Wednesday 28 March 2018

রিমি মুৎসুদ্দি



অন্ধবাড়ির গল্পপাঠ





‘সব মানুষই মরে যাওয়ার পর গাছ হয়ে যায়।’ ‘বাতাসের চেয়ে কৌতুক ব্যাপার আর কিছু নেই।’ গাছ বা বাতাস গল্পের চরিত্র বা কেন্দ্র। যার আবর্তে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে গাছ কেটে মাল্টিপ্লেক্স, আবাসন তৈরি হওয়া এই সময়ে, পুরো গল্পটাই ঘুরপাক খাচ্ছে। না, যুদ্ধের কোন গল্প নেই এই বইতে। শুধু মাঝেমাঝে যুদ্ধ চেখে যাওয়া বাতাস কানের পাশ দিয়ে হুস করে বেরিয়ে যায়। কিন্তু ছুঁয়েও যায় না পাঠককে 
গল্পের কি বিষয় থাকতেই হবে, কবিতায় বক্তব্য? অথবা উপন্যাসে গল্প? বোধিসত্ত্ব ভট্টাচার্যের ‘অন্ধবাড়ি’ গল্পসংকলন পড়ে এই প্রশ্নগুলোর আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। এই বইয়ের নামগল্প ‘অন্ধবাড়ি’-তে  বোধিসত্ত্ব রচনা করেছেন এক মহাকাব্যিক বিনির্মাণ। অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র ও তার স্ত্রীর মতো বংশী আর চোখে কাপড় বেঁধে সরমা তাদের পালিত পুত্র সঞ্জয়ের সঙ্গে যাত্রা করছে জ্যোৎস্না রাতে। চোখ ফিরে পাওয়ার নেশায় খিদে, তেষ্টা অগ্রাহ্য করে যেন এক অলীক রাজ্যে যাত্রা। তান্ত্রিক বলেছিল সঞ্জয়ের চোখ দিয়ে দেখতে হবে তালাগাছের মাথার উপরের দৃশ্য। বংশীর অন্ধত্ব ঘোচাতে গিয়ে সঞ্জয় টের পায় দৃষ্টি তারও সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। কবেকার অতীত খুঁড়ে স্কুলে পেনসিল চুরি করে স্যারের কাছে মার খেয়ে, বাড়ি ফিরে এসে ঘরের দাওয়ায় মাসি মেসোর ‘মুড়ি খেতে খেতে একের ওপর অন্যজনের উঠে যাওয়া’... । আর যে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না সে। তালগাছের মাথার ওপর আকাশ, নীচে মাটি –কিচ্ছু দেখতে পায় না সঞ্জয়। ‘অন্ধত্ব মানে তো শুধু না দেখতে পাওয়া নয়।’
জাদুবাস্তবতা আর বিনির্মাণ বোধিসত্ত্বের গল্পের ক্রাফট। এই বইয়ের কয়েকটা গল্পে লেখক চূড়ান্ত সফল। ‘তারা দুজন ও চৈত্র সেল’, ‘জোনাকি’ গল্পদুটিতে দুরকম বিনির্মাণ। অথচ এই গল্পদুটোতেই ছিল- ‘মাঠের বাঁশির মতো মৃত্যু, মাঝরাতের হঠাৎ ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়া অতি নির্জন সঙ্গীত, নিষিদ্ধ ভিনদেশি অনুভব...’ নিয়ম মেনে আহ্নিকগতি পূর্ণ করা পৃথিবীতে মিলিয়ে যাওয়া একটা দরজাহীন ঘরের আটপৌরে স্বপ্ন।
