Saturday, 24 March 2018

অভিরূপ মিত্র



সমরাস্ত্রের দামে চুরি যাওয়া সময়ের পাঁচালি




সাহিত্য কি ভাষার ইতিহাসে বহমান উপাদান? সেই অর্থে দেখতে গেলে সাহিত্যের ইতিহাস হয়ত ভাষায় যে পরিবর্তন আসে অংশতঃ তারই ইতিহাস। সেই পরিবর্তন হতেই পারে পরবর্তী সাহিত্যভাষার দিঙ্‌নির্দেশিক। ‘যেদিন প্রথম ছেলেটি জানতে পারে সেইসব গাছেদের কথা যারা কেবল মানুষের অভিশাপেই শুকিয়ে যায় সেই দিন শনি-রবি বা অন্য কোনও ছুটির দিন না থাকলেও মেয়েটি বেরোয়নি। ছতলার ফ্ল্যাটের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে ছিল সূর্য ওঠার আগেই এবং একটা অন্তর্লীন সম্ভাবনার গল্প বলেছিল ছেলেটিকে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে, যা কেবল তার জন্যই বুনছিল মেয়েটি’। (কৃষ্ণগহ্বরের স্মৃতিফলক) গদ্যের এই বাঁধুনি কি শুধুই কাব্যগর্ভা? মনে হয় না, মৃতবৎসা কথার মিছিলের বাইরে দাঁড়িয়ে, এদের যাওয়ার সম্ভাবনা পথের দিকে চেয়ে জিরোই দুদন্ড? এ ভাষায় গড়ে ওঠা আখ্যান হয়ত লেখক-পাঠক উভয়কে নিয়ে ভরসা খোঁজে আগামীর কাছে : ‘আমরা রোদ্দুর আনতে পারব তো?’ (তদেব)
আমাদের ঠিক একশ বছর আগে যারা তারা যুদ্ধের বিভীষিকায় শোকদিগ্ধ। সেই অনুভূতি সমষ্টিগত। আর আমরা একার শোকের প্রজন্ম। আমাদের সূর্যাস্তহীন দৃষ্টিক্ষীণতায়ও ‘বৃষ্টি ভেজা স্কাইস্ক্র্যপাররা’ দাঁড়িয়ে থাকে ‘প্রাচীন রহস্যময় বাওবাবের মতো’। এখনো যারা হারিয়ে যাইনি সম্পূর্ণতঃ, আত্মগত গ্রহাণুতে, তাদের হয়ত মনে পড়ে আঁতোয়াঁ দ্য স্যাঁত এক্‌জুপেরির ছোট্ট রাজকুমারের কথা। সে তো মনে করিয়ে দিয়েছিল, বাওবাবের বিপদ সম্পর্কে ভুলে যাওয়াটা কতটা বিপজ্জনক। এমন কি এ বিষয়ে অজ্ঞতাটাও ঝুঁকিপূর্ণ।
আসলে বাওবাবের মত বিপদকে ঠেকিয়ে রাখা সংগ্রামেরই নামান্তর। স্মৃতির সঙ্গে বিষ্মরণের। প্রথম পক্ষ যত সবল হয় ততই যুক্তিগ্রাহ্য হয়ে ওঠে শিকড়ের ডানা। ছবিতে জীবশ্ম হয়ে থাকা ফেলে আসা সময় নৈঃশব্দ্যে অপেক্ষায় থাকে তার, যার নাম প্রজ্ঞা। সেই প্রজ্ঞা দেখে ‘ডোডো পাখির নামাঙ্কিত একটি স্মৃতি পুরস্কারে’ কীভাবে বিভূষিত