পাথরের কাপালিক, শুকনো জবা, তাজা রক্ত
জলের গভীরে ছিলে । মনে হত শান্ত নিরামিষ
তোমার স্বভাব । পাখনায় আলতো দ্যোতনা
দেখেছি । স্বভাবদোষ বলতে পারো তুমিও সেটিকে
অতর্কিতে কাছে এলে । ঢেউ উঠল জলের তলায়
করাতের মতো তীক্ষ্ণ ঢেউ ।
নুনে-ভেজা শরীরের প্রতিরোধ আর কতটুকু !
এখন যা পড়ে আছে, বিশ্বাসের বালির কঙ্কাল
অবিন্যস্ত সূর্যঘড়ি, গুঁড়ো গুঁড়ো কাচ
আমার যুবতী রক্তে স্মৃতি আর দাঁত রেখে
ফিরে গেছে হিংস্রতম মাছ...
অন্ধের স্পর্শের মতো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখা খসখসে অক্ষর, মাইলস্টোনের বুকে জমে থাকা
সবুজ আবেগ, বন্ধ্যা জড়ায়ু থেকে ছিঁড়ে আনা শেকড়েক অলিখিত বিষাদপ্রতিমার শরীরে
লেপ্টে থাকা ছেনি-হাতুড়ির দাগ কবি শাশ্বতী সান্যালের দ্বিতীয় কবিতাবই ‘ব্রেইলে
লেখা বিভ্রান্তিসমূহ’-র প্রধানতম কয়েকটি দিক্চিহ্ন । এই কবির কলমে ভর করে আছেন
এমন এক তেতো অসৌন্দর্যের দেবী, যাকে, আপাতভাবে কোনো বিশেষ সংস্থানে ধরা যায় না ।
অথচ, তা শরীরের ভিতর চারিয়ে দেয় এক তীব্র অস্বস্তি আর মেদুর সংরাগ । প্রতিটি অক্ষর
হয়ে ওঠে এক বিশেষ ধরনের নাশকতার চিহ্ন । যার ভিতরে অন্ধকার জন্মবীজ । এই
চোরাগোপ্তা ভায়োলেন্স তাঁর কবিতাকে এক বিশেষ ধরনের স্থায়িত্ব ও আকার দিয়েছে । আমরা
যে জীবনের ভিতর বেঁচে রয়েছি, তার নিহিত সন্ত্রাসকে চিনে নিতে পারাই আজ কবির অন্যতম
প্রধান কাজ । শাশ্বতী এই অল্প সময়েই সেই বাইরের দৃশ্যপট ছিঁড়ে-ফেলা অন্তর্নিহিত
কালো রক্তপটকে চিহ্নিত করতে পেরেছেন । তাই তাঁর লেখায় ফুটে ওঠে এরকম সব পঙ্ক্তি :
সমুদ্রসম্ভবা, তবু অভিশাপ লেগেছে খুনির
সে তোমাকে মেরে মরবে । কলমে দিয়েছে বিষ ঢেলে
খরিশ কেউটে । দেখো, রক্ত ক্রমে নীল হয়ে যায়
শব্দময়ী ছিলে । সেই সুসময় চিহ্ন আশরীর
গোড়ালিতে লেগে ছিল ভালোবাসা, ঘন পাটক্ষেত
গভীর জলের হ্রদ, আজ যার নাম কালিদহ
ঢেউ ভেঙে ভেঙে তুমি বরাবর সাঁতারে রূপসী
তবু গলে-যাওয়া চোখে দৃষ্টির আগুন
ক্রমে বিস্ফারিত হল, চামড়া ফেটে পচা রক্ত পুঁজ
সমুদ্রসম্ভবা ছিলে, পুড়ে গেলে কাকে ভালোবেসে ?
তোমাকে বলেনি কেউ—নাগচম্পা ফোটে না এদেশে ।
‘নাগচম্পা’ এখানে এক বিশেষ মোটিফ, যার মধ্য দিয়ে বিষাক্ত অনুভূতি আর কষাটে
ঘ্রাণ একত্রে মিশে যায় । যা, শাশ্বতীর কবিতার ওই নিষ্ঠুর অন্ত্যজ প্রদেশকে
খুঁজে-ফেরা জার্নির অনুরণন হয়ে ওঠে । এই অন্ধকার আসলে তাঁর কবিতার অভিজ্ঞ।ন ।
‘সন্ধিপুজো’ কবিতায় যেমন, “মাংশাসী রাতের গন্ধ, রোগা কাঁসি, ধুনুচির নাচ / তবু এ
শহর জানে মৃগনাভি, স্পর্শের ছাতিম / গন্ধ পিছু নেয় আজও অন্ধকারে, অষ্টমীর জ্বরে”,
যেখানে মেয়েরা তাদের ‘প্রলম্বিত মেয়েবেলা’ শেষ করে “চোখে ক্লান্তি । রাত্রি জাগা
ছাপ/ কোঁচড়ে কারোরই আর আলোফুল নেই”—এই তীব্র ‘নেতি’-র গহ্বরে মিশে থাকে, তেমনই
গোটা কবিতাবইয়ের পাতায় পাতায় ছড়ানো থাকে এক তীব্র দহনের রেট্রোস্পেক্টিভ, এক ভয়ানক
অন্তর্জ্বালার মেটাফর :
বিনিময়যোগ্য নয় এ-রকম কিছু কিছু পাপ
আমাদেরও রয়েছে রসুল
লোহার বাসরে ছিদ্র ভুল
ভুল তীব্র কালোবিষ, দংশনের যুগল স্মারক
সেই থেকে আদরের নখ
বড়ো হয়, সুসজ্জিত, নেলকাটার ছোঁয়াই না তাকে
জ্বর আসে, শরীর নাপাকে
স্নানসহ উষ্ণ সিলেবাস...
নির্জলা নাভির পাপ ছিঁড়ে খায় পদ্মের সুবাস
মধুগন্ধ ভরে পাপীদেহ
রসুল, বাঁচিয়ে রেখো আমাদের সুখে ও সন্দেহে...
শাশ্বতীর শব্দব্যবহার রীতিমতো পরিণত, বাক্প্রতিমা ও প্রতীকের স্বেচ্ছাচারী
প্রয়োগ তাক লাগিয়ে দেয় । এমন এক পরিণত কলম রয়েছে তার, যে, মাঝে মাঝে ভুলে যেতে হয়,
সদ্য তিরিশের কোঠায় পা রেখেছেন তিনি । এই সময়ের কবিরা, যাদের সমবেত ভাবে ‘একের
দশকের কবি’ আখ্যা দেওয়া হচ্ছে, তাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্যই হল এই পরিণত যৌথ-ভাষার
আঙ্গিক, যা তাদের শুরুতেই বিশিষ্ট করে তুলেছে, আমার স্থির বিশ্বাস শাশ্বতী সেই
সমূহের একজন হয়েও খুব দ্রুত নতুন দিনের বাংলা কবিতায় নিজের আসনটি পাকা করে নেবেন,
নিজের কব্জির জোরে । তাঁর এই সদ্যপ্রকাশিত কবিতাবই এই মুহূর্তের বাংলা কবিতার
সম্পদ ।
‘ব্রেইলে লেখা বিভ্রান্তিসমূহ’/ শাশ্বতী সান্যাল ।। ‘তবুও প্রয়াস’ প্রকাশনী,
বিনিময় ১১৯ টাকা ।
No comments:
Post a Comment