Thursday 15 March 2018

সন্দীপন চক্রবর্তী




সংসার মূলত কাব্য
                                              
                                                


২০১৮-র বইমেলায় সংগ্রহ করা বই আর পত্রিকাগুলো ঘাঁটছিলাম খানিক। সেসবে চোখ বোলাতে বোলাতেই নজরে পড়ল যে, ‘শুধু বিঘে দুই’ পত্রিকায় রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কবিতা নিয়ে আলোচনা করেছেন বিশ্বজিৎ রায়। বিশ্বজিৎ লিখছেন, ‘প্রাত্যহিকতার মধ্যে রহস্যময়তা সবাই খুঁজে পায় না। যারা পায় তাদের মন আর চোখকে ‘বিস্ময়াবিষ্ট’ বলা চলে। বিবিধ পদার্থের সীমা থেকে মন-চোখকে সুদূরে নিয়ে যায় বিস্ময়। এই বিস্ময় তো অনুরাগীরও অবলম্বন। অনুরাগী যে, সে বস্তু থেকে বস্তুতে ভ্রমণ করে না। একের মধ্যেই সে খুঁজে পায় নিত্য নূতনকে তার চলাচল অবয়বের অভ্যন্তরে।’ পড়তে পড়তে আমার শুধু মনে হচ্ছিল যে বিশ্বজিতের নিজের কবিতাও কি তাই নয়? বিশ্বজিতেরও তো বেড়ে ওঠা নব্বই দশকেই, যে ‘নব্বই পণ্যরতিকে উসকে দেওয়ার নিত্য আয়োজনে প্রতি মুহূর্তে এক বস্তুকে বাতিল করে অন্য বস্তুকে বাজারে আনে। ক্রেতা অনুরাগহারা। বাতিল দ্রব্যে ভরে যাচ্ছে চারপাশ। দ্রব্যের মতোই মানুষও বুঝি প্রতি মুহূর্তে রূপ বদলাতে না-পারলে বাতিল।’ বিশ্বজিতের লেখাতেও তো বারবার ফিরে ফিরে আসে তথাকথিতভাবে হেরে-যাওয়া বাবার কথা, হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলার নানা অনুষঙ্গ। মনে আছে, আমাদের ছেলেবেলায় ফেলুদা আর প্রফেসর শঙ্কুর গল্প পড়ার জন্য আমরা কেমন মুখিয়ে থাকতাম। বিশ্বজিতের একটি বইও আছে ‘প্রোফেসর শঙ্কুর শেষ ডায়রি’ নামে। এইসব সাতপাঁচ ভাবনা অবশ্য আচমকা মাথায় ঝিলিক দিয়ে উঠল তিলোত্তমা বসুর কবিতা পড়তে গিয়ে – ‘আচমকাই সাদা স্পার্ক / খেলে যায় স্নায়ুতে বিদ্যুৎ -- / প্রফেসর শঙ্কু, / তোমার ডায়েরির মতন / অবিকল আমার মগজ!’ তিলোত্তমার এই নতুন বইয়ের কবিতায়ও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আধারশিলা সংসার, দৈনন্দিনের টুকিটাকিবর্তমান সমাজব্যবস্থায় অধিকাংশ সংসারই এখন নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি। 

                                              








এর মধ্যেও যদি আবার আমরা কেউ আমাদের জীবনসঙ্গীকে হারিয়ে ফেলি, তখন যে পড়ে রইল, তার ভিতর যে হা হা শূন্যের অনুরণন ঘনিয়ে ওঠে, তাকে পেরিয়ে যাবার জন্যই হয়তো আমরা তখন প্রাণপণে আঁকড়ে ধরি আমাদের সন্তানকে, আমাদের ভালবাসার সবচেয়ে সার্থক চিহ্নকে। কৌশিক বাজারীর সদ্য প্রকাশিত কবিতার বই দু’টোয় সেই রক্তাক্ত হৃদয় আর তার উপশমের চেষ্টা যৌথভাবে বেজে উঠেছে অর্কেস্ট্রার মতো। আর এসব পড়তে পড়তেই মনে হচ্ছিল যে – তবে কি সংসারও মূলত কাব্য, যেখানে সামাজিক পট প্রতিস্থাপিত হয়ে ধরা দেয় পারিবারিক বা সাংসারিক পটের প্রাত্যহিকতা বা দৈনন্দিনতায়? যতদূর আমার ধারণা, বাংলায় উপনিবেশপূর্ব সময়ে কাব্যের এই ধারাটি বেশ পুষ্ট ছিল, যেখানে অণুবিশ্বের নানা অনুষঙ্গের মধ্যে দিয়েই, কবি হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করতে চাইতেন এক বৃহৎবিশ্বের ছায়াপথ। এখন সেই পথকে কীভাবে ব্যবহার করেন কবিরা?




