Thursday 15 March 2018

শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী


"সায়াহ্নের প্রথম উক্তি 
  সে প্রাতঃকাল নয়"



কবি ও তার কবিতাযাপন।ভাষার অনতিক্রম্য প্রাতঃসময় থেকে এই বিষয়টি সমালোচকদের প্রিয় বিষয় হয়ে থেকেছে।আর স্বাভাবিকভাবেই তার পরবর্তীতে অন্বেষণপ্রক্রিয়ায় উঠে এসেছে কবিতানির্মাণের পর্যায় বিন্যাস ।কবিতানির্মাণ কতোটা বিশ্লেষণযোগ্য,এও বড় বিতর্কের প্রসঙ্গ ।হয়তো তার এক প্রান্তে লীন হয়ে আছে দেগার সরল প্রশ্নের জবাবে মালার্মের দেওয়া সেই সুবিখ্যাত উক্তি ।ভাব নয়,কবিতার নির্মাণ হয় শব্দ দিয়েই।তার ঠিক বিপরীতে রয়েছে জার্মান কবি বার্নার্ড হেইনরিচ উইলহেম ভন ক্লাইস্টের কবিতাভাবনা।ক্লাইস্ট বলছেন "যেমন ক্ষিদের ভাবনা আমাদের খাবার প্রক্রিয়ার দিকে ঠেলে দেয়,ঠিক তেমনই কাব্যচিন্তা কবিতার সৃষ্টি করে।আর সেই কাব্যচিন্তার ভিত্তি পরিপার্শ্বিক ঘটনার বিষয়।"এই দুই বিপরীত বিশ্বের মধ্যস্থ যদি কোনও কবিতার ভূখণ্ড থেকে থাকে,তাহলে তার নির্বিকল্প সম্রাট হতে পারতেন যে মানুষটি,তিনি কবি আলোক সরকার।
                মনে পড়ছে একদিন আলোকদার কাছে কবিতা চাইতে গিয়েছিলাম ।একটি আশ্চর্য কবিতা তখন তিনি তুলে দিয়েছিলেন আমার হাতে ।কবিতার শেষ স্তবক ছিল এইমতো,"ভাষা অনুগত,ভাষা/শব্দ চয়নের নিয়মাবলী/যত অতিক্রম করছে/তত যা হবার ঠিক তাই-/জলপরী,তাদের সাজ/সাধ আহ্লাদ -/তাকে শান্তি বলতে/তর্ক উঠবে কেন?"(ভাষা;শামিয়ানা; তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা ২০১৫)।কবিতা আমার হাতে দিয়ে আলোকদা স্বভাবসূলভ স্নেহভরা গলায় বললেন,"পড়লে?"আমি ঘাড় নাড়তেই আলোকদা এবার জানলার পর্দা সরালেন।পাশের বাড়ির ছাদে পাঁচিলে টবের বাগান।সেখানে থোকাথোকা গাঁদা ফুল।কবি বললেন, "কী দেখছ?"আমি উত্তর হাতড়াই।সেই অস্ত্রশিক্ষাকালীন গুরু দ্রোণের সামনে পড়ে পঞ্চপাণ্ডবের যা অবস্থা হয়েছিল আর কি।বললাম গাছ,টব,ফুল...।প্রতিবার আলোকদার গলায় হতাশা।বললেন,"আর?"আমি তাকিয়ে রইলাম ।তখন কবি বললেন, "এটাই হল কবিতা ।কবিতার কী,কেন,কখন হয় না।ওই টবওয়ালা ছাদটির মতোই কবিতার সর্বাঙ্গীণ প্রকাশও তার পূর্ণতায়,সামগ্রিকতায়,বিশুদ্ধতায় ।"প্রকৃত সৎ কবিতানির্মাণের যে সত্যিই কোনও অক্ষরেখা দ্রাঘিমারেখা হয় না,সে কথা সেদিন কবি আলোক সরকারের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছিলাম ।তিনি "কবিতা নিয়ে "গদ্যে যেমন লিখছেন, "বিবিধ অভিজ্ঞতা কবিতায় একত্র করি,কখনো একত্র হয়।সেই উজ্জ্বল সমাহার, সেই আয়োজন যে সোনালী সুতোকে প্রয়োজনে চায়,সেই সুতোর বিচিত্র কারুকাজ, সেখানে কখনো অলৌকিক হীরা,কখনো রহস্যসুদূর তারার নিবিষ্টতা।"তাই কবি বারবার তাঁর কবিতায় নিষ্পাপ এক বাগানের খবর এনে দিতে পারেন।যেমন,"ফুল কুঁড়ির পরবর্তী পর্যায়/ফল অবিমিশ্র এক পরিণতি/মাটিতে ঝরে-পড়া পাতা কোনও মৃত্যুছবি নয়।"
