluation of the vast specialized field of Indo-European studies.
For the most part, with some exceptions, Indigenists wishing to tackle the
Indo-Aryan issue are left with the option of either ignoring the linguistic
dimension of the problem or attempting to tackle it with sometimes hopelessly
inadequate qualifications.” (পৃষ্ঠা ৭৫)
বলে রাখা ভালো, গবেষণা করার জন্যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যে অপরিহার্য,
এমন কথা আমি বলতে চাই না। তথাপি, প্রথাগতভাবে শিক্ষিত প্রত্নতাত্ত্বিক ও ভারততত্ত্ববিদরা
কেন OIT-র প্রতিপাদ্যগুলিকে মনোযোগ
দিয়ে খতিয়ে দেখছেন না, কেনই বা এ-সংক্রান্ত যেকোনো আলোচনায়, শৌখিন হিন্দুত্ববাদী
গবেষকদের এমন নিরঙ্কুশ সংখ্যাধিক্য—এসব প্রশ্ন, পাঠকের মনে জাগা অস্বাভাবিক নয়। হয়তো এর উত্তরে, সুজিতবাবু সংশ্লিষ্ট পণ্ডিতদের একদেশদর্শিতা, ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গী,
খ্রীষ্টধর্মের প্রতি আনুগত্য ইত্যাদি প্রসঙ্গ উত্থাপন করবেন। কিন্তু, AIT নিয়ে যাঁরা কাজ করেছেন,
সেই বিপুলসংখ্যক গবেষকদের প্রত্যেকেই এমন একদেশদর্শিতার শিকার, এ-কথা মানা কঠিন। কেননা, এঁদের মধ্যে বামপন্থী, ডানপন্থী,
নারীবাদী, নিরীশ্বরবাদী, ভক্তিবাদী সকলেই আছেন। এঁরা সকলেই, কোনো এক রহস্যময় ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে, একটি ‘অবান্তর’
মতকে একাদিক্রমে আঁকড়ে ধরে আছেন, এমনটা
সহজ বুদ্ধিতে মানা যায় কি?
উল্টোদিকে, OIT-র সমর্থকরা, যাঁরা প্রায় সকলেই একটি বিশেষ রাজনৈতিক মতবাদের
প্রতি সহানুভূতিশীল, কোনো
কায়েমি স্বার্থ ছাড়াই সত্যের পক্ষে লড়ে যাচ্ছেন,
এ-কথা মেনে নেওয়া আরোই দুঃসাধ্য। বইটি পড়তে গিয়ে, আমার বারবারই মনে
হয়েছে, AIT-কে খন্ডন করতে গিয়ে OIT তত্ত্বের ওপর মাত্রাধিক নির্ভরতা, এবং OIT-র সম্ভাব্য বিচ্যুতির ব্যাপারে তাঁর নীরবতা,
লেখকের নিরপেক্ষ অবস্থানটিকে প্রশ্নচিহ্নের মুখে ফেলেছে।
বিকল্প ভাষাতাত্ত্বিক কাঠামো
AIT-কে OIT দিয়ে খন্ডন করার যে-পন্থা লেখক নিয়েছেন, সে-ব্যাপারে আগের অংশে বলেছি। উল্লেখ করেছি এডুইন
ব্রায়ান্টের বইটির কথাও, যা
AIT এবং OIT উভয়পক্ষের দাবিকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়। ফলে, যুক্তি ও প্রতিযুক্তির মধ্যে ঢোকার কোনো অভিলাষ
নেই আমার। আমি বরং, আলোচ্য
বইয়ের উপসংহারে লিপিবদ্ধ সিদ্ধান্তগুলিকে একটু খতিয়ে দেখব।
গোড়াতেই বলেছি, লেখক
ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্বের ট্রি-মডেলটির (যাকে ক্ল্যাডিস্টিক মডেলও বলা হয়) বিষয়ে সন্দিহান। তিনি বলেছেন, ট্রি-মডেলটি বাইবল-বর্ণিত টাওয়ার অফ বাবেলের সম্প্রসারণ
ছাড়া কিছু নয়, এবং ইন্দো-ইয়োরোপীয়
ভাষাগুলির ক্ষেত্রে এর খুব একটা গ্রহণযোগ্যতা নেই। লেখকের মতে, ভারতের
উত্তর-পশ্চিম সীমা থেকে শুরু করে পূর্ব ইয়োরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে গড়ে-ওঠা ছোট-বড়
সভ্যতাগুলির মধ্যে দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সংযোগ ও পারস্পরিক আদান-প্রদানের ফলে, এই সব
অঞ্চলের স্থানীয় ভাষাগুলি একে অন্যকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে, এবং ক্ষেত্রবিশেষে,
পরস্পরের সঙ্গে মিশে গিয়ে নানান মিশ্রভাষার জন্ম দিয়েছে,
যেগুলিকে পরে আমরা ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত বলে ধরে
নিচ্ছি। এই প্রক্রিয়াটিকে লেখক ‘ডিফিউশন’ বলে চিহ্নিত করেছেন।
ভাষাতত্ত্বের দিক থেকে, এমন একটি সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। একটি
অঞ্চলে যখন একাধিক ভাষাভাষীগোষ্ঠী পাশাপাশি বসবাস করে, তখন তাদের ঘনিষ্ঠ পারস্পরিক
সংযোগের ছাপ পড়ে সেই ভাষাগুলির ওপরেও। একটি ভাষার শব্দ ঢুকে যায় অন্যভাষায়;
বাক্যগঠনের নিয়ম, ব্যাকরণের ধাঁচাও একইরকম হয়ে দাঁড়ায়। ভাষাতত্ত্বের পরিভাষায় একে
বলে ‘Sprachbund’। ভারতীয় উপমহাদেশ এবং পূর্ব
ইয়োরোপের বলকান অঞ্চল এইরকম ভাষামিশ্রণের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আবার, দুটি ভাষা দীর্ঘ
সময় ধরে একে-অপরের সংস্পর্শে থাকতে থাকতে, যখন একটি তৃতীয় সংকর ভাষার জন্ম দেয়, তখন ভাষাতত্ত্বের পরিভাষায় তাকে Contact Language বলা হয়। বর্তমান পৃথিবীতে, এর সবচেয়ে
ভালো উদাহরণ Creole, যে-কারণে এই
প্রক্রিয়াকে Creolisation-ও
বলা হয়। ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর পারস্পরিক সাদৃশ্যকে Sprachbund
ও Creolisation দিয়ে
ব্যাখ্যার প্রচেষ্টা নতুন নয়। এ-প্রসঙ্গে, নিকোলাই ত্রুবেৎস্কয় বা রোমান
ইয়াকোবসনের প্রামাণ্য কাজ রয়েছে।
বলে রাখা ভালো, গতশতকের দ্বিতীয়ভাগে,
পোস্টট্রাকচারালিস্ট ও পোস্টমডার্ন তত্ত্বের বাড়বাড়ন্ত-হেতু, ভাষা-পরিবর্তনের সরলরৈখিক (linear) ও উল্লম্ব (vertical)
মডেলটি নিয়ে নানান সমালোচনা শুরু হয়। অনেক ভাষাতত্ত্ববিদ প্রমাণ করতে
চান যে, ভাষা আসলে উল্লম্ব নয়, বরং অনুভূমিক দিকে পরিবর্তিত ও প্রসারিত হয়।
অর্থাৎ ভাষার বিবর্তন একটি ভাষা থেকে তার অপত্য ভাষার দিকে নয়, বরং অনেকগুলি ভাষার পারস্পরিক সহাবস্থান ও
আন্তঃক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটে থাকে। এ-নিয়ে, এ-যাবৎ কাজ কিছু কম হয়নি। সেসব গবেষণা থেকে দেখা
গেছে, কিছু কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে, বিশেষ আর্থ-সামাজিক প্রতিবেশে এ-ধরণের মিশ্রভাষার
উদ্ভব ও বিকাশ সম্ভব। কিন্তু সাধারণভাবে, একেই
ভাষা-বিবর্তনের মডেল হিসেবে মেনে নেওয়ার সমস্যা রয়েছে। এই কারণেই, ভাষাতত্ত্বের
ক্ল্যাডিস্টিক মডেলটি অদ্যাবধি বহাল রয়েছে, বাতিল হয়ে যায়নি। আর শুধু
ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষাতেই নয়, পৃথিবীর
সমস্ত ভাষা-পরিবারের ক্ষেত্রেই এই মডেলটি বেশ সফলভাবে ব্যবহৃত।
এখন, ইন্দো-ইয়োরোপীয়ান গোষ্ঠীর ভাষাগুলিকে যদি Sprachbund হিসেবে কল্পনা করতে হয়, তাহলে দুটো
সম্ভাবনা রয়েছে। এক, বিভিন্ন ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষাভাষী গোষ্ঠী অতীতে একই ভৌগোলিক
অঞ্চলে বসবাস করত, যার ফলে, পারস্পরিক নৈকট্যহেতু, তাদের ভাষাগুলি একে অপরের
দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল (সুমেরীয় ও আক্কাদীয় ভাষা এমন Sprachbund-এর আদর্শ উদাহরণ)। দুই, বিভিন্ন ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষাভাষী গোষ্ঠীর
মধ্যে, ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও, এক ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল, সম্ভবত বাণিজ্যিক
বা অন্যান্য সাংস্কৃতিক লেনদেনের সুবাদে, যার প্রভাব পড়ে তাদের ভাষায়।
প্রথম সম্ভাবনাটি মেনে নিতে হলে, অভিবাসন-তত্ত্বও মেনে নিতে হয়। নইলে,
ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষাগুলি, একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চল থেকে শুরু করে, কীভাবে বর্তমান