১.
লোকে ভাবে গম্ভীর মানুষ, একলা ঘরের কোণে থাকে। লোকে ভাবে জাঁদরেল অধ্যাপক, ভারি ভারি প্রবন্ধ লেখে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে বিশ্বজিত আসলে একজন কবি। আর ওই মনে হওয়াগুলো? ওগুলো ‘কবির বর্ম’। বিশ্বজিতের কবিতায় উঠে আসে ‘বঙ্গজীবনের নিত্যতা লাঞ্ছিত’ নানা চিহ্নের আনাগোনা, যার মধ্যে দিয়ে সে দেখতে শুরু করে ‘অনেক রকমকে – এই অনেক রকম আরেকরকম, গোলকায়নের একরকমের সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্ব’। ফলে অবধারিতভাবেই তার কবিতায় গোলকায়নের এই সম্মিলিত বা যৌথ বিস্মরণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হিসেবে উঠে আসে এক সক্রিয় ব্যক্তিগত স্মরণের পদ্ধতি। উঠে আসে বাবার কথা, ছেলেবেলার কথা। দেখে ‘আজকাল বাড়িতে নিত্য নতুন ব্র্যান্ডের জিনিস আনাগোনা করে। অভাববোধ ক্রমশ কমছে। একের বদলে আসছে অন্য বিকল্প। কোনো একটা জিনিসের প্রতি আর তেমন ভালোবাসা দানা বাঁধতে দিচ্ছে না কেউ’। আর তাই সমাজস্বীকৃত সর্বসম্মত রাস্তা ছেড়ে, সে তখন নেমে আসতে চায় ওই ‘ভালোবাসা দানা বাঁধা’-র রাস্তায়। টের পায় ‘কড়ায় যখন ফালা ফালা করে কাটা আলু আর পটলের পাশে ফুলে ওঠে বড়ি তখন মায়া এসে জমে আমার ভেতরে’। তাকে তাই তাড়া করে ফেরে ‘গেরস্থালির ভূত’। সহজেই বলতে পারে, ‘কী গভীর সম্পর্ক ছিল ভাত আর ডালসেদ্ধর / তা তো তোমার জানার কথা নয় প্রেশার কুকার / সেসব জানে লফ্‌টে তুলে রাখা / অ্যালুমিনিয়ামের পুরোনো ভাতের হাঁড়ি’। বলতে পারে সেই আমাদের ছেলেবেলার ‘সেদ্ধ করে গোটা ডিম সুতো দিয়ে সমান দু-আধখানা করা’-র গল্প। স্মৃতির সরণী বেয়ে আসে বাবার কথা। মনে হয়, ‘আমি বাবার না-পারাগুলোই দেখেছি। আম কিনতে না-পারা, বাজার ভালো করতে না-পারা, লোকজনকে কথায় জব্দ করতে না-পারা, টাকা জমাতে না-পারা, দ্রুত সাইকেল চালাতে না-পারা, জমি কিনতে না-পারা, বেশি উপার্জন করতে না-পারা। এইসব না-পারাগুলোকে আমি মাঝে মাঝে ছোটোবেলায় পারায় বদলে দিতে চাইতাম’। কিন্তু তা সত্ত্বেও তো বোঝা যায় ‘আমার সঙ্গে আমার বাবার অসাফল্যের খুব গভীর একখানা সেতু ছিল’। চোরা সেতু। যে সেতু দেখতে পায় ‘শীতের ভেতরে আছে নরম লেপের আলো’। স্মৃতিই সেই আলো। গোলকায়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে গিয়ে বিশ্বজিৎ ‘রবিবাবুকে’ কবিতায় লেখেন ‘আপনি বলছিলেন মানুষের লোভের কথা। লোভ লোভ লোভ। জিনিসের লোভ, ক্ষমতার লোভ। বলতে বলতে আপনি বললেন শেষে ‘গ্রিড ফর ফ্যাক্টস’। বন্ধ করে রাখি বই। তথ্যের লোভ, জানার লোভ, নজরদারি করে তথ্য আদায়ের লোভ, সেই তথ্যের খাঁচায় মানুষকে বন্দি করে রাখার লোভ, সেই বাইরের তথ্যের খোলায় ভেতরের মানুষকে ঢেকে দেওয়ার লোভ’। কিন্তু আমরা বাইরের তথ্যের খোলা ভেঙে – বাইরের ‘আমি’-কে ভেদ করে – চাই ভেতরের মানুষটার কাছে পৌঁছতে। যে লেখে সে আমি নয় – এ কথা জেনেও, বা এ কথা জেনেই, ছুঁতে চাই ‘যে লেখে’ সেই মানুষটাকে।