‘আলোর মানুষ’, ‘বুরবুদ’ গল্পদুটো দুরকম সম্পর্কের ও উদাসীনতার। দুটো নিঃসঙ্গ মানুষের একে অপরের সঙ্গ পাওয়ার আকুতি। ‘আলোর মানুষ’ গল্পে একটা লাইনেই ভেসে ওঠে গল্পকারের নির্মাণ অথবা গল্পের মধ্যে বলতে চাওয়া কথা- ‘আমায় ছাইমনের কাছে নে চল না রে বকম... ভঙ্গিটা আদুরে।’ সাইমন আর একাই- দুটো প্রান্তিক একলা মানুষের সব হারিয়েও নিজেদের আঁকড়ে ধরে বাঁচার ইচ্ছে। ‘বুরবুদ’ গল্পটাকে কি বিষাদের গল্প বলা যায়? কার বিষাদ? ইংরাজি মিডিয়াম স্কুলে পড়ানো, বেগম আখতারের ভক্ত, বারবার প্রেমে পড়ে যাওয়া মা? না, গলার পোড়া দাগের উপর সিটি গোল্ডের চেন সেঁটে যে মেয়ে তার একসময়ের প্রেমিককে মা’র ঘরে ঢুকতে দেখে? বিষাদ কার? এটাই প্রশ্ন এই গল্পের। যার মধ্যে আবার মিশে রয়েছে রেললাইন ধরে হেঁটে চলে যাওয়া একটা পঁচিশে বৈশা
‘প্রীতি জিন্টার টপ’ গল্পটা তুলনায় একটু হতাশ করল। শহরের দুজন বোকার ব্যাখ্যা ঠিক বোধগম্য হল না। যদিও লেখক বলে দিয়েছেন সবটাই। হাসলে গালে টোল পড়ে, আর প্রীতি জিন্টার মতো লাগে- কোন এক হাসিন শামে বা কল্পনার মুহুর্তে শোনা এই কথাটা যেকোন টিন এজ মনেই নায়িকাসুলভ বাসনা এনে দেবে। সিনেমা কেন খারাপ, সিরিয়াল নয়- কিশোর মনের এই বোধটা যেমন দুর্বোধ্য পাঠকের কাছে, সেরকমই ট্রায়াল রুমে নতুন জামা ছিঁড়ে ফেলায় কতটা রাগ অথবা কল্পনা আর বাস্তবের ফাঁক গলে বেরিয়ে আসা নির্মততায় তৈরি হওয়া চূড়ান্ত হতাশা- সে প্রশ্ন থেকে যায়। তুলনায় ধুলো গল্পের নির্মাণ মুগ্ধ করে। ব্রিজ ভেঙে যাওয়ার পরের কাহিনী। অথচ ব্রিজ ভাঙার কান্না বা স্বজন হারানোর বেদনা ঘটমান জায়গার মতোই ধুলোয় মুছে গিয়েছিল। এই গল্পের নির্মাণে তাই হতাশা নয় ব্রিজের হ্যালোজেনের আলো অল্প অল্প ছড়িয়ে পড়ে।
এবার আলোচনা করা যাক, এই বইয়ের আরেকটি গল্প নিয়ে। যে গল্পের মধ্যে ‘to be or not to be’, গল্প আছে অথবা নেই সেই প্রশ্নের থেকেও কয়েকটা দৃশ্যকল্প জুড়ে দ্বিরালাপ জমে ওঠে। গল্পের নাম ‘দুই বাবা এবং বেলগাছ’।
স্মৃতিসত্তা মানেই যে দ্বিরালাপ- নিজের সাথে নিজের কথোপকথন সেই ফর্মটা কোথায় যেন ভেঙেচুরে একটা ন্যারেটিভে লেখা আত্মকথন বা স্মৃতিকথা গল্প হয়ে উঠেছে। অথবা, গল্প হয়ে উঠতে উঠতেও যেন একটা ব্যাগের ভেতর ভরে নেওয়া নির্জনতা। শূন্যতা নয় নির্জনতা। যে নির্জনতাকে গল্পের শুরুতে লেখক ছবির কোলাজে ব্যাখ্যা করেছেন। ‘…ঠাণ্ডা পিস্তলসম নির্জনতার পেটের ভেতর ফুটে উঠতে দেখা গেল ছবিটিকে। ছবিটির ক্যানভাস খুব কিছু বড় নয়।’
আসলে পুরো গল্পটার মধ্যেই লেখক ছবি এঁকেছেন। ‘…একটা ছাদ, তাতে দুজন মানুষ। ছাদের পাশে একটা বেলগাছ। বেলগাছের ভিতর থেকে দুটো পা বেরিয়ে আছে।’