ইয়োরোপ ও এশিয়ার এই সুবিস্তীর্ণ ভূখণ্ড-জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল, তার সন্তোষজনক ব্যাখ্যা
দেওয়া সম্ভব নয়। দ্বিতীয় সম্ভাবনাটি, এ-পর্যন্ত প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের
সাপেক্ষে কতদূর গ্রহণযোগ্য, এই আলোচনার পরবর্তী অংশে আমরা তা খতিয়ে দেখার চেষ্টা
করব।
ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষাগুলির উদ্ভবের আরেকটি বিকল্প রাস্তা আছে, যেটা কোনোদিকে কোনোরকম অভিবাসন বা ডিফিউশনের কথা
বলে না। কে ডি সেঠনা এবং প্রত্নতাত্ত্বিক কেনোয়ার এই তত্ত্বের সমর্থক। এঁরা বলেন, ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমা থেকে শুরু করে পশ্চিমে
ক্যাস্পিয়ান সাগর অবধি একটি বিস্তৃত অঞ্চলে বসবাসকারী বিভিন্ন জনগোষ্ঠী সম্ভবত একই
ভাষার বিভিন্ন ডায়ালেক্টে কথা বলত। সেই ডায়ালেক্টগুলো পরে আলাদা-আলাদা ভাষার রূপ
নিয়েছে। এই তত্ত্বেরও কিছু ভাষাতাত্ত্বিক সীমাবদ্ধতা আছে। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার
উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাসে, এত বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে,
কয়েক হাজার বছর ধরে একটিই ভাষা চালু থাকার কোনো নজির নেই।
ফলে, লেখক প্রস্তাবিত তত্ত্বটি
যে আনকোরা নতুন, এমন নয়। আবার, ভিন্ন কোনো বিকল্পের সন্ধানে ভাষাতাত্ত্বিকরা আদৌ
উৎসাহী নন, তাঁদের একদেশদর্শিতার
কারণে, লেখকের এমন আশঙ্কাও অমূলক।
এ-বিষয়ে গবেষণা সুপ্রচুর, কিন্তু
প্রচলিত মডেলটিকে খারিজ করার মতো কোনো সঙ্গত প্রতিযুক্তি এখনও পর্যন্ত পাওয়া
যায়নি। যা পাওয়া গেছে, তা
তুলনামূলকভাবে বেশ দুর্বল।
ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষাগুলির উৎপত্তির কালক্রম
তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের ফাইলোজেনেটিক ট্রি অনুযায়ী, ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত বিভিন্ন
শাখার স্বতন্ত্ররূপে উৎপত্তির, বা
প্রোটো-ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষার কাণ্ডটি থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন হবার, প্রচলিত সময়সারণীটি এইরকম—
·
আনাতোলিয়ান - ৪০০০ বিসিই
·
টোকারিয়ান - ৩৫০০ বিসিই
·
গ্রীক, প্রি-কেল্টিক,
প্রি-ইতালিক, প্রি-জার্মানিক
- ৩২৫০-৩০০০ বিসিই
·
প্রোটো-ইন্দো-ইরানিয়ান -
২২৫০ বিসিই
গোটা বইতে, একমাত্র সংস্কৃত ছাড়া (যা ইন্দো-ইরানিয়ান শাখাটির অন্তর্গত,
এবং প্রচলিত মত অনুযায়ী যার উৎপত্তি ২০০০ বিসিই নাগাদ), অন্য ভাষাগুলির উৎপত্তি
সম্পর্কে লেখক সম্পূর্ণ নীরব। সংস্কৃত ভাষার উৎপত্তি প্রসঙ্গে, OIT-সমর্থকদের যুক্তিক্রম অনুসরণ করে, তিনি
জানিয়েছেন, সম্ভবত ৪০০০ বিসিই নাগাদ সংস্কৃত ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন ঋগবেদ লিখিত
হয়েছিল, ফলে সংস্কৃতভাষার উৎপত্তি ৫০০০ বিসিই হলেও অবাক হবার কিছু নেই। তিনি আরো বলেছেন,
সিন্ধুসভ্যতার অধিবাসীরা সম্ভবত সংস্কৃত-ভাষাভাষী ছিল, এবং ঋগবেদ রচিত হয়েছিল
বর্তমান আফগানিস্তানের মেহেরগড় অঞ্চলে, যেখানে সিন্ধুসভ্যতার একেবারে আদিপর্বের
নিদর্শনগুলি পাওয়া গেছে। এখন, যদি এই দাবি সত্যি হয়, তাহলে বাকি ইন্দো-ইয়োরোপীয়
ভাষাগুলির জন্য কি কোনো বিকল্প সময়পঞ্জী ভাবতে হবে? লেখক এ ব্যাপারে পূর্ণত নীরব।
আমরা ধরে নিচ্ছি, বাকি ভাষাগুলির ক্ষেত্রে প্রচলিত কালক্রম মেনে নিতে লেখকের
অসুবিধা নেই।
ভাষাবিস্তারের বিকল্প পথ : প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ
তর্কের খাতিরে মেনে নেওয়া যাক,
ভাষাতত্ত্বের ক্ল্যাডিস্টিক মডেলটি ভ্রান্ত,
বরং Sprachbund বা
কনট্যাক্ট ল্যাঙ্গোয়েজের ধারণাটিই ঠিক। এ-ও মেনে নেওয়া যাক যে, সিন্ধুসভ্যতার ভাষা ছিল সংস্কৃত বা
ইন্দো-ইয়োরোপীয়ান (যদিও, আমরা
সবাই জানি, এবং লেখকও জানেন, সিন্ধু-সভ্যতার ভাষা দ্রাবিড় না সংস্কৃত, তা বহুচর্চিত ও বহুবিতর্কিত একটি বিষয়, যার আজও কোনো সুরাহা হয়নি)।
যাই হোক, আপাতত
আমরা দেখতে চাইব,
প্রত্নতাত্ত্বিক দিক থেকে লেখকের প্রস্তাবিত বিকল্প সম্ভাবনাটি কতদূর গ্রহণযোগ্য। বলে
রাখা ভালো, একটি বিলুপ্ত সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে সেই সভ্যতার
ভাষাতাত্ত্বিক পরিচয় নির্ধারণের কাজটি প্রায়শই দুরূহ, ক্ষেত্রবিশেষে অসম্ভব,
বিশেষত যদি কোনো লিখিত নিদর্শন পাওয়া না যায়। প্রোটো-ইন্দো-ইয়োরোপীয়ান ভাষা ও
জনগোষ্ঠীর উৎস-সন্ধানের ক্ষেত্রে, এইটাই সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। আর, এই প্রতিবন্ধকতার
কারণেই, প্রত্নতাত্ত্বিক ও ভাষাতাত্ত্বিকরা, আজ অবধি, এ-বিষয়ে কোনো সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে
পৌঁছতে পারেননি।
কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, AIT-সমর্থকরা, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও ভাষাতাত্ত্বিক সিদ্ধান্তগুলিকে
একসূত্রে গাঁথার চেষ্টায় কোনোরকম কসুর করেছেন। সুজিতবাবুর মন্তব্য থেকে মনে হতে
পারে, AIT-র সপক্ষে
প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ বুঝি খুবই নগণ্য। অথচ,
যাঁরা এ-বিষয়ে অল্পবিস্তর পড়াশোনা করেছেন,
তাঁরা জানেন, কথাটি
সর্বাংশে সঠিক নয়।
বরং, AIT-তাত্ত্বিকরা প্রত্যেকেই
নিজের মতের সপক্ষে বিস্তারিত প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ ও সাক্ষ্য পেশ করেছেন। গত ৩০-৪০ বছর ধরে, এ-বিষয়ে
যে বিপুল পরিমাণ কাজ হয়েছে, তার
বিশদ বিবরণ নথিবদ্ধ আছে ম্যালরি-র ‘In Search of
Indo-Europeans: Language, Archaeology and Myth’ (Thames & Hudson, 1989) এবং প্রত্নতাত্ত্বিক ও নৃতত্ত্ববিদ ডেভিড ডব্লিউ অ্যান্থনি-র ‘The Horse, the Wheel, and Language: How Bronze-Age Riders from the
Eurasian Steppes Shaped the Modern World’ (Princeton University Press, 2007) বইতে। এই দুটি বই, বিশেষত দ্বিতীয় বইটি, এ-বিষয়ে আগ্রহী যেকোনো
পাঠকের অবশ্যপাঠ্য। ৯০-দশকে সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের অব্যবহিত পরে, স্তেপ আর্কিওলজি
নিয়ে রাশিয়ান প্রত্নতাত্ত্বিকদের (যেমন, দানোভিচ, জেনিং, কুজমিনা,
গ্রিগরিয়েভ প্রমুখ) দীর্ঘদিনের শ্রমসাধ্য গবেষণা যখন ইয়োরোপীয় ও
মার্কিন গবেষকদের নজরে আসে, তখন AIT তত্ত্বে যে নতুন বাঁকগুলি চিহ্নিত হয়,
তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে এই বইতে। রয়েছে বিভিন্ন সাইটে পাওয়া
মেটিরিয়াল কালচার (মৃৎপাত্র, গয়না, অস্ত্রশস্ত্র ইত্যাদি) নিয়ে দীর্ঘ, বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ। এই বইটির উল্লেখ (এবং
ম্যালরি-র বইটিরও) আলোচ্য গ্রন্থের বিবলিওগ্রাফিতে না-পাওয়ায় এমন অনুমান করি যে, তা লেখকের গোচরে আসেনি। ম্যালরি এবং অ্যান্থনি