২.
        এই ভেতরের মানুষটার সন্ধান অনেকসময়েই আমরা পাই না। আমরা – বাইরের লোকেরা – শুধু বাইরের কিছু চিহ্ন দেখেই ভেতরের মানুষটাকে বিচার করতে যাই। বুঝি না যে, ‘কপাট খোলাই থাকে / বাইরের লোক এসে ফিরে যায় / তালাআঁটা দেখে...’। কিন্তু এই তালাআঁটার দরকারটাই বা কী? তিলোত্তমার মতে ‘ওসব রঙিনে ভয় হয় / প্রজাপতি দূর থেকে ভালো / বুকের ভিতরে উড়ে এলে / সব মধু লুঠ হয়ে যায়’। এই তাহলে প্রতিরোধে ঘেরা সেই মননের মধু, যা সংসারের আর প্রাত্যহিকের মৌচাকে জমে ওঠে ধীরে ধীরে! আর বুকের মধ্যে সেই মধুকে আগলে রাখতে রাখতেই, কবি টের পান, ‘সংসারের মাঝখানে উনুনে চাপানো ভোগ আমি’। তাই খুব সহজেই লিখতে পারেন, ‘বাকি জীবনটা গুণ গাইতে গাইতে / নুন হয়ে যাব’, কারণ ‘যদি হয় প্রয়োজন, যদি লাগে সমস্ত আলুনি / সমুদ্র ফেলবে সেঁচে আমাকে খুঁজতে / ভাবো যদি... / ধরা দেবো সব গুণে / নুনমাত্র চাইবে যখনই’। কিন্তু এই বোধের উৎসমুখ কোথায়? সেই খোঁজ করতে দিয়ে দেখি – ‘পুরুষ অবাকযন্ত্র / যন্ত্র শিখব বলে / নাড়া বাঁধি প্রেমে’। তাহলে তো বিশ্বজিতের লেখার সেই ‘ভালোবাসা দানা বাঁধা’-র মতোই এখানে এসেও নির্ভরবিন্দু সেই প্রেমে নাড়া বাঁধা। তিলোত্তমা লেখেন, ‘তবে কি যন্ত্রের কাছে / যন্ত্রবৎ ধরা দিতে হবে? / অবাক হব না আর / চোরকাঁটা বিঁধে গেলে / হলুদ শাড়িতে?’ না, যন্ত্র হয়ে নয়, কারণ যান্ত্রিক সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে কোনো সংসারে প্রাণের প্রতিষ্ঠা হয় না, আর তিলোত্তমার অন্বিষ্ট তো সেই প্রাণ! প্রাণ তো তার স্বাভাবিক নিয়মেই কখনো সমতল, যান্ত্রিক, একরঙা নয়। ফলে সম্পর্কও তা নয়। তারও থাকে নানা রঙ, নানা শেড! তাই তো ‘ইনসিওরেন্স কোম্পানির এজেন্ট / আমাকে বোঝায় / কতখানি