ছবির কি দরজা জানলা হয়? কিন্তু যদি ধরে নিই হয়, তাহলে সেই অনুষঙ্গ দিয়ে চলে এসেছে একটাই চরিত্র। সময় যার নাম। বিয়াল্লিশ বছর আগের সময় থেকে শুরু করে ছাদের পাশে বেলগাছটার বর্তমান সময়। বিয়াল্লিশ বছর আগের কোন এক নকশাল সময়ে লেখকের ছোটকাকা, যে নিজে নকশাল নয় অথচ ভাল বোম বাঁধতে পারে, অকুতোভয় ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগান দেওয়া নকশাল ওয়াসিম কাকার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ার সুবাদে পুলিশের গুলিতে মারা যায়। মারা যাওয়ার সময়ে হাতে তার লেখকের আঁকা ছবি অথবা লেখা গল্পের বেলগাছটার চারা আর তা মাটিতে পুঁতে দেওয়ার জন্য কাগজে মোড়া গোল্লা গোল্লা মাটির দলা ছিল। নকশাল আমল থিতিয়ে গেলেও সেই নিরীহ মাটির দলাকেই পুলিশ পেটো ভেবে ভুল করে। তাই ভরদুপুরে পয়েন্ট থ্রি-টু কোল্ট থেকে এসে পরা গুলিও একটা অস্তিত্ব হয়ে গল্পে মিশে যায়। অথবা প্রোটাগনিস্ট বেলগাছটার গোঁড়ায় থেকে যায়।
বেশিবয়সে গর্ভবতী মহিলার মতো বেলগাছটায় কুঁড়ি ধরলে সেই ফলন্ত গাছের অনুষঙ্গে এসে পড়ে লেট রাণিবালা থেকে একসময় নকশাল হয়ে পড়াশুনা ছেড়ে দেওয়া ওয়াসিম কাকা- লোকজনের সামনে বাড়ির লোকেরা যাকে ‘অসীম’ বলে ডাকত। বেলগাছটাকে ঘিরে গল্পকারের বাবা আর ওয়াসিম কাকা দুজনেই যেন ডালপালা আর শুকনো পাতা হয়ে ঘিরে রয়েছে গাছটাকে। ওয়াসিম কাকার কিশোরী মেয়ে পাশের বাড়ির হিন্দু ছেলেকে বিয়ে করেও সংসার করতে পারেনি। কোন এক বেগুনি সকালে খালের ধারে আত্তির ফর্সাপানা সাতমাসের গর্ভবতী চেহারাটা ফাঁপা খোলের মতো সকলের চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল।  গোটা গল্পে ওয়াসিম কাকার কন্যাশোক চোখে পড়ে না। অথচ বেলগাছটায় উঠে বেল পাড়ার সময় সে পাশের বাড়িতে উঁকি দিয়ে প্রাক্তন জামাইয়ের ‘তত সুন্দরী নয়’ দ্বিতীয়পক্ষকে দেখে বেজায় খুশী হয়। তার মেয়ে মরে গেলেও অন্তত রূপে জিতে গেছে- গোছের অথবা, হেরে গিয়ে, হারিয়ে ফেলেও কোথাও জিতে যাওয়ার সূক্ষ্ম অনুভূতি। বিষাদের রূপরেখা।
ন্যারেশনের ফাঁক গলে একটা তক্ষকের ‘তঁককক- ডাক হুইসেলের মতো বাজতে থাকে।’ এখন অন্ধ হয়ে যাওয়া একদা প্রাইমারি স্কুলের অঙ্ক মাস্টার আর ওয়াসিম কাকা- দুই বাবা আর বেলগাছটা ‘একটি চিরন্তন আমাদের দিকে ঢালু জায়গা দিয়ে ধীরে ধীরে গড়িয়ে চলেছিল মজ্জাহীন দ্বিপ্রাহরিক সিল্যুয়েট।’       

গ্রন্থ- অন্ধবাড়ি/ বোধিসত্ত্ব ভট্টাচার্য/ প্রকাশক- আদরের নৌকা প্রচ্ছদ:- তৌসিফ হক মূল্য:- ১২০ টাকা
           

    

No comments:

Post a Comment