Saturday 17 March 2018

কণিষ্ক ভট্টাচার্য


ধারাবাহিক গদ্য

                                  জানলা 


                                                                                   






“কৃত্তিবাসা গ্রামে ছিল বাবু রাজকুমার, ও তার কীর্তি যত
ও তার কীর্তি যত বলব কত শুনতে চমৎকার
ধর্মে কর্মে মতিগতি অতি সদাচার, ছিল দেওয়ান তার
ছিল দেওয়ান তার কুলাঙ্গার কিসের মলানিস
মিশ্রীতে মিশায়ে দিল হলাহল বিষ, খেয়ে মিশ্রীজল
খেয়ে মিশ্রীজল হইল তল গেলাস ধরি হাতে
সর্বঅঙ্গ জ্বলি গেল দারুণ বিষের তাপে, দারুণ বিষের জ্বালা
দারুণ বিষের জ্বালা শরীর কালা সহিতে না পারি
এমন সময় কোথায় ছিল রাজুয়া ভাণ্ডারী, এমন শিষ্য যার
এমন শিষ্য যার ভাবনা কী তার ডঙ্কা মেরে ফেরে
দিন চারিকার সুখ করিল দোতলায় বসিয়ে, ব্যাটা নিজে গাধা
ব্যাটা নিজে গাধা হারামজাদা আলা চালের বাউন
পেটটা চিরা বার করুম তোর ঘৃত্য ননী খাওন।”

এক বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতারণা, হত্যা আর প্রতিহিংসার কাহিনি শুনতে শুনতে গত শতকের সাতের দশকের শুরুতে ঘুমত দুই খুড়তুতো জ্যাঠতুতো ভাই। গাজিগানের মতো সুরে গাওয়া সেই ঘুমপাড়ানিয়া গান কবে কোথা থেকে এসেছে তারা জানত না। গানের আলম্বন বা আখ্যান বোঝার বয়েস তখনও তাদের হয়নি। কেবল সেই গাজিগানের মতো একটানা সুর, দুই শিশুকে শান্ত করে ঘুম পাড়িয়ে দিত। ঘুম পাড়িয়ে দিত পৃথিবী জুড়ে উত্তপ্ত হয়ে ওঠা এক দশকের শুরুতে। ভিয়েতনামে সেনা পাঠানোর বিপক্ষে বিক্ষোভে তখন ওহিও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের ওপর গুলি চলছে। প্যারিসে তখন বিক্ষোভে কেঁপে উঠছে বিশ্ববিদ্যালয় আর ছাত্রছাত্রীরা প্রতারিত শ্রমিকশ্রেণিকেও তাদের আন্দোলনের পাশে চাইছে। এদেশে বাইশ-তেইশ বছরের স্বাধীনতার বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনিকে গ্রাম দিয়ে ঘিরে ফেলতে চাইছে বাইশ তেইশ বছরের ছেলেমেয়েরা। একদিকে শ্রেণিশত্রু ভাগচাষিকে খতমের প্রতিহিংসায় দেদীপ্যমান তাদের চোখ। অপরদিকে রিভলবারের পাল্লায় সেই এলিট কলেজের ছেলেমেয়েদের পেলে রাষ্ট্রের তর্জনী তৎক্ষণাৎ ট্রিগার ছুঁয়ে জাতীয়তাবাদী পবিত্রতার পরীক্ষা দিচ্ছে। বাইশ তেইশ বছর বাদে এবার আর ধর্ম নয় এখন বরং মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত হয়ে উঠছে পাশের দেশের প্রতারিত ছাত্রছাত্রীরা।