                     সবসময়ই নিজস্ব কোনও বিষয় নিয়ে বলতে গেলেই কবির একধরণের দোলাচল কাজ করতো।হয়তো এই কারণেই যে প্রতিটি সৃষ্টিশীল মানুষের মতো তিনিও ছিলেন নিভৃতচারী ।তাই সেই মানুষটি আত্মযাপন লিখতে বসলেও সেই অনতিদূরের দ্বিধা কাজ করবে সন্দেহ নেই।তাই "আমার কবিতা জীবন"--এর প্রারম্ভিকেই "আমার কবিতা "শীর্ষক গদ্যে কবি লিখছেন,"আমার বয়স যখন বারো বছর আমি মনে করেছিলুম আমার একটি আত্মজীবনী লেখা প্রয়োজন।বারো বছর পার হয়ে কৈশোর যৌবনের নানান বাঁকে এবং পঞ্চাশের প্রায় কাছাকাছি এসে আমি মনে করছি আমার একটি আত্মজীবনী  লেখা অত্যন্ত জরুরি ।অথচ বারো বছর বয়সে যেমন,এই প্রৌঢ়ত্বের সীমায় এসেও আমি তেমন কোনও ঘটনা,তেমন কোনও ঘাত-প্রতিঘাত,বিপর্যয় অথবা উৎসবের কথা মনে করতে পারছি না যার জন্য একটি গ্রন্থরচনা অত্যাবশ্যক হতে পারে।"এই সৎ স্বীকারোক্তির পরেপরেই কবি বিস্তৃত করেছেন কীভাবে ধীরেধীরে কবিচেতনা মানসের অবচেতনে ক্রমশ গড়ে ওঠে।উনিশশো পঞ্চাশ সালে কবির "উতলনির্জন" কাব্যগ্রন্থ যখন বের হয়,কবির বয়স তখন আঠারো বছর ।এবং এই "আবেগী একাকিত্বে" কবি, সুধীন্দ্রনাথ বা অমিয় চক্রবর্তীর মতো বিপরীত মেরুপ্রান্তবাসী দুই মহীরুহকে দ্বিধাহীন একাগ্রতায় আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে পারলেন ।তার সঙ্গে যুক্ত হন মানবেন্দ্রনাথ রায়ের যুক্তিনিষ্ঠ বস্তুবাদী দর্শন ও রাবীন্দ্রিক অধ্যাত্মদর্শন।তবু কবির মনে হল একদিন "নিজস্ব কাব্যভাষা কাব্যআঙ্গিক যতদিন না অর্জন করতে পারছি,যতদিন না প্রতিষ্ঠ হচ্ছি স্থিত মানসতায়,ততদিন কবিতা রচনা না করাই ভালো ।"দেড় বছর কবি একটাও কবিতা লিখলেন না।শব্দপ্রয়োগ ভাষাবিন্যাস ছন্দব্যবহার নিয়ে তরুণ কবির তারুণ্যে ওলটপালট করছেন কবি।সহযোদ্ধা বন্ধুকবি দীপংকর দাশগুপ্তের ছান্দিক দক্ষতা তাকে বিস্মিত করছে।তারপর তিনি বুঝতে পারছেন,"ছন্দ শব্দের প্রকৃত তাৎপর্য ছন্দোহীনতা।"হয়তো এই বোধোদয়ই কবিকে একদিন এগিয়ে দিল "আলোকিত সমন্বয়"-এর দিকে।কবি লিখছেন ,"যদিও আলোকিত সমন্বয় আমি দ্বিতীয়বার রচনা করিনি,বারবার নতুন বিন্যাসে,নতুন প্রেক্ষিতে জেগে উঠতে চেয়েছি।"কিন্তু ভাবনা যেমন রয়েছে, তার নিজস্ব প্রসারতার জন্য ভিতরদালানও যে চাই।তখন কবির সঙ্গে অরবিন্দ গুহ,সত্যেন্দ্র আচার্য, বিমল রায়চৌধুরীর মেধাসান্নিধ্য ঘটেছে।কবিবন্ধু দীপংকর দাশগুপ্তের তৎপরতায় জন্ম নিল বাংলা সাহিত্যের আরেক মাইলফলক,"শতভিষা"।আলোক সরকার লিখছেন,"আলফা থেকেই প্রকাশিত হয় শতভিষা।দীপংকরই সম্পাদক, দীপংকরই প্রকাশক।আমার মনে হয় শতভিষা দীপংকর আমার জন্যই প্রকাশ করেছিল, যাতৃ আমি খুশিমতো লিখতে পারি,যে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারি।শতভিষা-কে আমি আমার প্রয়োজন মত এবং ইচ্ছেমতো ব্যবহার করেছি,শতভিষা-কে বাদ দিয়ে আমার কবিতা রচনার জীবন যে বিশেষ ক্ষতিগ্রস্থ হত তাতে সন্দেহ নেই ।"এই অকপট বন্ধুঋণ স্বীকার সমসময়ের আরেক প্রান্তেও ঘটছে তখন।সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে জন্ম হচ্ছে "কৃত্তিবাস "-এর।শতভিষা ও কৃত্তিবাসের দুই আদর্শগত সংঘাতও অনতিক্রম্য দূরে বাংলাসাহিত্য চিন্তাশীল করে তুলবে সন্দেহ নেই।তবু এরই মধ্যে যে নিষ্কলুষ সততার প্রকাশ প্রকট হয়ে ওঠে, তা সমসাময়িক সাহিত্যচয়নে বিরল।অতি বিরল।বন্ধুতাও।বিরোধটুকুও।
   