অভিমান জমা হলে / শতকরা কত হারে / সম্মান ফেরত পাওয়া যায়’। তাই তো ‘নিরীহ মাটির ঘর’ কার্তুজে ভরে উঠলে চোখে পড়ে – ‘আকাশে ব্রাশের স্ট্রোক, জলরঙা শেড / এসেছ নতুন বুঝি? চমকে উঠেছ -- / ধান খেতে লাশ পড়ে আছে’। চারপাশের তাপ লেগে এইসব পুড়ে যাওয়া, ঝলসে যাওয়া, না-পাওয়া তো বালির মতো জমে ওঠে ধীরে ধীরে। বিশ্বজিতের কাছে ‘স্মৃতি আলো’। কিন্তু একইসঙ্গে সে জানে ‘যে-তারার আলো এল সে-তারা মরেছে’। জানে ‘চাপা পড়া ঘাসের শরীর / জানো না রঙিন হয় না’! কিন্তু সেই রঙহীনতা থেকে যাত্রা করেও তিলোত্তমা পৌঁছতে চান রঙে, প্রাণে, জীবনে। জীবন তো জলেরই আরেক নাম। ‘তোমাকে ডেকেছি ‘জল’ / এ-বুকেই খুঁড়ি বালিয়াড়ি...’ তাই ওসব রঙিনে ভয় হলেও টের পান, ‘দরজা জানলা বন্ধ, বালি তবু কোথা থেকে উড়ে / এল এই চোখে? স্বপ্নের ফুলকি দাউদাউ / ধরে গেছে শিফন শাড়িতে’এই স্বপ্ন, এই ভালোবাসার বোধের সমুদ্রই তার চোখে ঘনিয়ে তোলে বাষ্প। বিশ্বজিতের লেখায় ছিল এক ‘গেরস্থালির ভূত’, যা তাকে টেনে নিয়ে আসে ভালোবাসার দিকে। আর তিলোত্তমার ভালবাসার থেকে মাঝেমাঝে উঁকি মারে এক ‘সমুদ্রবাষ্পের ভূত’, যা তাকে টেনে নিয়ে আসে গেরস্থালির আঙিনায়। এমনকি ‘সমুদ্রবাষ্পের ভূত অদৃশ্যের থেকে হাসে / কোথায় রেহাই? একা হলে / বালির বালিশ বুকে চেপে বসে / শব্দ থেকে নৈঃশব্দের দিকে যেতে যেতে / মৃত্যুভয় ডোরাকাটা...শীতল চাউনি’তা থেকে বাঁচিয়ে দেয় গেরস্থালি। আসলে, গেরস্থালির ভেতরের এই প্রাণ, এই ভালোবাসা, এই অভিজ্ঞতার সাযুজ্যই পাঠকের সঙ্গে কবির মধ্যে তৈরি করে দেয় এক সেতু। সেটা জানেন বলেই তিলোত্তমা লিখতে পারেন – ‘উনুনে পড়বে আঁচ / চায়ে দেব আদা ও এলাচ / যদি মনে ধরে / ছোট্ট এই চায়ের দোকান / তোমাদের / গোলাপ...গোলাপ...’।