প্রত্নতাত্ত্বিক নজিরগুলিকে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, তা অভ্রান্ত, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। কিন্তু, AIT-কে আক্রমণ করতে হলে,
এই নজিরগুলিকে ভ্রান্ত প্রমাণ করা জরুরি। অথচ, আলোচ্য বইটিতে, সামান্য দায়সারা উল্লেখ ছাড়া, এমন
কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ল না। বস্তুত, গোটা
বইতে প্রত্নতাত্ত্বিক আলোচনার অভাব, বিশেষ
করে পন্টিক-ক্যাস্পিয়ান স্তেপের সভ্যতার অবশেষগুলি নিয়ে বিশদ আলোচনা ও মতখণ্ডনের
অনুপস্থিতি, অত্যন্ত বেদনাদায়ক। হতে পারে, এর একটি সম্ভাব্য কারণ এই যে, OIT-র তথাকথিক ‘স্কলার’-রা কেউই প্রত্নতাত্ত্বিক নন;
ফলে, প্রত্নতাত্ত্বিক আলোচনাকে
সযত্নে এড়িয়ে যাওয়াকেই তাঁরা শ্রেয় বলে মনে করেছেন। যেহেতু AIT-কে খারিজ করতে লেখক একান্তভাবেই OIT-র সমর্থকদের লেখাপত্রের ওপর নির্ভরশীল, তাই তিনিও এই বইয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক আলোচনাটিকে
যথেষ্ট সারবান করে তুলতে পারেননি। ৫০০-র অধিক পৃষ্ঠা-সম্বলিত এই বইয়ের মাত্রই ৩-৪
পৃষ্ঠা বরাদ্দ হয়েছে প্রত্নতাত্ত্বিক আলোচনার জন্যে।
হ্যাঁ, সিন্ধু-সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নিয়ে লেখক বেশ খানিকটা
আলোচনা করেছেন বটে, বিশেষত বৈদিক সভ্যতার সঙ্গে তার সম্পর্ক ও পরবর্তীকালের ভারতীয়
সংস্কৃতি ও সভ্যতায় তার চিরস্থায়ী প্রভাব সাব্যস্ত করার তাগিদে। যদিও, সিন্ধুসভ্যতার
ধারাবাহিকতা নিয়ে এই মুহূর্তে ঐতিহাসিকদের মধ্যে খুব বড়সড় কোনো দ্বিমত আছে বলে আমার
মনে হয় না। আগেই বলেছি, বর্তমান AIT-তাত্ত্বিকদের
মতে, ২০০০-১৮০০ বিসিই-র মধ্যে প্রোটো-ইন্দো-ইরানিয়ানরা সিন্ধু সভ্যতার সংস্পর্শে
আসে, এবং তাদের সঙ্গে মিশে গিয়ে, ধীরে ধীরে, ভারতের পূর্ব ও দক্ষিণদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
ফলে, পরবর্তীকালের ভারতীয় সভ্যতায় এর চিরস্থায়ী প্রভাবের কথা অস্বীকার করা যায় না।
যাই হোক, লেখক
তেমন আলোকপাত না-করলেও, আমরা
চেষ্টা করে দেখতে পারি, তাঁর প্রস্তাবিত বিকল্পটির সপক্ষে কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক
প্রমাণ হাজির করা যায় কি না। এর জন্যে, আমরা প্রথমে খতিয়ে দেখব ভারতের
উত্তর-পশ্চিম প্রান্ত থেকে পূর্ব ইয়োরোপের সীমা অবধি বিস্তৃত অঞ্চলে প্রাপ্ত
বিভিন্ন সভ্যতার নিদর্শনগুলি। তারপর, নিজের বিচারবুদ্ধি-মোতাবেক, আমরা ভেবে দেখব, সেই
নিদর্শনগুলি অভিবাসন-তত্ত্বের সপক্ষে সওয়াল করছে, না কি লেখক-প্রস্তাবিত বিকল্প
তত্ত্বটিকে মান্যতা দিচ্ছে।
প্রথমে, পন্টিক-ক্যাস্পিয়ান স্তেপ অঞ্চলে প্রাপ্ত সভ্যতার নিদর্শনগুলি
খতিয়ে দেখা যাক। AIT-তত্ত্বের ক্ষেত্রে এই অঞ্চলের গুরুত্ব অপরিসীম এবং তার সঙ্গত কারণও
রয়েছে। ইউরেশিয়াকে একটি সংযুক্ত ভূখন্ড হিসেবে কল্পনা করলে, পূর্বে মঙ্গোলিয়া থেকে
পশ্চিমে ইউক্রেইন-রুমানিয়া-হাঙ্গেরি অবধি বিস্তৃত এই প্রায়-সমতল তৃণভূমিই সেই
সংযোগের ধারক ও বাহক। ফলে, মারিয়া গিম্বুতাসের কুরগান হাইপথেসিস, কলিন রেনফ্রিউয়ের
আনাতোলিয়ান হাইপথেসিস, বা ম্যালরি-র মডিফায়েড কুরগান হাইপথেসিস—প্রত্যেকটির
ক্ষেত্রেই এই অঞ্চল, ও এখানে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলির গুরুত্ব
অপরিসীম।
সারণী-১:
ইউরেশিয় স্তেপ অঞ্চলে প্রাপ্ত সভ্যতার নিদর্শন
সভ্যতা
|
কালক্রম (বিসিই)
|
ভৌগোলিক অবস্থান
|
বর্ণনা
|
ক্রিস কালচার
|
৫৮০০-৫৩০০
|
কার্পেথিয়ান পর্বতের পূর্বদিকের পাদদেশ, নর্থ-পন্টিক
|
দানিউব উপত্যকার নিওলিথিক কৃষিজীবী মানুষদের
একটি দল কার্পেথিয়ান পেরিয়ে, আরেকটি দল দানিউব বরাবর দক্ষিণদিকে অগ্রসর হয়ে এই
অঞ্চলে আসে ও এই কৃষিসভ্যতার পত্তন করে।
|
বাগ-দ্নীস্তার কালচার
|
৬২০০-৫০০০
|
নর্থ-পন্টিক, বাগ-নীস্তার উপত্যকা
|
সম্ভবত এই অঞ্চলের স্থানীয় মেসোলিথিক কালচার
থেকে এর উদ্ভব। ৫৮০০-৫০০০ অবধি নিওলিথিক পর্যায়।
|
দ্নীপার-দনেৎস কালচার
|
৬২০০-৪২০০
|
বাগ-দ্নীস্তারের পূর্বদিকের পন্টিক-ক্যাস্পিয়ান স্তেপ
|
এর ৩টি পর্যায়—আদি-নিওলিথিক (৬২০০-৫৭০০ বিসিই),
DD-I (৫৭০০-৫৪০০
বিসিই), DD-II (৫২০০-৪২০০
বিসিই)। এরা সম্ভবত একেবারে প্রথম দিককার প্রোটো-ইন্দো-ইয়োরোপীয়ান ভাষাগোষ্ঠী।
|
কুকুতেনি-ত্রিপোলাই
|
৫২০০-৩০০০
|
পূর্ব কার্পেথিয়ান, নর্থ-পন্টিক
|
ক্রিস ও বাগ-দ্নীস্তার সভ্যতার উত্তরসূরী এই
তাম্রযুগের কৃষিভিত্তিক সভ্যতা। সম্ভবত, এদের ভাষা ছিল আফ্রো-এশিয়াটিক। প্রচুর মাতৃকামূর্তি
পাওয়া গেছে এই সভ্যতার অবশেষ থেকে। মারিয়া গিমবুতাস-সহ অনেকের মতে, এটি
মাতৃতান্ত্রিক সভ্যতা ছিল, যদিও এ-মত এখন ততটা স্বীকৃত নয়। প্রাপ্ত মৃৎপাত্র,
অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য নমুনা স্তেপ কালচারগুলির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তবে
৪০০০-৩৫০০ বিসিই-র মধ্যেকার নিদর্শনগুলির ওপর স্তেপ কালচারগুলির প্রভাব থাকতেও
পারে। ৪০০০ বিসিই থেকে এই সভ্যতার অবক্ষয়ের শুরু। ৩৫০০ বিসিই নাগাদ এখানকার
বসতিগুলির আয়তন অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যেতে শুরু করে, সংঘর্ষের পরিমাণ বাড়ে এবং
একটি সার্বিক অবক্ষয়ের চিহ্ন লক্ষ করা যায়।
|
খ্ভালিন্সক কালচার
|
৪৭০০-৩৮০০
|
মধ্য-ভোলগা, পন্টিক-ক্যাস্পিয়ান স্তেপ
|
সম্ভবত প্রোটো-ইন্দো-ইয়োরোপীয়ান ভাষাগোষ্ঠীর
সংস্কৃতি। এখানে প্রথম, চিৎ করে শুইয়ে হাঁটু ভাঁজ করে কবর দেওয়ার প্রথা লক্ষিত
হয়, যা পরে কুরগান কালচারের অন্যতম সাধারণ লক্ষণ হিসেবে পরিগণিত।
|
স্রেডনি-স্টগ কালচার
|
৪৪০০-৩৪০০
|
দ্নীপার-দনেৎস অববাহিকা
|
DD-II কালচারের
উত্তরসূরী। এখানে প্রথম কারুকার্য করা মাথা-ওয়ালা দন্ড (decorated mace) পাওয়া যায়, যা গোষ্ঠীপতিদের
ক্ষমতার চিহ্ন বলে মনে করা হয়। কিছু বিশেষ কবরে এগুলি পাওয়া যায়, যে-কবরগুলির
আয়তন ও তাতে প্রাপ্ত মূল্যবান দ্রব্যের পরিমাণ লক্ষ্যণীয় ভাবে বেশি।
পরবর্তীকালের কুরগান সেমেট্রিগুলিতেও এই কারুকার্যখচিত মাথা-ওয়ালা দণ্ডের
উপস্থিতি লক্ষ করা যাবে। স্রেডনি-স্টগের কবরগুলিতে মৃতদেহের ওপর ও চারদিকে রেড
অকার ছড়ানো হত, যা অন্যান্য কুরগান সেমেট্রিগুলিরও সাধারণ বৈশিষ্ট্য। লক্ষ করা ভালো, এই সভ্যতার উদ্ভব আর কুকুতেনি
ত্রিপোলাইয়ের অবক্ষয়ের সূচনা সমসাময়িক। এরা সম্ভবত বাহন-হিসেবে ঘোড়ার ব্যবহার
জানত, কেননা এদেরই একটি দল, নর্থ-পন্টিকের স্কেলিয়া কালচারের সূচনা করেছিল। এই
জঙ্গমতা, ঘোড়ার ব্যবহার ছাড়া সম্ভব নয় বলে অনেকে মনে করেন।
|
স্কেলিয়া কালচার
|
৪৩০০-৩৯০০
|
নর্থ-পন্টিক
|
এর মেটিরিয়াল কালচারের সঙ্গে স্রেডনি-স্টগের
মেটিরিয়াল কালচারের এত মিল, যে এ-দুটিকে আলাদা সংস্কৃতি বলে চিহ্নিত করা দুষ্কর।
অ্যান্থনি-সহ অনেকের মত, এখানে (নোভোদানিলোভকায়) প্রাপ্ত কবরগুলি আসলে স্রেডনি-স্টগের
গোষ্ঠীপতিদের, যারা মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পূর্বদিকে সরে আসে। আরেকটি দল,