যুদ্ধ, মন্বন্তর, দাঙ্গা আর দেশভাগের বিশ্বাসঘাতকতায় প্রতারিত এক বৃদ্ধ, উত্তপ্ত কলকাতা শহরে দুই নাতির মাথার কাছে বসে তার দুই হাতের পাতা তাদের চোখের ওপর দিয়ে তাদের ঘুম পাড়াচ্ছেন। চোখ কাটানো সেই বৃদ্ধের। মোটা কাচের ভিতর দিয়ে সামান্য খোলা চোখকে মনে হয় যেন বিশাল। মাথার চুল সাদা। পাতলাও হয়ে এসেছে। খালি গায়ে কাঁধ থেকে নেমে এসেছে উপবীত। ধবধবে সাদা ধুতি পরা। জোড়াসনে বসে রয়েছেন বৃদ্ধ। মেরুদণ্ড সোজা। তার গলা উদাত্ত। উচ্চারণ স্পষ্ট। তিনি কলকাতার কলঘরে টালার জলে স্নানের সময় মাঝে মাঝে চণ্ডীপাঠ করেন। পাঠ ঠিক নয়। আবৃত্তি। স্মৃতি থেকে। আবৃত্তির সময় তার গলা ভেঙে আসে। চোখ দিয়ে জল নামে। অথচ তিনি আবার পূজাআর্চা তেমন করেন না।

“দেবী প্রপন্নার্তিহরে প্রসীদ, প্রসীদ মাতর্জগতোহখিলস্য।
প্রসীদ বিশ্বেশ্বরি পাহি বিশ্বং, ত্বমীশ্বরী দেবি চরাচরস্য।।
আধারভূতা জগতস্ত্বমেকা, মহীস্বরূপেণ যত: স্থিতাহসি।
অপাং স্বরূপস্থিতয়া ত্বয়ৈতদ্ আপ্যায্যতে কৃৎস্নমলংঘ্যবীর্যে।।”

ছেলেটি সেই বৃদ্ধকে দেখেনি। ঠাকুরদার মৃত্যুর পর ওই দশকের দ্বিতীয় ভাগে তার জন্ম। তাকেও ঘুম পাড়ানোর সময় এই একই প্রতারণার গান গাইত তার এক পিসি। সেই পিসি বয়েসে বাবার থেকে অনেক বড়ো, বরং দেখলে মনে হয় তার ঠাকুমার থেকে খানিক ছোটো। তাঁর সিঁথিতে চওড়া সিঁদুরপরা, দেশভাগের সময় স্বামী পরিত্যক্তা আর এক প্রতারিতা তিনি। কোথাও কাঁটাতার ঘিরে বিদেশ হয়ে যাওয়া এক গ্রামের তুতো সম্পর্কের কাকার আশ্রয়ে যিনি বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবেন সেই কাকার পরিবারের খিদমত খেটে। তুতো ভাইয়ের ছোটো ছেলেকে ভাতের শেষ দলা খাওয়ানোর পরে তিনি ছেলেটিকে বলবেন, “চাছিমুছি যে খায়—।” ছেলেটি মুখস্ত করা বাক্যটি সম্পূর্ণ করবে অস্পষ্ট উচ্চারণে, “রাজার জামাই সে হয়।” তিনি ইমারজেন্সি জারি হওয়া এক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ভাবি রাজার জামাই হওয়ার সম্ভাবনাময় শিশুটির মুখে থালার চাছিমুছি দিয়ে সুর টেনে বলবেন, “সমস্যা—।” ছেলেটি বলবে, “সমাধান।”