               বাংলা কবিতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে সমর সেন লিখেছেন, "কবিতার সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক কী সেটা বলা কঠিন ।অনেকে বলেন কবিতা আসে শুধু অন্তঃপ্রেরণার তাগিদে ।কথাটি বলা সহজ,কিন্তু সঠিক নয়,কারণ অন্তঃপ্রেরণা শুধু অন্তরের জিনিস নয়,তার মূল উৎস বিশাল ও বিক্ষুব্ধ বহির্জগত।"সেই সূত্র ধরে চললে আলোক সরকারের কাব্যিক অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীত দ্রাঘিমায় বসবাস করে।সেকথা বোঝাতে কবি "জ্বালানি কাঠ,জ্বালো"শীর্ষক গদ্যে নিয়ে এলেন শচিমাতা আর নিমাইয়ের উপমা।"ডাকে শচিমাতা নিমাই নিমাই /প্রতিধ্বনি বলে নাই নাই, নাই ।যা চলে যাচ্ছে তাকে তুমি যতই ডাক দাও তার উত্তর কেবল এক অমোঘ নিশ্চিত -না।"নন্দনতত্ব নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি  গোলাপ নিয়ে বলছেন।গোলাপ সম্পর্কে প্রচলিত  বর্ণ,স্নিগ্ধতা নম্রতা আমাদের মানসিক গঠনে আগে থেকেই ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে ।আর সেই কারণেই সেটুকু ভেঙে ফেলে ব্যক্তিগত পৃথিবী নির্মাণ, ব্যক্তিগত জেগে-ওঠা,রূপকলা অতি আবশ্যক ।আর এই নির্মাণ প্রক্রিয়ায় আশ্চর্য কেন্দ্রক হয়ে থাকে এক ধরণের পরম শূন্যতা ।কবি লিখছেন, "....একজন কবির সঙ্গে আর সব মানুষের মৌল তফাত এইখানে যে কবি তার না-হতয়াকে যেভাবে জাগরণের মধ্যে বুঝতে চায়,বিশ্লেষণ করতে চায়,তার অনুপস্থিতিকে যেভাবে সর্বক্ষণের বোধের মধ্যে রাখে,আর সব মানুষ প্রত্যক্ষত সেদিকে তেমন মনোনিবেশ ঘটায় না।একজন কবি নিজের হওয়াকে প্রশ্ন করে,আর তার না-হওয়া সে তো এই প্রশ্নেরই অন্তর্লীন ।"
                 
               আলোক সরকার লিখছেন "কোনও কোনও শিল্প আছে,যেমন শিল্প-যাত্রা,যার ভিতরেই উদ্ভাসন আবার যাওয়ার ভিতরেই নিঃশেষ।তার ফসল কেবল একূল-ওকূল একটা 'না',তার কোনও ঊর্ধ্বাকাশ নেই,নেই নিম্নভূমি-সর্বতো নিরাশ্রয়,সর্বতো স্বাধীন, নিরাসক্ত নিবিড় একটা অবস্থান ।"সাধনার লাভ করা সেই সর্বরিক্ততাই কবির কাছে সর্বোচ্চ প্রাপ্তি ।কবি আলোক সরকারকে নিবিড়ভাবে পেতে গেলে তার কবিতাজীবন পড়তেই হবে।সেখানে কবিই হয়তো কোথাও প্রান্তরেখা টেনে দিয়ে বলবেন, "আমার কাব্য -আদর্শ কী এ প্রশ্নের সামনে দাঁড়ালে আমি বলব অন্তত কবিতার প্রসঙ্গে আমার কোনও আদর্শই নেই।অথবা আদর্শহীনতাই আমার কাব্য-আদর্শ।আমি যে নির্মাণের কথা বলেছি তা কোনও আদর্শকে সামনে রাখে না ,তা কেবল হয়ে উঠতে চায়,হয়ে উঠতে চায় সম্পূর্ণতায়,সমগ্রতায়।"এমন অকপট ও স্বচ্ছ স্বীকারোক্তি কেবল আলোক সরকারের মতো যুগান্তকারী কবিরাই পারেন।সেখানে পাঠকের ভূমিকা শুধুই মন্ত্রমুগ্ধতার।সরোবরের সামনে মহানন্দে আলোকিত হয়ে থাকা তিনটি গাছের মতোই।
                   
গ্রন্থঃ আমার কবিতা জীবন; আলোক সরকার; প্রকাশক:অভিযান;প্রচ্ছদ পার্থপ্রতিম দাস।৫০০ টাকা

No comments:

Post a Comment