দানিউব উপত্যকায় গিয়ে সুভোরোভো কমপ্লেক্সের সূচনা করে থাকতে পারে।
কুকুতেনি-ত্রিপোলাইয়ের পতনের পেছনে, এদের প্রভাব থাকতে পারে বলে অনেকের মত।
ভাষাতাত্ত্বিক দিক থেকে, এই মাইগ্রেশনটিই ‘আনাতোলিয়ান শাখা’র জন্ম দেয় বলে
অনুমান।
|
মাইকপ কালচার
|
৩৭০০-৩০০০
|
ককেশাসের উত্তরদিকের পাদদেশ
|
এই বিশেষ সংস্কৃতির সঙ্গে স্তেপ-অঞ্চলের অন্যান্য
সংস্কৃতির প্রত্যক্ষ মিল যেমন আছে, প্রত্যক্ষ অমিলও ততটাই। এখানকার কবরগুলিতে
সোনা-তামা-ব্রোঞ্জের তৈরি মূল্যবান সামগ্রীর যে-প্রাচুর্য, তা আর কোথাও দেখা যায়
না। অথচ, অন্যদিকে, কুরগান সেমেট্রির বেশ কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্যও এতে বিদ্যমান।
মারিয়া গিম্বুতাস একে বাকি কুরগান কালচারের সঙ্গে, এবং সেই সুবাদে
প্রোটো-ইন্দো-ইয়োরোপীয়ানদের সঙ্গে এক করে দেখিয়েছেন। যদিও ম্যালরি এ-ব্যাপারে
ভিন্নমত পোষণ করেন। তাঁর এবং অ্যান্থনির মতে, এই সভ্যতা একটি আঞ্চলিক ককেশীয়
সভ্যতা, যাদের সঙ্গে দন-অঞ্চলের স্তেপ কালচারের ঘনিষ্ঠ সংযোগ ছিল। AIT-সমর্থকদের মতে, ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষায় ককেশীয়
শব্দের (লোন ওয়র্ডস) অনুপ্রবেশ এই সংযোগের ফলশ্রুতি। এদের সঙ্গে মেসোপটেমীয়
সভ্যতার (প্রাচীন ও মধ্য-উরুক পর্বের) বাণিজ্যিক লেনদেনের নিদর্শনও রয়েছে।
|
রেপিন কালচার
|
৩৯৫০-৩৬০০
|
দন-ভোলগা অববাহিকা
|
খ্ভালিন্সক কালচারের সঙ্গে সমাপতন লক্ষণীয়। লেট
খ্ভালিন্সক আর রেপিন কালচার সম্মিলিতভাবে ইয়ামনায়া কালচারের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল।
|
আফানাসিয়েভো কালচার
|
৩৭০০-২৪০০
|
দক্ষিণ সাইবেরিয়া
|
মনে করা হয়, রেপিন কালচার থেকে একটি গোষ্ঠী
বিচ্ছিন্ন হয়ে পূর্বদিকে যাত্রা করে, এবং পশ্চিম গোর্ণি আলতাই অঞ্চলে থিতু হয়। AIT-সমর্থকরা মনে করেন, এরাই টোকারিয়ান শাখাটির
জন্ম দিয়েছিল। বাহন-হিসেবে ঘোড়ার ব্যবহার না-জানলে এত দীর্ঘ দূরত্ব অতিক্রম করা
সম্ভব ছিল না। এরা সম্ভবত উত্তর কাজাখস্তানে বোটাই কালচারের পত্তনও করেছিল।
প্রসঙ্গত, প্রাচীনতম পোষ-মানা ঘোড়ার নিদর্শন বোটাই কালচারেই পাওয়া যায় (ঘোড়ার
দাঁতে বিট-ওয়্যার নিয়ে অ্যান্থবি-র গবেষণা দ্রষ্টব্য)।
|
ইয়ামনায়া কালচারাল হরাইজন
|
৩৪০০-২৬০০
|
দন-ভোলগা-উরাল
|
কুরগান হাইপথেসিসের কেন্দ্রবিন্দু। ইয়ামনায়া
কালচারের প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া যায় পন্টিক কাস্পিয়ান স্তেপের পূর্বদিকে, উরাল
পর্বতের পশ্চিমে। ধীরে ধীরে, তা পশ্চিমে প্রুত-দ্নীস্তার অববাহিকা অবধি বিস্তৃত
হয়। প্রাপ্ত নিদর্শন থেকে অনুমান, ইয়ামনায়া কালচারের পূর্বদিকের বসতিগুলিতে পুরুষ-প্রাধান্য
ছিল অধিক এবং এরা ছিল তুলনামূলকভাবে জঙ্গম। পশ্চিমদিকের বসতিগুলিতে কৃষির
গুরুত্ব বেশি ছিল, এবং এগুলি ছিল অপেক্ষাকৃত
স্থায়ী। বর্তমান AIT-সমর্থকদের মত, ইয়ামনায়া কালচার থেকে ছোট-ছোট স্বল্প-দূরত্বের
অভিবাসনের (ফোক মাইগ্রেশন) ফলে ইন্দো-ইয়োরোপীয়ান ভাষাগোষ্ঠীর পশ্চিম-শাখাটি মূল
কাণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। দানিউব-উপত্যকায় এদের অভিবাসন এবং সেখানকার কস্তোফেনি
সভ্যতার সঙ্গে এদের সংমিশ্রণ প্রি-কেল্টিক ও প্রি-ইতালিক ভাষার বিস্তারের জন্য
দায়ী।
|
উসাতোভো কালচার
|
৩৩০০-২৮০০
|
দ্নীস্তার অববাহিকা
|
সাধারণভাবে, একে কুকুতেনি কালচারের অন্তর্গত
একটি বসতি বলেই মনে করা হয়। তবে, অ্যান্থনি-র মতে, এটি স্তেপ কালচারের একটি
অংশবিশেষ, যাদের সঙ্গে কুকুতেনি-র ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল (পেট্রন-ক্লায়েন্ট)। এরা
পরে ট্রিখটারবেকার কালচারের সঙ্গেও অনুরূপ সম্পর্ক স্থাপন করে, যা ধীরে ধীরে
কর্ডেড-ওয়্যার কালচারের জন্ম দেয়। এভাবেই, প্রি-জার্মানিক শাখাটি
প্রোটো-ইন্দো-ইয়োরোপীয়ান কাণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে উত্তর-পশ্চিম ইয়োরোপে বিস্তারলাভ
করে।
|
মধ্য-দ্নীপার কালচার
|
২৮০০-১৮০০
|
মধ্য-দ্নীপার অববাহিকা
|
কর্ডেড-ওয়্যার কালচারের সঙ্গে প্রচুর সাদৃশ্য।
আবার, স্রেডনি-স্টগ ও ইয়ামনায়া কালচারের সঙ্গেও মিল লক্ষ করা যায়।
|
ফাতিয়ানোভো কালচার
|
২৮০০-১৮০০
|
মধ্য-দ্নীপার অববাহিকার উত্তর-পূর্ব সীমা
|
সম্ভবত, মধ্য-দ্নীপার কালচারের একটি পূর্বতন
শাখা থেকে এর উদ্ভব। যদিও এর মৃৎপাত্রের নিদর্শনগুলি স্বকীয়, তবুও কর্ডেড ওয়্যার
বা গ্লোবিউলার অ্যাম্ফোরা কালচারের সঙ্গে কিছু মিল লক্ষ করা যায়।
|
আবাশেভো কালচার
|
২৫০০-১৯০০
|
দন-অববাহিকার উপরিভাগ, মধ্য-ভোলগা এবং উরাল পর্বতের দক্ষিণ-পশ্চিম
পাদদেশের বিস্তৃত ফরেস্ট-স্তেপ অঞ্চল
|
২৫০০ বিসিই-র আগে এই অঞ্চলে বসবাসকারী ভোলোশোভো
পশুপালকরা এই সভ্যতার সঙ্গে মিশে যায় বলে অনুমান। আবাশেভো কালচারের সঙ্গে
সিনতাশতার ঘনিষ্ঠ সংযোগ ছিল। এদের কবরের ওপরেও কুরগান দেখতে পাওয়া যায়।
ধাতুবিদ্যায় এদের বিশেষ পারদর্শিতা ছিল (বিশেষ করে, পশ্চিম উরাল পর্বতে, বেলায়া
নদীর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে)। কবরগুলি থেকে এমন প্রমাণও পাওয়া যায় যে, এই অঞ্চলে
স্থানীয় জনগোষ্ঠীগুলির মধ্যে সংঘর্ষ এ-সময়ে বেড়ে গিয়েছিল, এবং মেয়েরাও যুদ্ধে
অংশগ্রহণ করত।
|
পোলতাভকা কালচার
|
২৮০০-?
|
উরাল-টোবোল অঞ্চল
|
পশুপালক জনগোষ্ঠীর একটি দল ক্রমশ পুর্বদিকে সরে
এসে, ২৮০০ থেকে ২৬০০ বিসিই-র মধ্যে, এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। পরবর্তীকালে,
সিনতাশতা কালচারের বসতিগুলি, অনেকক্ষেত্রেই, পোলতাভকা সভ্যতার পরিত্যক্ত অবশেষের
ওপর গড়ে উঠেছিল।
|
পোতাপোভকা কালচার
|
২৮০০-২১০০
|
উরাল-টোবোল অঞ্চল
|
মধ্য-ভোলগা অঞ্চলে গড়ে ওঠা এই সভ্যতাটি শুধু
সিনতাশতা কালচারের সমসাময়িকই নয়, এ-দুটি সভ্যতার মধ্যে সাদৃশ্যও প্রচুর—কবর
দেওয়ার একই রকম পদ্ধতি, একই ধরণের ধাতুশিল্পের নিদর্শন, অস্ত্রশস্ত্র, ঘোড়ার
ব্যবহার (খাদ্য ও বাহন দুক্ষেত্রেই), রথচালনার জন্যে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম (যেমন,
ঘোড়ার cheek-piece, চাবুকের
হাতল) ইত্যাদি।
|
সিনতাশতা
|
২৮০০-২১০০
|
উরাল-টোবোল অঞ্চল
|
১৯৮৯-৯০ সালে, রাশিয়ার চেলিয়াবিনস্ক অঞ্চলে,
সিনতাশতা কালচারের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কার, প্রোটো-ইন্দো-ইয়োরোপীয়
চর্চার ক্ষেত্রে একটা বড়সড় ঘটনা। ২১০০ বিসিই নাগাদ, পোলতাভকা ও আবাশেভো পশুপালক
গোষ্ঠীগুলি ক্রমশ স্থিতু হতে শুরু করে। এবং শুরু হয় উঁচু প্রাচীর ও পরিখা দিয়ে
ঘেরা বসতি-নির্মাণ। হয়তো, এই সময়ে, বিভিন্ন গোষ্ঠীগুলির মধ্যে পারস্পরিক
যুদ্ধ-বিগ্রহ বেড়ে গিয়েছিল, আর তার ফলেই এই বাড়তি সতর্কতা। এইভাবে, যে-নতুন
সভ্যতার উন্মেষ হয়, প্রত্নতাত্ত্বিকরা তাকেই সিনতাশতা কালচার নামে অভিহিত
করেছেন। স্তেপ-অঞ্চলের একেবারে পূর্বদিকে অবস্থিত হবার সুবাদে, এদের সঙ্গে
ব্যাক্ট্রিয়া-মার্জিয়ানার নগরসভ্যতার যোগাযোগ ঘটে থাকা অস্বাভাবিক নয়। সিনতাশতা