তখন খবরের কাগজ যতই সাদা খোপ খোপ আসুক না কেন, ট্রেন ঠিকঠাক চলে জেনে এবং পুলিশ আর ঘুষ নেয় না ভেবে সাধারণ মধ্যবিত্তের একটা অংশ ‘সব সমস্যা সমাধান’ ভেবে এশিয়ার মুক্তিসূর্যের জয়গান করে। একটি নপুংশক জাতির নির্বীর্যকরণকে বিঁধে কবিতা লেখেন এক কবি সেই শহরে বসে। সেইসময় এইভাবে এক নারী তুতো ভাইয়ের সন্তানকে ভাত খাওয়ানোর সমস্যা সমাধান করে নিজের নিঃসন্তান জীবন অতিবাহিত করবেন এক প্রজন্মে পুতা, পরের প্রজন্মে মেজদি আবার তার পরের প্রজন্মে পুতা পরিচয়ে। তৎসম পূতা মানে পবিত্র, বিশুদ্ধ নারী আর পূর্ববঙ্গের ভাষায় পুতা মানে নোড়া, যা দিয়ে কিছু থেঁতো করা হয়। বাংলা উচ্চারণে হ্রস্ব আর দীর্ঘ স্বরের আলাদা উচ্চারণ নেই। সে নারী ভাষাতত্ত্ব জানতেন না। অক্ষরজ্ঞান ছিল। যতদূর ছেলেটির মনে পড়ে কাগজের হেডলাইন পড়তে পারতেন তিনি। তারপর একদিন পানের রসে রাঙানো লাল জিভ, লাল আলতা ঢাকা ফাটা পা আর সিঁদুর লেপা লাল কপাল নিয়ে  পূত ইলেকট্রিক চুল্লিতে উঠে সেই নিঃসন্তান পতিব্রতা বিদ্যুতগতিতে স্বর্গে পৌঁছবেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যে বছর শুরু হয় সেই উনিশশো চোদ্দ সালে ফরিদপুর জেলার মাদারিপুর সাবডিভিশন থেকে কলকাতায় আসে বন্দ্যোপাধ্যায় পদবী ও ভট্টাচার্য উপাধিক একটি ছেলে। তার গ্রামের ইস্কুলের হেডমাস্টারমশাই কাকে যেন চিঠি লিখে দিয়েছিলেন কলকাতা শহরে। সেই চিঠি নিয়ে সিটি কলেজে বিএ পড়তে ঢোকে ছেলেটি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাগজপত্রে দেখা যায় সে রুশ বিপ্লবের বছরে বিএ পাশ করে। পারিবারিক গল্পকথায় শোনা যায় কোনও এক আত্মীয় দাদার কাছে ছেলেটির থাকার ব্যবস্থা হয় কলকাতায়। কোনও এক অজ্ঞাত কারণে সেই দাদার সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় কদিন শিয়ালদা স্টেশনে রাতে থেকে দিনে কলেজ করে ছেলেটি। সেই সময় থেকে শুরু হয় টিউশনি। এবং কলেজ আর টিউশনি মিলিয়ে উত্তর কলকাতায় থেকে যাওয়া। আর রায়মশাই যেমন বলেছিলেন, বাঙালির প্রিয় শব্দ – স্ট্রাগল।
সে একেবারে যেন বিভূতিভূষণের অপুর কাহিনি। তবে, ছেলেটিও সম্ভবত বিভূতিভূষণের সমবয়সী, সে যখন কলেজে ভর্তি হয় তখন বিভূতিভূষণের বয়েস কুড়ি। বিগত শতকের শুরুর দিকেই উচ্চবর্ণের হিন্দু বাঙালি পরিবার প্রকৃত সুযোগসন্ধানীর মতো ঔপনিবেশিক ইংরেজি শিক্ষাই যে ভবিষ্যৎ সেই সারসত্য বুঝে নিতে দেরী করেনি। এমনকি উপনিবেশের কেন্দ্র থেকে সুদূর ফরিদপুরে বাস করেও। তাদের বন্দ্যোপাধ্যায় পদবী আর ভট্টাচার্য উপাধি বুঝিয়ে দেয় যে তাদের পেশা ছিল অধ্যাপনা এবং আবশ্যই তা নির্বিকল্প সংস্কৃত টুলো-পণ্ডিতি। সেই গ্রামীন শিক্ষাব্যবস্থার অগ্রবর্তী অংশ কী অনায়াসে আঠেরোশো সাতান্নয় উপনিবেশের জেঁকে বসার মাত্র পঞ্চাশ বছরের মধ্যেই দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার পাট তুলে সদ্য স্থানান্তরিত রাজধানীতে ঔপনিবেশিক কলেজে পড়তে চলে! প্রশ্ন জাগে, যে যৌথ পরিবারের একাধিক পুত্রসন্তান গ্রাম ছেড়ে উপনিবেশের রাজধানীতে পড়তে আসে তাদের নিশ্চয়ই খুব অভাব ছিল না। কেবল টুলো-পণ্ডিতির উপার্জনে নিশ্চয়ই তা অতিবাহিত হত না। জমিজমা তাদের ছিল বলেই জানা যায়। আবার নিশ্চয়ই সেই জমিজমা থেকে তাদের তেমন রোজগার ছিল না। তা থাকলে শহরে এবং আধুনিক শিক্ষার মাধ্যমে রোজগারের ডেস্পারেশন থাকার কথা নয়। খুব কম বয়েস থেকে উত্তর কলকাতায় টিউশনি করার কারণে সারাজীবন অন্য চাকরি করলেও তাঁর পরিচয় ছিল মাস্টারমশাই। শ্রীমানী বাড়ির সন্তানদের প্রায় প্রজন্মানুক্রমে পড়ানোর দায়িত্ব ছিল তাঁর। সেই মাস্টারমশাইকে তাঁর যে নাতি দেখেনি সেও যখন ছোটোবেলায় স্কুল থেকে ফেরার পর শ্রীমানী বাড়ির ঠাকুর তৈরি দেখতে যেত তখন সেও শুনেছে, মাস্টারমশাইয়ের নাতি এসেছে।