হয় অচেনা আপোষ। লুম্পেন ইন্টেলেজেন্সিয়া তো আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। তারা স্বভাবতই প্রান্তিক করে রাখতে চাইবে সেই প্রজ্ঞাকে, মা-খু-চিহল-ও-পঞ্জম-হস্তম-এর উত্তরাধিকার বহন করে ২০০৪ সালেই সে দেখতে পায়, বুঝতে পারে, তোমার আমার ওতপ্রোত, আধার আলোয় পণ্য হলো, যা কিছু আজ ব্যক্তিগত। (সময়ের উপাদান)
ভূমিকার বদলে লেখা নিদ্রিত মাঝে অতি জাগরিতের কন্ঠস্বর শুনে যিনি বসবেন এক রোচিষ্ণু পাঠের অভিজ্ঞতা নিতে, কেবলমাত্র, এবং অনায়াসে, তাঁর চেতন অংশে অনেক কিছু কূটাভাস মেঘাচ্ছন্ন থেকে গেলেও, অবচেতনে ভেসে যেতেই পারে একের পর এক অমূলতরু দৃশ্যকল্প। সেগুলিকে একটা গ্রন্থিতে আবিষ্কার করা পঠনশৈলীর নিজস্বতা। তখন কোথায় লেখক? এই বই পড়তে গেলে বিনির্মাণের বাতায়নগুলো উন্মুক্ত রেখে এগুনোই বাঞ্ছনীয়। ‘কৃষগহ্ববরের স্মৃতিফলকেরা’ মুদ্রিত আছে যে চিৎপুরে তার প্রবেশদ্বার দেবাশিস সরকারের চিত্র শিল্প অনুসরণে কণাদ নন্দী অলঙ্কৃত করেছেন তেমনি ‘সৃষ্টিসুখ’বশতঃ। মঞ্চসফল সাহিত্যিকদের অনেকেই যখন বাজার ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টায়, প্লট না খুঁজে পেয়ে আশ্রয় নিয়েছেন ব্যক্তিগত সম্পর্কের সোপ অপেরাধর্মী প্রলম্বনে অথবা ঐতিহাসিক ঘটনার নিরাপদ কোলে, তখন কণিষ্ক ভট্টাচার্য্যের মতোই কেউ কেউ - ‘না-হয়ে ওঠা ইতিহাসের অধ্যাপক আর প্রতিবিপ্লবের জাতক মুগ্ধ ছিল জাদুতে আর জাদুর মধ্যে বাস করতে করতে এক সামগ্রিক জাদু নির্ভরতাতেই তারা স্বস্তি বোধ করত। তাই জাদুহীন পথেও যে চলা যায় এ সম্পর্কে তারা কখনওই ভাবেনি কারণ জাদু তাদের সামগ্রিক নিরাপত্তা দিয়েছিল’ (প্রতিফলনের সূত্রাবলী) - আখ্যানের শরীরে গুঁজে রাখতে পারেন এমন ল্যান্ড মাইন।
তিনটি অংশে - কৃষ্ণগহ্ববর, শ্বেতবামন ও লালদৈত্য - এবং তন্মধ্যে প্রতিটিতে চারটি উপাংশে বিভাজিত এই গদ্যমালার বিন্যাসগত লেখককৃত কারণ একরকম হলেও, পাঠক অনুভূত হেতু বহুরকম হওয়া কি অস্বাভাবিক? নামগল্প বলে মনে হয় যেটিকে, ‘কৃষ্ণগহ্ববরের স্মৃতিফলক’, দ্বিতীয়াংশের প্রথম উপাংশে ফিরিয়ে আনে অজন্মের স্মৃতি (সেই সব ফুলদল)। এবং তৃতীয় উপাংশের প্রথম গদ্যে (পৃষ্ঠা ৬২, দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ) ব্ল্যাক হোল চোরাগোপ্তা উঠে আসে আখ্যানের বয়ানে। শুষে নেয় ক্ষমতাকে প্রশ্ন করার স্পর্ধা। তবুও যাতে আমরা ভুলে না যাই, মৃত নক্ষত্রই জন্ম দেয় অন্ধকূপের এবং যুগপৎ, ‘বেড়ালের রঙ বিচারের থেকে ইঁদুর ধরার ক্ষমতার সময়কাল থাবা বসায় মানচিত্র জুড়ে’ (প্রতিফলনের সূত্রাবলি) সে ব্যপারে লেখক সতর্ক।
শব্দকে বর্ণ চিহ্নে ভেঙে পড়তে দেখে ‘স্তব্ধতার কর্কট’। চারিদিকে উঁচু উল্লাস আর তার মাঝে এক অক্ষরজীবী কপি এডিটর। ‘যারা কথা বলে না তাদের কি মন নেই, মনে হয় তার। যারা শব্দ করে কিন্তু সেটা ভাষা হয়ে ওঠে না তাদের, সেগুলো কি প্রাক ভাষা স্তরের কিছু’। মানব অভিব্যক্তির এই আকুতির মধ্যেও গল্পটা ভাসিয়ে তুলতে পারে নরওয়ের অন্তরভিব্যক্তিবাদী শিল্পী মুনরোর ‘দ্য স্ক্রীম’ নামক চিত্রচতুষ্ঠয়ের স্মৃতি।
যেহেতু গণঅবচেতনে ‘বিপ্লবীর গোপনাঙ্গ জানে পুলিশের রুলের মহিমা’ (নাগরিক) মামড়িপড়া বাস্তব সেহেতু সময় বুঝে গেছে ‘কাজ করিয়ে নেওয়াটাই আসল কাজ’। ‘সাব প্রাইম আর রিসেশনের ঢপে’ অ্যাপ্রেজাল বন্ধ থাকলে মধ্যবিত্ত শিখে নিতে পেরেছে, ‘কাজের মাসিকে যে কোনও ছুতোয় কম টাকা দেওয়া গেলে তুই কি আর বেশি দিতিস!’ (সেই সব ফুলদল) শেষোক্ত গল্পটিতে অসম্পূর্ণ কথন ও সমান্তরাল বলনের প্রকৌশল সসম্মানে পরীক্ষিত। ধারক স্থান ও বাহক কালের প্রলেপসিস হয়ে থাকে প্রান্তিক পাত্রের কন্ঠস্বরঃ ‘ইখানে তো সব লোনা জমি বাবু, ভেড়ি আছিল, মীন হত। ই মাটির জাত আলাদা। ফুল ভালো হবেনি বাবু’।
বনফুলের পাঠকবর্গকে উজ্জীবিত করতে পারে ‘নয়ন তোমারে’। গল্পটিতে মাত্র তিনটি পৃথক বাক্যে লিখিত তিনটে অনুচ্ছেদে শব্দ সংখ্যা যথাক্রমে ১১২, ৩৬ ও ১৪। সংবেদ সংহননের এমন অভিজ্ঞতায় বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় ও কণিষ্ক ভট্টাচার্য্য কি অতৃতীয়?
‘এপার ওপার দুই দেশের একটা পতাকাও পছন্দ নয় ওর’। ছেড়ে যাওয়া পরিণতি সম্ভাবনায় ‘তরীর বাতাস’ বয়ে আনে ফিলিপ লারকিনের জিজীবিষা :