কালচারে ধাতুবিদ্যার প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ, ব্যাক্ট্রিয়া-মার্জিয়ানার সঙ্গে
বাণিজ্যিক সম্পর্কের দিকে ইঙ্গিত করে বলেও মনে করেন অনেকে। এদের কবরের মধ্যে
পাওয়া গেছে প্রচুর পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র, পাওয়া গেছে বিপুল-সংখ্যক ঘোড়ার অবশেষ।
পৃথিবীর প্রাচীনতম রথের নিদর্শন পাওয়া গেছে সিনতাশতায়।
|
ব্যাক্ট্রিয়া-মার্জিয়ানা
|
২১০০-২৮০০
|
মুরগাব নদীর ব-দ্বীপ, ইরান মালভূমির উত্তর-সীমা (উত্তর-পশ্চিম
আফগানিস্তান এবং দক্ষিণ তুর্কমেনিস্তান)
|
সম্ভবত, এই অঞ্চলের নিওলিথিক কৃষকদের হাতেই এই
সভ্যতার সূচনা।, এবং ধীরে ধীরে তা এক অত্যন্ত পরিণত নগরসভ্যতার রূপ পরিগ্রহ করে।
পরবর্তীকালে, ইন্দো-ইরানিয়ানদের দ্বারা এই সভ্যতা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়। ব্যাক্ট্রিয়া-মার্জিয়ানার
পরিণত পর্যায়ে সিনতাশতা থেকে, এবং অবক্ষয়ের শুরুতে ফেদোরোভো-অ্যান্ড্রোনোভো
কালচার থেকে ইন্দো-ইরানিয়ানদের দুটি অভিবাসন ঘটে বলে অনুমান। প্রত্নতাত্ত্বিকরা
বলেন, এর স্পষ্ট ছাপ পড়েছিল এই সভ্যতার মেটিরিয়াল কালচারের ওপর।
|
স্রুবনায়া (বা, টিম্বার গ্রেভ) কালচার
|
১৮০০-১২০০
|
পশ্চিম স্তেপ—উরাল থেকে দ্নীপার
|
মধ্য-ভোলগা অঞ্চলের পোতাপোভকা এবং আবাশেভো
কালচারদুটি, ধীরে ধীরে, স্রুবনায়া কালচারের জন্ম দেয়। যাযাবর-বৃত্তির
পরিবর্তে, স্থায়ী বসতি-স্থাপনের প্রতি
আগ্রহ এই অঞ্চলে এই প্রথম লক্ষ করা যায়।
|
পেত্রোভকা কালচার
|
১৯০০-১৭৫০
|
পূর্ব-স্তেপ (উত্তর কাজাখস্তানের ইশিম নদীর অববাহিকা থেকে শুরু হয়ে
দক্ষিণে বিস্তৃত হয়েছে মধ্য কাজাখস্থান অবধি)
|
কবরের আকার-প্রকার এবং মেটিরিয়াল কালচারের দিক
থেকে পেত্রোভকার সঙ্গে সিনতাশতার প্রচুর মিল। জায়গায় জায়গায়, সিনতাশতা সভ্যতার
পরিত্যক্ত বসতির ওপর পেত্রোভকা কালচারের বসতিগুলির অবস্থান (যাকে প্রত্নতত্ত্বের
ভাষায় স্ট্র্যাটিফিকেশান বলে) থেকে অনুমান করা যায়, পেত্রোভকা আসলে সিনতাশতারই
উত্তরসূরী।
|
অ্যান্ড্রোনোভো কালচার
|
১৮০০-১২০০
|
পূর্ব-স্তেপ—উরাল থেকে আলতাই এবং তিয়েন-শান অবধি
|
ব্রোঞ্জ যুগের শেষ পর্যায়ে, উরাল পর্বতের
পশ্চিমে যেমন স্রুবনায়া কালচার গড়ে উঠেছিল, তেমনি, ঠিক তার জুড়িদার হিসেবেই,
উরালের পূর্বদিকে গড়ে উঠেছিল অ্যান্ড্রোনোভো কালচার। এই সভ্যতার অনেক বৈশিষ্ট্যই,
সিনতাশতা ও পেত্রোভকা কালচার থেকে আহৃত বলে প্রত্নতাত্ত্বিকদের অনুমান। AIT-সমর্থকরা মনে করেন, অ্যান্ড্রোনোভো কালচার ছিল
ইন্দো-ইরানিয়ান ভাষাভাষী। এদের হাত ধরেই (অভিবাসনের মাধ্যমে), এই ভাষা ক্রমশ
ইরান ও ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েছে, যথাক্রমে ইরানিয়ান (আবেস্তান ইরানিয়ান) ও সংস্কৃত
(বৈদিক সংস্কৃত বা ছান্দস) ভাষার রূপ ধরে।
|
এ তো গেল স্তেপ-অঞ্চলের বৃত্তান্ত। এর দক্ষিণদিকেও একাধিক সভ্যতা গড়ে
উঠেছিল, যার মধ্যে সিন্ধু-সভ্যতা ও মেসোপটেমীয় সভ্যতার কথা আমরা সকলেই জানি।
কিন্তু এগুলি ছাড়াও এই অঞ্চলে আরো কয়েকটি সভ্যতা গড়ে উঠেছিল।
সারণী-২:
স্তেপ অঞ্চলের দক্ষিণে প্রাপ্ত সভ্যতার নিদর্শন
সভ্যতা
|
কালক্রম (বিসিই)
|
ভৌগোলিক অবস্থান
|
বর্ণনা
|
মেসোপটেমীয় সভ্যতা
|
৪০০০-?
|
বর্তমান ইরাক, এবং সিরিয়ার কিয়দংশ
|
মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে মনুষ্য-বসবাসের ইতিহাস
অতি-প্রাচীন। তবে, যাকে আমরা মেসোপটেমীয় সভ্যতা বলে জানি, তার উন্মেষ মোটামুটি
৪০০০ বিসি নাগাদ, যাকএ উরুক-পর্যায় বলা হয়। এই সময়ে, সুমেরীয় সভ্যতার উরুক-শহরকে
কেন্দ্র করে প্রথম নগর-সভ্যতার বিস্তার শুরু হয়। উরুক-পর্যায়ের শেষভাগে,
৩৪০০-৩২০০ বিসিই নাগাদ, কীলকাকৃতি লিপির উদ্ভব ঘটে। ২৯০০-২৩৫০ বিসিই-র মধ্যে
সুমেরে রাজতন্ত্রের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। এই অঞ্চলের নগরগুলি ক্রমশ শিল্প ও
ব্যবসাবাণিজ্যের কেন্দ্র হয়ে ওঠে, আর সমাজ হয়ে ওঠে জটিল ও বহুস্তরীয়। এই সময়েই,
সুমেরীয় ও আক্কাদীয়দের মধ্যে সাংস্কৃতিক লেনদেন ও মিথোজীবিতার সম্পর্ক তৈরি হয়।
তারপর একে-একে, আক্কাদীয়, উর, আসিরীয়, ব্যাবিলনীয় ইত্যাদি নানান সভ্যতার উদ্ভব ও
বিকাশের সাক্ষী থেকেছে এই অঞ্চল। মেসোপটেমিয়ার সঙ্গে সিন্ধু-সভ্যতার ঘনিষ্ঠ
বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। সম্ভবত, তার সূত্রপাত ৩০০০ বিসিই-র কিছু আগে। তবে, ২৫০০
বিসিই-তে তা ফুলে-ফেঁপে ওঠে। সুমেরীয়রা সিন্ধু-সভ্যতাকে চিনত ‘মেলুহা’ নামে।
আক্কাদ আর সুমেরের পারস্পরিক সংযোগের কারণে, আক্কাদীয়
ভাষার ওপর সুমেরীয় ভাষার একটা স্থায়ী প্রভাব পড়ে, যে-কারণে এই দুটি ভাষাকে Sprachbund বলা হয়ে থাকে। প্রাচীন সুমেরীয়
ভাষাকে একটি বিচ্ছিন্ন ভাষা (Language Isolate) হিসেবে গণ্য করেন আধুনিক ভাষাতাত্ত্বিকরা। অর্থাৎ, বর্তমানের কোনো
ভাষা-পরিবারের সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই। ২০০০ বিসিই নাগাদ, কথ্য ভাষা হিসেবে, সুমেরীয় ভাষার পরিবর্তে
আক্কাদীয় ভাষার ব্যাপক প্রচলন শুরু হয় মেসোপটেমিয়ায়। সুমেরীয় ভাষা ব্যবহৃত হত
কেবল সাহিত্যে বা বিশেষ কোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে। আক্কাদীয় ভাষা সেমিটিক
ভাষাপরিবারের অন্তর্গত বলেই ভাষাতাত্ত্বিকদের মত।
|
এলাম সভ্যতা
|
৩২০০-৫৪০
|
পশ্চিম এবং দক্ষিণপশ্চিম ইরান
|
এলাম বা এলামাইট সভ্যতা সম্পর্কে প্রত্যক্ষ
কোনো তথ্য পাওয়া না-গেলেও, মেসোপটেমীয় সভ্যতায় প্রাপ্ত নানান সূত্র ও নথি থেকে
এই সভ্যতা সম্পর্কে একটা ধারণা করা সম্ভব। মনে করা হয়, ৩২০০ বিসিই নাগাদ,
টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিসের পূর্বে, উর্বর পলিমাটিসমৃদ্ধ সমভূমিতে নানান ছোটো-ছোটো
বসতি গড়ে ওঠে, এবং ক্রমশ তা আরো পূর্বদিকে ছড়িয়ে গিয়ে, ইরান-মালভূমি পর্যন্ত
বিস্তৃত হয়। সুমেরের ধারাবাহিক আক্রমণ প্রতিহত করতে, এই বসতিগুলি একজোট হয়ে এলাম
সাম্রাজ্যের সূচনা করে। এই সভ্যতার কেন্দ্র ছিল সুসা (বর্তমান ইরানের সুশ শহর)। একাধিকবার
এই শহর দখল করেছে সুমেরীয় বা আক্কাদীয় রাজারা, এবং পুনরায় এলাম তা দখল করেছে।
শিল্পকলায়, বিশেষত ধাতুশিল্প, মৃৎপাত্র-নির্মাণ বা মূর্তি-নির্মাণের ক্ষেত্রে,
এলামের দক্ষতা ছিল বিস্ময়কর। এলামে প্রাপ্ত লিখিত নিদর্শনগুলির পাঠোদ্ধার করা
যায়নি। অনেকে মনে করেন, তামিল-সহ দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড় ভাষাগুলি আসলে
এলামাইটদের হাত ধরে, অভিবাসনের ফলে, ভারতে এসেছে। এমনকী, সিন্ধু-সভ্যতার ভাষাও,
অনেকের মতে, এই ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত ছিল।
|
কুরা-আরাক্সেস
|
৪০০০-২০০০
|
দক্ষিণ ককেশাস, উত্তরপশ্চিম ইরান, পূর্ব টার্কি, সিরিয়া
|
কুরা-আরাক্সেস কালচারের উৎপত্তি নিয়ে গবেষকদের
মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেন, এটি ককেশাস অঞ্চলের নিজস্ব সভ্যতা, কেউ আবার মনে