পাশ করার পরে কোনও এক সাহেব কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছিল সেই ফরিদপুর থেকে আসা ছেলেটি। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সেই চাকরি তাকে ছাড়তে হল ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে গণ্ডগোলে। একে ইমিডিয়েট বসের সঙ্গে তখন তার অফিসের মধ্যে কথা কাটাকাটি চলছে, এমন সময় খোদ সাহেব এসে চিৎকার করে তাকে বলে, “হোয়াই আর ইউ শাউটিং?” সে তার এককাঠি ওপরে গলা চড়িয়ে বলে, “আ’য়াম নট শাউটিং স্যর। দিস ইজ মাই ন্যাচারাল ভয়েস।” --- বাঙাল আর কাকে বলে !

রেলকোম্পানিতে চারকি পায় ছেলেটি। সেই চাকরি বোধহয় থেকে যায় উপনিবেশের শিক্ষায়। বেশিরভাগ চাকরিজীবন কাটায় শিয়ালদায়। পরে কিছুদিনের জন্য ট্রান্সফার হয় কার্শিয়ং। তার বিয়ে হয় ঢাকার নিকটবর্তী কোনও এক জমিদারের দেওয়ানের কন্যার সঙ্গে। তার প্রথম কন্যাটি কেবল দেশের বাড়িতে গিয়ে জন্মায় বাকিরা কলকাতার মেডিক্যাল কলেজে। প্রথম পুত্রটি জন্মানোর সময় সাহেব ডাক্তারের বিরুদ্ধে নেগ্লিজেসের লিখিত অভিযোগ জানায় সেই সদ্য পিতা। সম্ভবত ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার ন্যায় বিচারের প্রতি আস্থায়। সেই পুত্র যখন দুবছরের তখন তাকে কাঁধে চাপিয়ে রবীন্দ্রনাথের শেষযাত্রা দেখে সে হ্যারিসন রোডের কাছাকাছি কোথাও দাঁড়িয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর দেশের বাড়িতে পাকা ঘর তুলবে বলে ইট কাটানোর ব্যবস্থা করে সে। তখন পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ কেউ তাকে নিষেধ করে বলে, “কিছুদিন অপেক্ষা করো। দেশের অবস্থা ভালো নয়।”   