৩.
        এহেন গেরস্থালির আঙিনা থেকে, ভালোবাসার আঙিনা থেকে, যখন চিরদিনের মতো হারিয়ে যায় একজন জীবনসঙ্গী – ‘প্রচণ্ড এপ্রিলে তুই সূর্যের চপ্পল খুলে রেখে চলে গেলি / অনন্ত হিমের দেশ না কি মিহি তুষারের জানি না সঠিক’ – তখন আরেকজনেরও কি বাঁচতে ইচ্ছে করে! তাকে ঘিরে ধরে শীত। কিন্তু তবু তো বাঁচতে হয়! কীভাবে সে বাঁচবে? বিশ্বজিতের লেখায় ছিল, ‘কে বলে দু-জনের মাঝে শীত বসে থাকা মানে নিভে যাওয়া!’ আর কৌশিক টের পান – ‘মুখের উপর এসে পড়ছে অলকা-তিলক / মেঘ ও শীতের কুয়াশা / বাঁধানো ছবির ভেতরেও এসে গেল এবারের শীতকাল’। কিন্তু ‘বিগত শীতের কথাগুলি কার যেন অপেক্ষায় আছে’। তাই এই শীতে একান্ত নির্ভর হিসেবেই জ্বলে ওঠে শব্দের পবিত্র শিখা। তিলোত্তমা  যেভাবে দেখেছিলেন ‘যৌগিক শব্দের সব জটিলতা নিয়ে / জীবন রেখেছে ধরে নিজেকেই / আত্মহত্যা প্ররোচনাময় অসংখ্য ধাক্কায় / খাদের কিনারে...’, সেভাবেই, ওই ‘যৌগিক শব্দের সব জটিলতা’-র উপর ভর করেই, কৌশিক যেন স্বগতোক্তির মতো নিজেকে নিজে বলে চলেন ‘লেখো অশ্রু, লেখো’, কারণ ‘পাতা কাঁপছে / পাতা হাওয়ায় কাঁপছে / পাতা হাওয়ায় কাঁপছে থরথর / পাতা কাঁপছে...’। চোখের পাতা ভিজে। তাই ‘উৎসর্গে তোকে লিখতে পারছি না কিছুতেই, / আঙুলে কাঁপছে ছিন্ন বর্ণমালা...’। চোখের সামনেই যেন দেখতে পাচ্ছি – ‘এই যে ভেঙে পড়া টাওয়ার / বহুকাল আগে এর চূড়ায় মশাল জ্বেলে / সংকেত পৌঁছোনো হতো আরও বহু দূর...’। কিন্তু ‘সমস্ত টাওয়ার আজ ধ্বংস হয়ে গেছে...’। আসলে ‘বুঝি মানুষ আত্মরতিপরায়ণ হয়ে তার হৃদয়কে ভাঙে / ভেঙে দেখে, ভেতরে অচেনা ঘরের লোক বসবাস করে / তাদের হৃদয়ে যে প্রেম, স্বার্থ, হিসাবের ঝনঝন কড়ি / সেসব ঐশ্বর্যাদি তামাদি সম্পত্তির মতো পড়ে থাকে’। তাই দেখতে পায় ‘একপাশে প্রাচীন দালান আজ ভেঙে পড়া প্রেতের হৃদয়’। আর্তনাদ করে ওঠে, ‘বলো হে জন্মান্তর, বলো আদিম তারকা / তার স্মিত হাসি, ভৌতিক বিষাদ, কোন সে মিলনের কথা বলে?’ তাহলে কি সত্যিই ‘স্মৃতি আলো’ নয় আর? ‘যে-তুমি আমার নও আর / যে-তুমি না-ফেরার দেশ’, তার সঙ্গেও কৌশিক তাহলে এক সেতু গড়ে তুলতে চাইছেন কেন? কেন ‘তোমার অসহ্য বার্তা ফুটে ওঠে প্ল্যানচেটে’? কেন আজও ‘তোমার ছবির পাশে একা একা ফিরে আসি নিজের মানুষ’? কারণ, কৌশিক তার বোধের গভীরে টের পান ‘হয়তো কোথাও তুমি রয়ে গেছ / আমি শুধু ঠিকানা জানি না...’। স্মৃতিই সেই ঠিকানা। বাইরে থেকে আমরা দেখি, ‘রোদ ওঠে / মানুষের ছায়া পড়ে / মুছে যায়...’