করেন, বহিরাগত কোনো জনগোষ্ঠী ৪০০০-৩৫০০ বিসিই-র মধ্যে এই অঞ্চলে এসে, স্থানীয়
জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে, বা তাদের উৎখাত করে, এই সভ্যতার পত্তন করে। কুরা-আরাক্সেস
কালচারে প্রাপ্ত মৃৎপাত্রগুলির নিজস্ব ধরণ রয়েছে, যা এই অঞ্চলের নিওলিথিক
সভ্যতায় প্রাপ্ত মৃৎপাত্রের থেকে যথেষ্ট আলাদা। ৩০০০ বিসিই-র পর, এরা উত্তরে
ককেশাসের পাদদেশ এবং দক্ষিণে ইরান মালভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এদের সঙ্গে মেসোপটেমিয়া
আর স্তেপ অঞ্চলের মাইকপ কালচারের যোগাযোগ ছিল বলে অনুমান।
|
সিন্ধু সভ্যতা
|
৩৩০০-১৩০০
|
আফগানিস্তানের উত্তর-পূর্ব সীমা থেকে শুরু
করে, পাকিস্তান হয়ে, ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমা
|
সিন্ধু-সভ্যতা বলতে আমরা যে-নগরকেন্দ্রিক
সভ্যতার কথা ভাবি, তার উদ্ভব ৩০০০-২৬০০ বিসিই নাগাদ হলেও, এই অঞ্চলে কৃষিভিত্তিক
সভ্যতার সূচনা হয়েছিল ৭০০০-৫০০০ বিসিই-র মধ্যে। প্রত্নতাত্ত্বিকরা মনে করেন,
মেহেরগড় অঞ্চলে প্রাপ্ত নিওলিথিক সভ্যতার নিদর্শনগুলি আসলে সিন্ধুসভ্যতার
পূর্বসূরী। ২৬০০ বিসিই নাগাদ, এই
অঞ্চলের ছোট-বড় বসতিগুলি একত্রিত হয়ে, নগর-কেন্দ্রিক হরপ্পা সভ্যতার পত্তন করে।
পরবর্তী ৭০০ বছরে, এই সভ্যতা উৎকর্ষের চরম সীমায় পৌঁছয়। মেসোপটেমিয়া ও মিশরের
সঙ্গে এদের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্বন্ধ ছিল। ১৯০০ বিসিই নাগাদ, এই সভ্যতার
অবক্ষয়ের সূচনা। মনে করা হয়, আবহাওয়া পরিবর্তন, ও তার ফলে নদীখাতগুলির শুকিয়ে
যাওয়ার কারণেই এই অবক্ষয় শুরু হয়েছিল। AIT-তত্ত্বের সমর্থকদের মতানুযায়ী, এই সময়েই, ইন্দো-ইরানিয়ান জনগোষ্ঠীর
একাংশ, সিন্ধুসভ্যতার সংস্পর্শে আসে। আসকো পারপোলা মনে করেন, ইন্দো-ইরানিয়ান
গোষ্ঠীর অভিবাসন ঘটেছিল দুটি পর্যায়ে—একদল আসে ২০০০-১৮০০ বিসিই-র মধ্যে (এরা
অথর্ববেদের রচয়িতা বলে তিনি অনুমান করেন), আর অন্যদলটি আসে ১৫০০ বিসিই নাগাদ
(এরা ঋগবেদ রচনা করেছিল)। ১৫০০-১২০০ বিসিই-র মধ্যে সিন্ধুসভ্যতা প্রায় পুরোপুরি
বিলুপ্ত হয়। বর্তমানে প্রচলিত মত-অনুযায়ী, সিন্ধু-সভ্যতার জনগোষ্ঠী ক্রমশ পূর্ব
ভারতের গাঙ্গেয় অববাহিকায়, এবং দক্ষিণে কাবেরী-নদীর অববাহিকার দিকে ছড়িয়ে
পড়েছিল।
সিন্ধু-সভ্যতার লিপির পাঠদ্ধার করা আজও সম্ভব
হয়নি। একদল ভাষাতাত্ত্বিকের মত, সিন্ধুসভ্যতার ভাষা ছিল দ্রাবিড়; অন্য একদল পণ্ডিত
মনে করেন, সিন্ধুসভ্যতার ভাষা সংস্কৃত বা ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত।
|
ওপরের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলির সাপেক্ষে, এবার আমরা দেখতে চাইব,
লেখক-প্রস্তাবিত বিকল্পটি কতটা
গ্রহণযোগ্য। মনে করিয়ে দেওয়া যাক, লেখক
বলছেন, এই অঞ্চলে (অর্থাৎ, সিন্ধুসভ্যতার উত্তর-পশ্চিম
সীমা থেকে পূর্ব ইয়োরোপ পর্যন্ত) নানান ছোট-বড় নগরসভ্যতা গড়ে উঠেছিল। কয়েক হাজার
বছর-ব্যাপী পারস্পরিক সংযোগের ফলে এদের নিজস্ব ভাষাগুলি মিলেমিশে যায়, আলাদা আলাদা
ডায়ালেক্ট তৈরি করে, যা পরবর্তীকালে আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বতন্ত্র ভাষা-হিসেবে
আত্মপ্রকাশ করে। এর অর্থ, ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষাগুলির স্বতন্ত্ররূপে আত্মপ্রকাশের
আগেই, আলোচ্য অঞ্চলের বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও
আদান-প্রদানের সম্পর্ক ছিল, যার ছাপ রয়ে গেছে পরবর্তীকালের স্বতন্ত্র ভাষাগুলির
মধ্যেও।
সারণী-১ থেকে, এ-কথা বোঝা যায় যে, গোটা স্তেপ অঞ্চল জুড়ে ছোটো-বড় নানান
সভ্যতা বাস্তবিকই গড়ে উঠেছিল। কিন্তু, এরা সকলেই যে একই কালখন্ডে বিদ্যমান ছিল,
এমন নয়। বরং, একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে একটি বিশেষ সভ্যতা গড়ে উঠেছে, ক্ষয়প্রাপ্ত
হয়েছে, এবং নিকটবর্তী অঞ্চলে কতকটা একইরকম আরেকটি সভ্যতা মাথাচাড়া দিয়েছে—নিওলিথিক
যুগের শেষ থেকে ইনিয়োলিথিক হয়ে ব্রোঞ্জ যুগ পর্যন্ত, প্রায় চারহাজার বছরের
সময়পর্বে, স্তেপ অঞ্চলের ইতিহাস কতকটা এরকম। পন্টিক স্তেপের একেবারে
পশ্চিমপ্রান্তে, যখন কৃষিভিত্তিক প্রাচীন ইয়োরোপের (কুকুতেনি-ত্রিপোলাই সভ্যতা)
অবক্ষয়ের সূচনা হচ্ছে, আর একের পর এক নতুন প্যাস্টরালিস্ট সভ্যতা গড়ে উঠছে, তখনও
কিন্তু স্তেপের পূর্বপ্রান্তে (উরাল পর্বতের পূর্বে) কোনো সভ্যতা গড়ে ওঠেনি। এই অঞ্চলে, সভ্যতার প্রথম
নিদর্শন পাওয়া যাচ্ছে ৩৩০০ বিসিই-র আফানাসিয়েভো কালচারে, যার সঙ্গে রেপিন ও
ইয়ামনায়ার প্রত্যক্ষ সাদৃশ্য। বরং, ২৫০০ বিসিই-তে এসে দেখতে পাচ্ছি, পূর্ব থেকে
পশ্চিমে, গোটা স্তেপ-জুড়ে নানান সভ্যতার চিহ্ন, যাদের মধ্যে কেউ কেউ অবলুপ্ত, কেউ
আবার স্বমহিমায় বিদ্যমান। মনে রাখতে হবে, এই সময়ে, সমস্ত ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষাই,
তাদের প্রোটো-ইন্দো-ইয়োরোপীয় কাণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে।
অর্থাৎ, পশ্চিম ও মধ্য-ইউরেশীয় স্তেপ অঞ্চলের পুব থেকে পশ্চিমে (যার
বিস্তার পাঁচ-ছ হাজার কিলোমিটারের কম নয়), একইসময়ে, নানান সভ্যতার একটা
বৈচিত্র্যপূর্ণ সহাবস্থান এবং তাদের মধ্যে পারস্পরিক আদান-প্রদানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের
সপক্ষে তেমন কোনো প্রমাণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে পাওয়া যায় না। বরং, প্যাস্টরালিস্ট
মানুষের একেকটি দল, বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন জায়গায় স্থিতু হয়েছে, এবং সেখানে একটি
নির্দিষ্ট সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে, এমনটা ভাবাই সহজ বলে মনে হয়। যেখানে আগে থেকেই
কোনো সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল, সেখানে তাদের সংমিশ্রণ ঘটেছে, এরকম ভাবতেও কোনো বাধা
নেই। এই ছবিটা বদলায় একেবারে ২৫০০-২১০০ বিসিই-তে এসে। এই সময়ে, সম্ভবত ঘোড়া ও
ঘোড়ায়-টানা দ্রুতগামী গাড়ির (রথ, wagon যাই হোক না কেন) ব্যাপক প্রচলনের ফলে, পন্টিক-ক্যাস্পিয়ান স্তেপ
বরাবর, ইয়োরোপ ও এশিয়ার মধ্যে একটি অবিচ্ছিন্ন সংযোগের পথ তৈরি হয়। তাম্র ও
ব্রোঞ্জযুগে, পন্টিক-ক্যাস্পিয়ান স্তেপের এই ছবিটার সঙ্গে, মাইগ্রেশনের সম্পর্কটাই
সবার আগে মাথায় আসে, ছোট-বড় নানান সভ্যতার অবিচ্ছিন্ন সংযোগ বা নেটওয়ার্কের নয়। আগেই
বলেছি, এই তত্ত্বও অনুমান-নির্ভর, এবং তা বদলে যেতেই পারে, যদি কোনো জোরদার বিপক্ষ
প্রমাণ হাতে আসে, অথবা, উপস্থিত প্রমাণগুলিকে যদি সম্পূর্ণ নতুন কোনো উপায়ে
বিশ্লেষণ করা হয়। বইটিতে এমন কোনো প্রচেষ্টার নিদর্শন আমি পাইনি।
এবার আসি, দক্ষিণের নগরসভ্যতাগুলির প্রসঙ্গে। স্তেপ-সভ্যতাগুলির
মাধ্যমে না হোক, নগরকেন্দ্রিক সভ্যতাগুলির মধ্যস্থতায় কি পূর্ব থেকে পশ্চিমে এমন
একটি অবিচ্ছিন্ন সংযোগসূত্র রচিত হতে পারে? প্রত্নতাত্ত্বিক কোনো প্রমাণ কি এর
সপক্ষে দাখিল করা সম্ভব?
