Wednesday 28 March 2018

স্মরণ




                                               "এখন ওসব কথা থাক

এক লক্ষ বছর সঙ্গে থাকার পর সাব্যস্ত হবে, তুমি আমার কি না।
ওসব কথা এখন থাক।
এখন চলো মিকির পাহাড়ে বুনো কুল পেকেছে,
চলো খেয়ে আসি ।
লাল রুখু চুল
সূর্যাস্তের মধ্যে
অর্কিডের উজ্জ্বল শিকড়ের মতো উড়ছে।
-দেখি দেখি, তোমার তামাটে মুখখানা দেখি।

সূর্য এখনি অস্ত যাবে। পশুর মতো ক্ষীণ শরীরে
আমরা হাঁটু পর্যন্ত জলস্রোত পেরিয়ে চলেছি-
জলস্রোত ক্রমশ তীব্র..........কনকনে......"


আবার একটি নক্ষত্র পতন। সেই নক্ষত্র কবি মণীন্দ্র গুপ্ত। বাংলা সাহিত্যে তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি বাংলা সাহিত্যকে একটি অন্য মোড়ের সঙ্গে পরিচিত করায়। প্রবহমান ধারাকে নিয়ে যায় আবহমানতার দিকে।

মণীন্দ্র গুপ্তর জন্ম 1926 সালে। অবিভক্ত বাংলার বরিশাল জেলায়। কৈশোর কাটিয়েছেন অসমের বরাক উপত্যকায় মামার বাড়িতে। পড়াশোনা শিলচর এবং কলকাতায়। ইংরেজি সাহিত্যে বি এ করার পর তিনি ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।

কবিতা লিখেছেন চার-এর দশক থেকে। প্রথম কবিতার বই ‘নীল পাথরের আকাশ’। তাঁর কবিতা, গদ্যে অন্য একটি স্বাক্ষর পাওয়া যায়। সহজেই পাঠকের নজর কাড়েন তিনি। বাংলা কবিতার তৎকালীন অভিমুখের সম্পূর্ণ বিপরীতেই অবস্থান করছিল তাঁর রচনা। এর পরে প্রকাশিত হয় ‘মৌপোকাদের গ্রাম’, ‘লাল স্কুলবাড়ি’, ‘ছত্রপলাশ চৈত্যে দিনশেষে’, ‘শরৎমেঘ ও কাশফুলের বন্ধু’ অত্যাদি কাব্যগ্রন্থ। নয় এর দশকের শুরুতে  বের হয় তাঁর আলোড়ন তোলা প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘চাঁদের ওপিঠে’। 

 প্রকাশিত হয় আত্মজীবনী ‘অক্ষয় মালবেরি’-র প্রথম খণ্ড। তিন খণ্ডে বিন্যস্ত এই গ্রন্থ  বাংলা সাহিত্যের এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন।

সম্পাদনা করেছেন ‘পরমা’ পত্রিকা। কবি রঞ্জিত সিংহের সঙ্গে যৌথ ভাবে সম্পাদনা করেছেন ‘এক বছরের শ্রেষ্ঠ কবিতা’-র মতো সংকলন। হাজার বছরের বাংলা কবিতা নিয়ে ‘আবহমান বাংলা কবিতা’ একটি সংকলন তৈরি করেন, যা একটি বিরাট সময়কে বেঁধে রেখেছে। 
২০১০ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমী দ্বারা ভূষিত হন, এ রাজ্যের সর্বোচ্চ সম্মান "রবীন্দ্র পুরষ্কার"-এ তার "টুংটাং শব্দ নিঃশব্দ"-(২০০৫) এর জন্য। ১১'তে "সাহিত্য আকাদেমি" প্রাপ্ত তার কাব্য গ্রন্থটি ছিল "বনে আজ কনচের্টো"। 

তাঁর অন্যান্য কাব্য গ্রন্থের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল .........

‘নীল পাথরের আকাশ’, ‘আমার রাত্রি’, ‘মৌপোকাদের গ্রাম’, ‘লাল স্কুলবাড়ি’, ‘ছত্রপলাশ চৈত্যে দিনশেষ’,‘শরৎমেঘ ও কাশফুলের বন্ধু’, ‘নমেরু মানে রুদ্রাক্ষ’,‘মৌচুষি যায় ছাদনাতলায়’, ‘এক শিশি গন্ধহীন ফ্রেইগ্রানস’, ‘নিরক্ষর আকবর’

১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর। 

নিভৃতচারী, মঞ্চ-বিমুখ, আপসহীন এই উজ্জ্বল সাধক নক্ষত্র, মণীন্দ্রবাবু রেখে গেলেন আবহমান বাংলা সাহিত্যের জন্য আশ্চর্য কিছু অধ্যায়, আশ্চর্যতম গ্রন্থের কাল-কে। 

' ভিতরে একা, সুখী না, দুঃখীও না।
দশদিক অসীম শূন্য এবং চিররহস্য।'
বয়স তাঁকে বশ করতে পারেনি কখনো। বরং ঝলসে উঠেছিল তাঁর কলম। কখনো কবিতার সহস্র কুঠুরির ভিতর, কখনো ভাষার অন্দরমহলে আরো গভীর ভাষায় এক সুদূরতম সত্যের অন্বেষণে, মহাসময়ের দিকে তাকিয়ে থাকা তাঁর চোখ যখন অনুদিত হয়েছে তাঁর একটির পর একটি কবিতায়, আমরা আশ্চর্য হয়েছি। চিরকালীন এক ঘোরের মধে ডুবে গেছি। তাঁর আপামর কাব্যজীবন হল সেই অক্ষয় মালবেরি, এক অমৃত-কণা, যার জন্য সব ভাষার সব সময়ের সাহিত্য অপেক্ষা করে থাকে।

চলে গেলেন এক শান্ত, সুন্দর, আকাশের মত সহজ মহৎ উদার এক মানুষ। এক কবি।
আপনাকে প্রণাম কবি মণীন্দ্র গুপ্ত। আমরা ভাগ্যবান, বাংলা ভাষায় আপনার মত এক কবিকে পেয়েছি। এক চিরকালীন কবি। নশ্বরতা, যার কাছে হেরে যায়।
আসুন তাঁকে পড়ি। আরো পড়ি। তাঁকে কাছে রাখি আমাদের।


No comments:

Post a Comment