। কিন্তু তা মুছেও মোছে না। জলতল আলো করে থেকে যায় স্মৃতির ভিতর। সেজন্যই ‘বিগত শীতের কথাগুলি কার যেন অপেক্ষায় আছে’ বলার পরেও কৌশিক লিখতে পারেন, ‘এ-বছর শীতের কবিতাগুলি হয়তো-বা অন্যপ্রকারের হবে / শীতের পোশাক থেকে রোদ নিয়ে / রাতের আঁধারে তারা নিরুপায় কিনারে দাঁড়াবে’। অন্ধ গহ্বরের গ্রাসের মধ্যে এসেও, এই ‘নিরুপায় কিনার’ খুঁজে পাওয়া আর সেখানে দাঁড়ানো – এখান থেকেই শুরু হবে কৌশিকের নতুন পথ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা।
        অন্ধ গহ্বরের যে হিমশীতলতা ঘিরে ধরেছিল কৌশিককে, তাকে ছিন্ন করতে পারে একমাত্র হিমঘ্ন – কৌশিকের ছেলে – ডাকনাম বুবু। তার আঁকা নানা ছবিতে ভরে ওঠে কৌশিকের আরেকটি বই ‘বুবুর সঙ্গে দ্রাক্ষাবনে’। বুবুই হারিয়ে যাওয়া জীবনসঙ্গীর সবচেয়ে উজ্জ্বল চিহ্ন, যার দিকে তাকিয়ে সেই সঙ্গীকে বলা যায়, ‘এ জীবন না-বোঝার পাঠ / এবারেও / তোর কাছে রেখে যেতে চাই...’। এ বইয়ের উৎসর্গে লেখা হয় – ‘সব ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েরাই ছবি আঁকে, গল্প বলে, আকাশ মেঘ বৃষ্টি ঝড় দেখে বিস্ময়ে আকুল হয়। তারপর তারা বড়ো হয়ে যায় একদিন। তখন বিস্ময় আর তেমন করে আসে না সকাল-বিকাল’। এ পর্যন্ত পড়েই আমার আবার মনে পড়ে যায় বিশ্বজিতের সেই কথাগুলো – ‘প্রাত্যহিকতার মধ্যে রহস্যময়তা সবাই খুঁজে পায় না। যারা পায় তাদের মন আর চোখকে ‘বিস্ময়াবিষ্ট’ বলা চলে। বিবিধ পদার্থের সীমা থেকে মন-চোখকে সুদূরে নিয়ে যায় বিস্ময়। এই বিস্ময় তো অনুরাগীরও অবলম্বন। অনুরাগী যে, সে বস্তু থেকে বস্তুতে ভ্রমণ করে না। একের মধ্যেই সে খুঁজে পায় নিত্য নূতনকে তার চলাচল অবয়বের অভ্যন্তরে।’ কৌশিক জানেন, ‘সব শৈশব বড়ো হয়ে যায় একদিন। তখন তাদের ব্যক্তিগত খাতাগুলি ভরে ওঠে হিসাবের আঁকে। তখন সে যদি ছবি আর না-ই আঁকে, গল্প না বলে তেমন, তবু এই ছবি আর গল্পগুলি উড়ে যাক তার আগামী পৃথিবীর দিকে। আমারও ছোটোবেলাকার দ্রাক্ষাবনের ভিতর...’তাই এ বইতে দেখি, ‘প্রতিটি ঋতুর শেষে একদিন ফিরে আসে শিশুকাল’সেই স্মৃতি, সেই আলো জেগে ওঠে – ‘থোকা থোকা আলো-জ্বলা মেঘফল ঝুলে আছে মাথার উপর। আমার শিশুবেলাকার দ্রাক্ষাবন মনে পড়ে আজ’আর সেই শৈশবের বিস্ময়বোধকে দু’চোখে জাগিয়ে রাখতেই কৌশিক লেখেন, ‘আমি আমার বেটার সময়-যান পাঁচ বছরেই থামিয়ে রাখি। তার শরীর থেকে আজীবন নীলাভ-সবুজ আভা ছড়াবে এই স্বপ্নজগতে। আমার বাস্তব আর পরাবাস্তব থেকে অনেক দূরের দেশের সেই আলো...’