নগরকেন্দ্রিক সভ্যতাগুলির নিজেদের মধ্যে সংযোগের যথেষ্ট
প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায়—সুমেরের সঙ্গে সিন্ধু-সভ্যতার, সিন্ধু-সভ্যতার
সঙ্গে এলামের, এলামের সঙ্গে সুমেরের। কিন্তু, প্রাচীন ইয়োরোপ, অর্থাৎ
কুকুতেনি-ত্রিপোলাইয়ের সঙ্গে সুমের বা সিন্ধু-সভ্যতার যোগাযোগের কোনো প্রমাণ আছে
বলে আমার জানা নেই। আবার, স্তেপ সভ্যতাগুলোর মধ্যে, মাইকপ কালচার (৩৭০০-৩০০০
বিসিই) এবং ব্যাক্ট্রিয়া-মার্জিয়ানা (২১০০-১৮০০) ছাড়া, অন্যদের সঙ্গে দক্ষিণের
নগরসভ্যতাগুলির যোগাযোগেরও কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
মাইকপ কালচারের যোগ ছিল কেবল সুমেরীয় সভ্যতার সঙ্গে। এই যোগাযোগ সম্ভবত
ঘটেছিল ইরান মালভূমির উত্তর থেকে ককেশাসের পাদদেশ অবধি বিস্তৃত কুরা-আরাক্সেস
কালচারের মাধ্যমে (সারণী-২ দ্রষ্টব্য)। অর্থাৎ, এটি একটি আঞ্চলিক/স্থানীয় সংযোগ,
বৃহত্তর স্তেপ অঞ্চলের সঙ্গে সুমেরের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের নিদর্শন নয়। সুমের ও
সিন্ধু, দুই সভ্যতার সঙ্গেই যোগাযোগ ছিল একমাত্র ব্যাক্ট্রিয়া-মার্জিয়ানার।
কিন্তু, ব্যাক্ট্রিয়া-মার্জিয়ানা তো অনেক পরের ঘটনা। ভাষাবিস্তারের সময়ক্রম ধরলে,
ততদিনে সমস্ত ভাষাই তাদের স্বকীয়রূপ পরিগ্রহ করেছে।
ধরে নেওয়া যাক, সংস্কৃত ভাষার উন্মেষ সিন্ধু-সভ্যতায়, আনুমানিক ৪০০০
বিসিই-তে। তাহলে, প্রচলিত সময়সারণী অনুসারে, ৩২৫০-৩০০০ বিসিই নাগাদ যখন
পশ্চিম-ইয়োরোপীয় ভাষাগুলির উদ্ভব হচ্ছে, তখন সেখানকার মানুষদের সঙ্গে
সিন্ধুসভ্যতার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল, এ-কথাও মানতে হয়। নচেৎ, গ্রীক বা ল্যাটিন ভাষার
সঙ্গে সংস্কৃতের সাদৃশ্য ব্যখ্যা করা দুষ্কর। সে-যোগাযোগ প্রত্যক্ষ হতে পারে,
অথবা, পূর্ব থেকে পশ্চিমে বিস্তৃত একটি ধারাবাহিক সভ্যতার নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পরোক্ষভাবেও
স্থাপিত হতে পারে। কিন্তু, প্রত্যক্ষ হোক বা পরোক্ষ, সিন্ধুসভ্যতার সঙ্গে
পূর্ব-ইয়োরোপের তৎকালীন গোষ্ঠীগুলির—কুকুতেনি-ত্রিপোলাই বা ইয়ামনায়া—যোগাযোগের
সপক্ষে কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ হাজির করা সম্ভব হবে কি? না কি ইয়োরোপীয়
ভাষাগুলির সঙ্গে সংস্কৃতের যোগাযোগ ২৫০০ বিসিই-র পরের ঘটনা? এ-ব্যাপারে বিস্তারিত
সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির করতে না-পারলে বিকল্প তত্ত্বের ধোপে টেঁকার সম্ভাবনা দেখি না।
AIT-স্কলাররাও কিন্তু এই
অঞ্চলে বিভিন্ন ভাষাভাষী গোষ্ঠীর অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়েছেন। তাঁদের মতে,
স্তেপ-অঞ্চলের কিছু গোষ্ঠীর ভাষা ছিল ফিনো-উগরিক, কারোর বা
প্রোটো-ইন্দো-ইয়োরোপীয়ান। আবার, স্তেপ-অঞ্চলের দক্ষিণের গোষ্ঠীগুলির ভাষা ছিল
সেমিটিক। যেখানে,
যে-সময়ে, দুটি ভিন্ন ভাষাভাষী গোষ্ঠীর মানুষের সহাবস্থান ঘটেছে, সেখানে তাদের
ভাষাও একে-অপরের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। কিন্তু, এই আন্তঃক্রিয়াগুলি ছিল স্থানীয়
বা আঞ্চলিক। আর এই আন্তঃক্রিয়া সম্ভব হয়েছে প্রোটো-ইন্দো-ইয়োরোপীয় জনগোষ্ঠীর
ধারাবাহিক অভিবাসন ও সংমিশ্রণের ফলে।
ঋগবেদের কাল-নির্ণয়
আমরা দেখেছি, লেখক-প্রস্তাবিত বিকল্প তত্ত্বটি,
সংস্কৃত-ভাষার উদ্ভবের প্রচলিত কালক্রমকে (২০০০ বিসিই) অস্বীকার করে।
এবং বলে যে, ৫০০০-৪০০০ বিসিই নাগাদ, সিন্ধুসভ্যতার উন্মেষপর্বেও,
সংস্কৃত-ভাষার অস্তিত্ব ছিল। এই নতুন কালক্রমটিকে মান্যতা দিতে হলে, ঋগবেদের
রচনাকাল-সম্পর্কেও ভিন্ন কোনো তত্ত্বের প্রস্তাবনা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। প্রচলিত
মত-অনুসারে, ঋগবেদ রচিত হয়েছিল ১৯০০-১২০০ বিসিই-র মধ্যবর্তী কালখণ্ডে। লেখক দেখাতে
চেয়েছেন, এই অনুমান ভ্রান্ত হওয়া অসম্ভব নয়। এ-প্রসঙ্গে, তিনি ইউনিভার্সিটি অফ
মেমফিসের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক বি এন নরহরি আচারের একটি গবেষণাপত্রের উল্লেখ
করেছেন। সেই গবেষণাপত্রে, অধ্যাপক আচার প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, শতপথ ব্রাহ্মণের দুটি
শ্লোকে, কৃত্তিকা নক্ষত্র ও সপ্তর্ষিমণ্ডলের যেরকম অবস্থান নির্দেশ
করা হয়েছে, তেমনটা সম্ভব ছিল একমাত্র ৩০০০ বিসিই নাগাদ। অর্থাৎ, এই শ্লোকের
সাক্ষ্য-অনুসারে, শতপথ ব্রাহ্মণের রচনাকাল ৩০০০ বিসিই। যেহেতু, শতপথ ব্রাহ্মণ
ঋগবেদের প্রায় হাজার বছর পরে রচিত হয়েছিল বলে অনুমান, তাই এক্ষেত্রে ঋগবেদের
রচনাকাল দাঁড়ায় ৪০০০ বিসিই। বস্তুত, এই দাবিটি প্রথম করেছিলেন শঙ্কর বালকৃষ্ণ
দীক্ষিত, ১৮৯৫ সালে। অধ্যাপক আচার, Skymap-নামক সফটওয়্যারের মাধ্যমে, বিভিন্ন সময়ে আকাশে কৃত্তিকা ও সপ্তর্ষিমণ্ডলের অবস্থান সিম্যুলেট করে,
প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়েছেন যে, দীক্ষিতের দাবি অভ্রান্ত।
শতপথ ব্রাহ্মণের শ্লোকদুটির ইংরিজি অনুবাদ এইরকম—
“And again, they do not move away from the
eastern quarter, whilst the other asterisms do move from the eastern quarter.
Thus his (two fires) are established in the eastern quarter: for this reason he
may set up his fires under the Krittikâs.” (SB-II, 1:2:3).
“On the other hand (it is argued) why he should
not set up the fires under the Krittikâs.
Originally, namely, the latter were the wives of the Bears (riksha); for the
seven Rishis 3 were in former times
called the Rikshas (bears). They were, however, precluded from intercourse
(with their husbands), for the latter, the seven Rishis, rise in the north, and
they (the Krittikâs) in the east. Now it is
a misfortune for one to be precluded from intercourse (with his wife): he
should therefore not set up his fires under the Krittikâs, lest he should thereby be precluded from intercourse.” (SB-II,
1:2:4)
দীক্ষিত এবং আচারের মতে, প্রথম শ্লোকের অর্থ, কৃত্তিকা নক্ষত্র সর্বদা
আকাশের পূর্বদিকে দেখা যায়। অর্থাৎ, যে-সময়ে এই শ্লোকটি রচিত হয়েছিল, সে-সময়ে
কৃত্তিকা নক্ষত্র খ-বিষুবে (celestial
equator) অবস্থান করত (বর্তমানে করে না)। আমরা জানি, পৃথিবীর অক্ষ স্থির বা
নিশ্চল নয়, মহাকর্ষের প্রভাবে পৃথিবীর
অক্ষেরও একটি বৃত্তীয় গতি আছে, যাকে ইংরিজিতে polar
precession বলা হয়। এর ফলে, পৃথিবীর সাপেক্ষে আকাশের নক্ষত্রগুলির
অবস্থানও, একটি নির্দিষ্ট হারে, পরিবর্তিত হয়। যেহেতু, পৃথিবীর অক্ষের এই বৃত্তীয়
আবর্তন সম্পূর্ণ হয় প্রতি ২৬,০০০ বছর অন্তর, তাই আজ থেকে একহাজার বছর আগে কোন
নক্ষত্র আকাশের কোথায় দেখা যেত, তা অংক কষে বলে দেওয়া দুরূহ নয়। দীক্ষিত ঠিক সেটাই
করেছিলেন। অধ্যাপক আচারও, Skymap-নামক সফটওয়্যারের মাধ্যমে কৃত্তিকা
নক্ষত্রের অবস্থান সিম্যুলেট করে দেখিয়েছেন, দীক্ষিতের গণনা ছিল নির্ভুল। মনে রাখা
ভালো, এইধরণের সিম্যুলেশনে পৃথিবীর অক্ষাংশের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে,
কেননা অক্ষাংশ বদলালে আকাশের চেহারাও বদলায়। এই কারণেই, পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধ
থেকে আকাশে যেসব নক্ষত্র দেখা যায়, দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে তাদের অনেকগুলিকেই আর
দেখতে পাওয়া যায় না। অধ্যাপক আচার, কোনো অজ্ঞাত কারণে, তাঁর সিম্যুলেশনের জন্য
দিল্লির অক্ষাংশ ব্যবহার করেছেন, যদিও সে-বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন বোধ
করেননি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, উইটজেল-সহ অন্যান্য
পণ্ডিতরা শ্লোকটির নানান বিকল্প ব্যাখ্যার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছেন, এবং
ব্রায়ান্টের বইতে তার বিশদ উল্লেখ রয়েছে। আমি সেসব তর্কে ঢুকতে সাহস করি না, কেননা
আমি বেদজ্ঞ নই, সংস্কৃত জ্ঞানও নেই আমার। বরং, পরবর্তী শ্লোকে (1.2.4) সপ্তর্ষিমণ্ডলের অবস্থান নিয়ে
যে-কথা বলা হয়েছে, আমরা দেখতে চাইব, আচার তাঁর গবেষণাপত্রে তার কী ব্যাখ্যা করেন।
এই অংশটি লেখক তাঁর আলোচনায় সম্পূর্ণ উহ্য রেখেছেন।
পরবর্তী শ্লোকে বলা হয়েছে, সপ্তর্ষিমণ্ডল উত্তরদিকে
উদিত হয়। অধ্যাপক আচার তাঁর সিম্যুলেশনের মাধ্যমে দেখাচ্ছেন, বর্তমানে
দিল্লিতে দাঁড়িয়ে কেউ যদি আকাশের দিকে তাকায়, তাহলে সে সপ্তর্ষিমণ্ডলকে সর্বদাই
উত্তরে উদিত হতে এবং অস্ত যেতে দেখবে। কিন্তু ২৯২৬ বিসিই-তে আকাশের ছবিটা মোটেই এমন ছিল না। সে-সময়ে, দিল্লির
দর্শকের সাপেক্ষে সপ্তর্ষিমণ্ডলের প্রতিটি নক্ষত্রই ছিল অনস্তগ (circumpolar), অর্থাৎ তারা উদিতও হত না,
অস্তও যেত না। অধ্যাপক আচারের দাবি, সফটওয়্যার
সিম্যুলেশনের মাধ্যমে তিনি দেখেছেন, ৪৫০০ বিসিই থেকে শুরু করে ১০০ বিসিই পর্যন্ত,
দিল্লির সাপেক্ষে সপ্তর্ষিমণ্ডলের অবস্থান অনস্তগ ছিল। ১০০ বিসিই-তে
সপ্তর্ষিমণ্ডলের একটিমাত্র নক্ষত্র তার অনস্তগ অবস্থান থেকে বিচ্যুত হয়। বাকিটা
তাঁর ভাষাতেই বলি—“If they are all
circumpolar as seen in Delhi at about 3000 BC, what is the meaning of “they
rise in the north”? In order to see at least one of them rise and set, one
would have to observe from a place south of Delhi. In fact, ß Ursae majoris, which has a declination of
+66˚8’ could be observed as rising from a place whose latitude is about 24˚N,
compared to Delhi’s 28˚22’N. One would have to be at latitude of about 10˚N to
observe all of Saptarsis to rise and set. Then of course, the Vedic people
could say what indeed holds true: ami hy Uttara hi saptarsayah udayanti pura
etah.”