গান্ধীর প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস সত্ত্বেও দেশের অবস্থা আর কোনোদিন ভালো হয় না। সাতচল্লিশের পর কিছুদিন এমনিই যাওয়া যেত ‘দেশে’। কিন্তু সে আর কখনও যায়নি বস্তুত দেশভাগের তেত্তিরিশ বছর আগে ছেড়ে আসা দেশে। কোনও বিনিময় সম্পত্তি খোঁজ করেনি এদেশে। আমৃত্যু সেই শ্রীমানীদের ভাড়ার ফ্ল্যাটে কাটিয়ে গেছে। তবু তার তিনটি ছেলে চারটি মেয়ে সর্বমোট সাতটি সন্তান হয়েছে। আজীবন কংগ্রেসের প্রগতিশীল অংশকে সমর্থন করেছে কিন্তু যখন তার ছেলেরা গেছে কমিউনিস্ট পার্টির কাছাকাছি তখন আপত্তি করেনি। দেশভাগের আগে থেকে কলকাতায় বসবাসের কারণে দেশভাগের পরে পঁচিশ বছর ধরে ‘দেশের বাড়ি’র মানুষদের দায়িত্ব বহন করেছে। উপনিবেশের প্রভাবে ভারতে ইংরেজি শিক্ষায় প্রথম জেগে ওঠা, চাকরিজীবী মধ্যবিত্তের মাজা ভেঙে দিয়ে বাংলা ভাগ করেছে রাজনীতি। ফলে একটি উত্থান আর পতনের আখ্যানকে ভূমিকা থেকে উপসংহার পর্যন্ত পরে ফেলেছে সে। তার নিজের যৌথ পরিবারের দায় টানা দুইপুত্র আর পরবর্তীকালে এক কন্যাকে দেখেছে কেবল টিকে থাকার জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে। বড়ো ছেলেকে ডেকে বলেছে। “কখনও নিজের জন্যেও কিছু রাখো।” ‘মেঘে ঢাকা তারা’র মতো সেই প্রথম পুত্রকেও যক্ষ্মা হয়ে যাদবপুর টিবি হাসপাতালে ভর্তি হতে দেখেছিল সেই বৃদ্ধ। আর দুই নাতিকে কোনও এক কৃত্তিবাসা গ্রামের বাবু রাজকুমারের আখ্যান শুনিয়ে ঘুম পাড়ানোর সুযোগ তিনি পেয়েছেন মাত্র তিন বছর। সেই শতকের বাঙালির জীবন সেই অপু থেকে নীতা পর্যন্ত সত্যিই সিনেম্যাটিক।

কোথায় কৃত্তিবাসা গ্রাম আর কে সেখানকার জমিদার বাবু-রাজকুমার, তা এখনও গুগলজ্যাঠা জেনে উঠতে পারেননি। কোনও ভ্যলিউম করা খবরের কাগজের কাটিং নেই তাঁর তাকে। কবেকার কোন প্রতারণার ঘটনা তখনকার সেই কৃত্তিবাসা গ্রাম ছেড়ে উপনিবেশের কেন্দ্রে পেট্রিয়টিজমে উদ্বুদ্ধ কোনও দেশীয় খবরের কাগজ সম্পাদকের দপ্তরে পৌঁছয়নি নিশ্চয়ই। অথবা পৌঁছলেও খবর হয়ে ওঠার মর্যাদা পায়নি সেই ঘটনা। বঙ্গদেশের কোন অঞ্চলে এই ঘটনা ঘটেছিল তারও কোনও সাক্ষ্য নেই পাঠে। দেওয়ানের শাস্তি হয়েছিল কিনা তাও জানে না কেউ। তবু মৌখিক সেই কানে শোনা কাহিনি বংশ পরম্পরায় বয়ে আসে সাতের দশকের শেষের কলকাতা শহরে। তার শিকড়ের সঙ্গে কোথায় তার যোগ না জেনেই সেই গান তাদের মুখস্ত হয়ে যায় জাম্বিয়ার থেকে আমেরিকায় তুলে আনা কুন্তা কিন্তের আখ্যানের মতো। ইতিহাস বইয়ের মহৎ সাম্রাজ্যের পুতুল সেই ফরিদপুরের বন্দ্যোপাধ্যায় পদবিক ভট্টাচার্য উপাধিধারী মানুষ আর জাম্বিয়ার কুন্তা কিন্তে। তাদের কোথায় কোনও শিকড় থাকে না। নতুন মাটিতে নতুন করে বাঁচতে, নাকি টিকে থাকতে শিখে নিতে হয় সেই গাছকে।

মাস্টারমশাইয়ের যে নাতি সেই মাস্টারমশাইকে দেখেনি, কখনও ফরিদপুর দেখেনি, শ্রীমানীদের ভাড়ার ফ্ল্যাট ছেড়ে এসেছে সেই কবে – সে যে কোন ইতিহাসের সুতোর সঙ্গে তার আত্মজাকে জুড়ে রাখার তাগিদে এই বিশ্বায়ন পরবর্তী পৃথিবীতেও, তাকে দুর্গাপুজোর সময় শ্রীমানীদের বাড়ির ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যায় – তা কি সে নিজেও ব্যাখ্যা করতে পারবে!

কেন সে তার কন্যাকে শোনায়, “কৃত্তিবাসা গ্রামে ছিল বাবু রাজকুমার, ও তার কীর্তি যত” ...
(ক্রমশ) 

No comments:

Post a Comment