তাহলে কি স্মৃতিই সেই আলো, যা অনুপস্থিতির উপস্থিতিকে তুলে আনতে চায়? বিকেলে বেড়াতে বেরিয়ে বুবু বায়না করে – ‘বন্ধ, ফাঁকা, বন্ধুরা, মাস্টারমশাই কেউ নাই...সেই ইস্কুলটা দেখব...তাই হয়তো ‘এখন সে একটা দুঃখী দুঃখী জানালায় বসে মায়ের অপেক্ষা করে। কথা বলতে শেখেনি সে, শুধু কথারা তার চোখের পাতায় জমে থাকে’। আর সেই কথাদেরই কৌশিক তুলে আনতে চান তার লেখায়। ফলে যখন দেখা যায় যে ‘বাইরে অন্ধকারে পড়ে আছে বিষণ্ণ ভেঙে পড়া জটায়ুর ডানা’, তখন বাইরের সেই খোলসকে ভেঙে ভিতরে প্রবেশের জন্যই কৌশিক ভাবতে পারেন, ‘অন্ধকারের মধ্যে হামা দিয়ে নেমে যাই যদি’...। এভাবে নেমে গেলে একসময় ‘সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে আমাদের আলো দেখা যায়’। কিন্তু এ কোন আলো? ‘হে আলো, আমি তারে চিনিতে পারি না...’। এই কি তাহলে অণুবিশ্বের সঙ্গে বৃহৎবিশ্বের সেই সুড়ঙ্গলালিত সম্পর্ক, যেখানে সাংসারিক প্রাত্যহিকতা-লাঞ্ছিত অণুবিশ্বের থেকে হাত বাড়ালে ছোঁয়া যায় ‘পৃথিবী পেরিয়ে মহাকাশ, চাঁদ, তারা’? টের পাওয়া যায়, ‘ডুব দিই – ভেসে উঠি – ডুব দিই – / চোখ খুলে দেখি মাথার উপরে বহমান নিরঙ্কুশ জল – / ভেসে উঠি। / দেখি পৃথিবীতে সূর্যাস্ত চলছে। সিপিয়া আলোয় ভরে আছে জল ও আকাশ / এ কোন শতাব্দীর আলো? আজ কোন দিন? / নুয়ে পড়া শিরদাঁড়া অতি ধীরে তুলে নিয়ে দেখি / ঘাটের ভাঙা কিনারায় বসে আছে / শ্মশ্রু-গুম্ফময় যুবক, আর তার আশ্চর্য শিশু / মুখে গোধূলি সূর্য মাখা রং’। তখন এই বৃহৎবিশ্বকে সহজেই আত্মীকরণ করে নিয়ে, সেই অণুবিশ্বের চৌহদ্দিতে দাঁড়িয়েই লেখা যায় এরকম লেখা, যা অণুবিশ্ব-বৃহৎবিশ্বের সীমারেখা ভেঙে দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে --    

‘-- বাবা দেশ মানে কী? বাবা আমার দেশ কোথায়?
বাবা, আমার দেশ আমি দেখতে পাই না কেন কোথাও?

বুবু বানান করে পড়তে শিখেছে।

বুবু আজ টিভিতে খবর দেখেছে।’  

*********
১) গেরস্থালির গদ্য। বিশ্বজিৎ রায়। শুধু বিঘে দুই। ২০১৭। ২৫ টাকা।
২) ছোট্ট চা-দোকান। তিলোত্তমা বসু। শুধু বিঘে দুই। ২০১৭। ২৫ টাকা।
৩) লেখো অশ্রু, লেখো। কৌশিক বাজারী। শুধু বিঘে দুই। ২০১৭। ২৫ টাকা।
৪) বুবুর সঙ্গে দ্রাক্ষাবনে। কৌশিক বাজারী। ভাষালিপি। ২০১৭। ৩০ টাকা।

প্রসঙ্গসূত্রঃ
প্রাত্যহিকের রহস্যঃ রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কবিতা। বিশ্বজিৎ রায়। শুধু বিঘে দুই। ষষ্ঠ সংখ্যা, জানুয়ারি ২০১৮ 
          
        

No comments:

Post a Comment