ব্যাপারটা তাহলে কী দাঁড়াল? শতপথ ব্রাহ্মণের
রচনাকাল ৩০০০ বিসিই হলে, তার রচনার স্থানটিকে হতে হবে ১০˚ উত্তর অক্ষাংশে অবস্থিত।
আর ভারতবর্ষে ১০˚ উত্তর
অক্ষরেখাটি গেছে কেরালা ও তামিলনাড়ুর ওপর দিয়ে। লেখক কি এই মতটিকে সমর্থন করেন?
যদি করেন, তাহলে ৪০০০ বিসিই-তে মেহেরগড়-সন্নিহিত অঞ্চলে ঋগবেদের রচনা, এবং তার
১০০০ বছর পরে, ভারতের দক্ষিণতম প্রান্তে শতপথ ব্রাহ্মণের রচনার মধ্যে ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক
ও কালানুক্রমিক সংযোগ-বিষয়ে তাঁর ব্যাখ্যাটি জানতে ইচ্ছা করে।
উপসংহারঃ একটি সম্ভাবনার
অপমৃত্যু
AIT একটি অকাট্য ও প্রমাণিত
তত্ত্ব, এমন দাবি আমি করি না। বস্তুত, কেউই করেন না। এমনকী ম্যালরিও, যিনি AIT-তত্ত্বের একজন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রবক্তা, বারংবার একে অনুমান-নির্ভর
হাইপথেসিস বলেই উল্লেখ করেছেন। এ-সম্বন্ধে শেষ কথা বলার সময়ে যে এখনও আসেনি,
সে-কথাও তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন।
গোটা ঋগবেদের কোথাও কোনোরকম অভিবাসনের স্মৃতি বা উল্লেখ না-থাকা সত্যিই খুবই
আশ্চর্যজনক। এছাড়া, পরবর্তীকালে, আসমুদ্রহিমাচল ভারতবর্ষে বৈদিক সাহিত্যের এমন গভীর
ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব AIT দিয়ে
পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যায় কি না, তাও আমার কাছে স্পষ্ট নয়। আর সেকারণেই, OIT-কে আমি উড়িয়ে দিই না। কিন্তু, বর্তমানে, এই তত্ত্বের সপক্ষে সত্যিকারের
তথ্যনিষ্ঠ গবেষণামূলক কাজ, বিশেষত প্রত্নতাত্ত্বিক কাজ, প্রায় নেই বললেই চলে। এবং,
আমরা দেখেছি, এই তত্ত্বের বর্তমান সমর্থকদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও অতীব সন্দেহজনক। যতদিন না এ-নিয়ে প্রকৃত বস্তুনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ ও
অ্যাকাডেমিক কাজকর্ম হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত একে
গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা মুশকিল। ব্রায়ান্ট তাঁর বইয়ের উপসংহারে কতকটা
অসহায়ভাবেই বলছেন, “an attempt was made to make a distinction between
Hindutva revisionism and scholarly historical
reconsideration motivated by a desire to reexamine the way
Indian history was assembled by the colonial power. Unfortunately, these two ingredients are not always easily distinguishable, nor
detachable.” তিনি আরো বলছেন, “The fact is that most
present-day Indologists have been generally unconvinced by
the limited exposure they have had with Indigenist
viewpoints because of the poor and selective quality of the arguments they encounter, not because they somehow have some mysterious
investment in insisting on an external origin for this
language group. Most Indologists are perfectly willing to
change their views if appealed to with informed reason and arguments that
address all the evidence... Practically speaking,
it is small Delhi publishers that are keeping the more
crude versions of the Aryan invasion theory alive by their
nineteenth-century reprints!”
বলে রাখা ভালো, যাঁরা বলেন AIT তত্ত্ব আজকের পণ্ডিতমহলে অচল, তাঁরা হয় এ-বিষয়ে
সাম্প্রতিক গবেষণার খবর রাখেন না, নয়তো ইচ্ছাকৃতভাবেই বিকৃত তথ্য পরিবেশন করেন।
এ-বিষয়ে, পুনরায়, ব্রায়ান্টের
বক্তব্য স্মরণ করা যাক—“the Aryan invasion model,
when trimmed of its excesses, still has much of its own
internally consistent logic and perspectives, and it remains a reasonable way
of accounting for a good deal of the available evidence.”
শুধু AIT
বা OIT-ই নয়, আমি এমনকী লেখকের প্রস্তাবিত বিকল্পটিকেও
নাকচ করতে চাই না। কিন্তু এই বিকল্পটিকে মান্যতা দেওয়ার জন্যে যে প্রমাণাদি
প্রয়োজন, তার কোনো নিদর্শন বইটিতে পাইনি।
অনেক পণ্ডিত আবার এ-ও মনে করেন যে,
প্রোটো-ইন্দো-ইয়োরোপীয় জনগোষ্ঠী নিয়ে মাথা ঘামানো, বা তাদের আদি-বসতির ঠিকানা
আবিষ্কারের চেষ্টা আসলে মরীচিকার পেছনে ছোটা। এটি একটি ভাষাতাত্ত্বিক মডেল মাত্র।
আর, ভাষা ব্যাপারটাই বস্তুত গোলমেলে; তা যে কখন কীভাবে পালটায়, সে-ব্যাপারে
স্থিরনিশ্চিত হওয়া দুষ্কর, এমনকী আধুনিক ভাষাগুলির ক্ষেত্রেও। তাহলে, আজ থেকে পাঁচহাজার বছর আগেকার কোনো ভাষার
ক্ষেত্রে ব্যাপারটা যে আরো বেশি অনুমাননির্ভর হবে তাতে সন্দেহ কী? অতএব,
ভাষাতাত্ত্বিক অনুমানের একটি কাঠামো-কে জোর করে প্রত্নতত্ত্ব দিয়ে প্রমাণ করার
চেষ্টা পরিত্যাগ করাই শ্রেয়। এ-বিষয়ে, ১৯১৪ সালে, শ্রীঅরবিন্দ একটি চমৎকার প্রবন্ধ
লেখেন “The Origins of Aryan Speech” নামে। তিনি বলেন, ভাষার উৎপত্তি, বিকাশ ও বিবর্তন-সংক্রান্ত আলোচনায়
তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব নিঃসন্দেহে একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ, কিন্তু একে ‘অকাট্য
বিজ্ঞান’ হিসেবে বিবেচনা করার বিপদ অনেক। বিশেষত, ভাষাভিত্তিক জাতিপরিচয় নির্মাণের
চেষ্টা শেষ অবধি জাতিবিদ্বেষের রূপ নিতে পারে, এমন আশঙ্কাও তিনি এই প্রবন্ধে
ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি লেখেন, “The races of India may be
all pure Dravidians, if indeed such an entity as a Dravidian race exists or
ever existed, or they may be pure Aryans, if indeed such an entity as an Aryan
race exists or ever existed, or they may be a mixed race with one predominant
strain, but in any case the linguistic division of the tongues of India into
the Sanskritic and the Tamilic counts for nothing in that problem. Yet so great
is the force of attractive generalisations and widely popularised errors that
all the world goes on perpetuating the blunder talking of the Indo-European
races, claiming or disclaiming Aryan kinship and building on that basis of
falsehood the most far-reaching political, social or pseudo-scientific
conclusions.” সন্দেহ নেই, হিটলারের উত্থানের প্রায় দু’দশক
আগে লেখা এই পংক্তিগুলি, শ্রীঅরবিন্দের আশ্চর্য দূরদৃষ্টির পরিচায়ক। ভাষাতত্ত্বের
কাঠামো অনুসরণ করে (বিশেষত, ঋগবেদের নানান চমকপ্রদ ব্যাখ্যার ভিত্তিতে)
আর্যসভ্যতার উৎস-সন্ধানের প্রচেষ্টাকে তিনি “philological
mirage and phantasmagoria” বলে অভিহিত করেন, এবং
বলেন, “The wider question of an early Aryan
civilisation must equally be postponed till we have sounder materials.” পরবর্তীকালের প্রত্নতাত্ত্বিক ও ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণা, এ-বিষয়ে যতটুকু
আলোকপাত করতে পেরেছে, আমি জানি না শ্রীঅরবিন্দ বেঁচে থাকলে সে-বিষয়ে কী বলতেন।
তবে, পণ্ডিতমহলের একাংশ যে
এখনও এই ধারণা পোষণ করেন, এ-কথা সত্য।
ফলে, সোজা কথায়, আর্যতত্ত্ব বা
প্রোটো-ইন্দো-ইয়োরোপীয় সমস্যার কোনো সরল, সর্বসম্মত সমাধান এখনও পর্যন্ত পাওয়া
যায়নি। অদূর ভবিষ্যতে পাওয়া যাবে কি না, তারও স্থিরতা নেই। আমি আশা করেছিলাম,
সুজিতবাবু তাঁর বইতে যাবতীয় তত্ত্ব ও প্রতিতত্ত্বগুলিকে আরেকটু নিরপেক্ষভাবে
বিশ্লেষণ করবেন, আরেকটু বিশদে ব্যাখ্যা করবেন তাদের প্রস্থানভূমি ও যুক্তিকাঠামো,
যাতে এ-বিষয়ে অনুসন্ধিৎসু পাঠক, বিশেষ করে যারা প্রথমবার এ-নিয়ে পড়াশোনা করছে,
একটি স্পষ্ট ও সার্বিক ধারণা করে নিতে পারে, নিজের যুক্তিবুদ্ধি-অনুসারে। কিন্তু, AIT ও OIT-র পারস্পরিক বাহাসে, AIT-র
প্রতি লেখকের মাত্রাধিক অসহিষ্ণুতা, এবং সমদর্শিতার অভাব, কোথাও যেন বেসুর হয়ে
বাজল, এবং বানচাল করে দিল একটি মহৎ সম্ভাবনাকে। এটাই আক্ষেপের বিষয়। আরেকটি কথাও
পরিশেষে না বললে নয়। গোটা বই-জুড়ে বাংলা-হরফে লেখা ইংরিজি শব্দ, বাক্যাংশ এবং
বাক্যের উপস্থিতি (বিশেষত অধ্যায়ের শিরোনামে) বিশেষ যন্ত্রণাদায়ক। লেখক বোধহয়
এ-ব্যাপারে আরেকটু যত্নশীল হতে পারতেন।
আর্যতর্কঃ একটি তাত্ত্বিক ক্রীড়াভূমি
সুজিত দাশ
প্রকাশক – আমি আর লীনা হেঁটে চলেছি
মূল্যঃ ৫০০ টাকা
No comments:
Post a Comment