East and west the ships came back
Happily or unhappily.
But the third went wide and far
Into an unforgiving sea
Under a fire-spilling star,
And it was rigged for a long journey.
(The North Ship)
বিমূর্ততা দিয়ে যাত্রা শুরু করে সহজ বোধগম্যতার পরিসরে পৌঁছবার মধ্যবর্তিতায় শেষ স্মৃতিফলক জুড়ে হাহাকার মথিত হয়ে আছে একটা মৎস্যমুখীর অনুষ্ঠান। অ্যানগ্‌নরিসিস্‌ ও পেরিপিটিয়ার সময়োচিত সমাপতনে যে প্রাক্ষোভিক বিমোচন তার জন্য এক ডলার সাতাশি সেন্ট ফিরে ফিরে আসে একটা বাদামী জলপ্রপাতকে বিক্রী করে দেবার সিদ্ধান্ত নিতে।
‘গতিহীন জনে’ বারবার ‘তবে’ ‘মনে হয়’ ‘যেন’, এসেছে, তুলনামূলকভাবে তরল হয়েছে আখ্যান। এমএলএ স্বরূপ একবার হয়েছে অরূপ (পৃঃ ৮৪)। কিন্তু কথন স্বাতন্ত্র্যে, লিখন মুন্সীয়ানায় এবং চোরাবালিহীন নিভাঁজ গদ্যে মৃত্যুর রঙ বিছিয়ে গেছে আকাশের ক্যানভাসে। ‘আজ যেমন এই রাস্তাটার কথা মনে পড়ল আকাশটা দেখে, বহুদিন বাদে আবার এই দিনটার কথা মনে পড়বে অপুর। মনে পড়বে আরও অনেকদিন আগে দেখা সেই লাল রক্ত আর কালো পিচের রাস্তাটা’। বাক্যের গঠনশৈলী ব্যক্তির স্থানাঙ্ককে ছড়িয়ে দেয় সময়ের একাধিক বিন্দুতে। কার্তেজীয় অবস্থানকে অতিক্রম করে যেতে চায় স্মৃতি, সত্তা, ভবিষ্যৎ। হয়তো অর্বাচীনের মতোই হাঁটিয়ে নিয়ে যায় একটা উদ্ধৃতির দিকে : Many years later, as he faced the firing squad, colonel Aureliano Buendia was to remember that distant afternoon when his father took him to discover ice.
পাঠককে জড়িয়ে নিয়ে কেন্দ্রীয় চরিত্র পরিবৃত গল্প বলার ঢংকে প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয় ‘অসময়’। স্বদেশী শ্বাপদ থেকে বিদেশী রিংমাষ্টার - সকলেই ওঁত পেতে আছে : লক্ষ্য সময় শিকার।
ম্যাথিউ আর্নল্ড কথিত সিক-হারি-অ্যান্ড-ডিভাইডেড-এইম লগ্নি পুঁজির দাপটে পরিপক্কতা পাবার পর কী চেহারা নেয় তার একটি নমুনা এই আলেখ্য। জীবনানন্দীয় পথে খরচ হয়ে যাওয়া সময় উপচয় আর হয়ত তখন ‘যখন কর্তব্যকর্ম সম্পর্কে আপনি সন্দিহান’। সমকালীন ইতিহাসের মর্মভেদী রঞ্জনরশ্মি হয়ে ওঠে একটা বাক্য : ‘জনমতে উৎসাহ জাগাতে টুকটাক ইনসাইড জবে দু-একটা জোড়া টাওয়ার নয় ধসে পড়বে’।
শেষ ফলক ‘ঈশ্বর বাক্য ছিলেন’-এ প্রবেশ করে সাধু-চলিত, মিথকথা-ইতিহাসের বিনুনি-পথে হাঁটতে হাঁটতে যখন হয়ত ভুলতে বসেছেন ক্রোনি পুঁজিবাদের ছত্রছায়ায় কীভাবে ডাভোস মানুষেরা আবিশ্ব বুনে যায় বিতত বিতংস, তখন আপনার মনে পড়তেই পারে পাঁচ নম্বর ফলকের গায়ে লেখা ছিল, ‘আজকের পৃথিবীতে কোনও গল্প হয় না - নেহাতই উপাদান সঞ্চিত হয়। কোনও একদিন গল্প লেখা হবে বলে’। তাই যদি হবে তবে এখানে এমন সুবৃহৎ উপন্যাসের কালব্যপ্তি ও চরিত্রবহুত্ব ধরা দিলো কেনো? আসলে এ লেখক তাঁর না-করার মধ্যে দিয়ে চিনিয়ে রাখেন তাঁর সক্ষমতার ক্ষেত্রগুলি। হয়ত মনে মনে ক্যালিম্যাকাসের মতো বিশ্বাসও করেন, মেগা বিবলিওন, মেগা কাকোন।

কৃষ্ণগহ্ববরের স্মৃতিফলকেরা
কণিষ্ক ভট্টাচার্য্
সৃষ্টিসুখ
১৩৯ টাকা


No comments:

Post a Comment