Sunday 18 March 2018

সৌমাভ



যে সব গ্রন্থ প্রত্ন নয়, বন্ধু, সহবাসী


রাণা রায়চৌধুরীর “একটি অল্পবয়সী ঘুম ও শরীরে সন্দীপন নেই”: আধুনিকতার আগুনপুঁজ


রাণা রায়চৌধুরী নয়ের দশকের অন্যতম শক্তিশালী কবিদের একজন। আত্মপ্রচার ও তথাকথিত সমস্ত গ্ল্যামার থেকে সরিয়ে নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন স্বতন্ত্র কবিতা ভাবনা ও নিভৃত কবিতা সাধনায়। কবি রানা রায়চৌধুরীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ “একটি অল্পবয়সী ঘুম” (১৯৯৬) ও দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ “শরীরে সন্দীপন নেই” (১৯৯৮) একত্রে “নাটমন্দির” থেকে “একটি অল্পবয়সী ঘুম ও শরীরে সন্দীপন নেই” নামে পুনপ্রকাশিত হয় ২০১৫ তে কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন মেলাতে। কবির কবিতা তাঁর ব্যক্তিগত জীবনযাপন থেকে উঠে আসা সৎ পবিত্র মন্ত্র উচ্চারণের মত। তাঁর কবিতা মধ্যবিত্ত মানুষের দৈন্যন্দিনের আনন্দ, আশা, আকাংক্ষা, হতাশা, যন্ত্রণা, না-পাওয়া, স্বপ্নে ভরপুর। প্রতিটি কবিতা তাঁর নিজস্ব ভাবনা ও অভিনবত্বে উজ্জ্বল
একটি অল্পবয়সী ঘুম” এর প্রথম কবিতা ‘যাদবপুরের মোড়’ যেখানে যাদবপুরের মোড় মনুষ্য জীবনের সমস্ত আশা বেদনা স্বপ্নের শেষ স্টেশন; সব তহবিল, গ্রাচুইটি, ভুমিকম্প, সিঁড়িভাঙ্গা অঙ্ক, ‘আমগাছ, ভগবান, লালগোলা-প্যাসেঞ্জার, আমেরিকা’, ‘যতখুশি ইয়ার্কি’, রংবেরঙের বৃষ্টি পেরিয়ে যেখানে থামতে হয়— যেন সব পাখি সব নদী ঘরে ফেরার পর যাদবপুরের মোড়েই ‘ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন’। কবির কবিতার দুর্দান্ত একটি গুন হল যে, কবিতাগুলি সাধারণ স্টেটমেন্টে থেমে থাকে না। চেনা মধ্যবিত্ত গণ্ডি ভেঙ্গে, ছা-পোষা স্বপ-পরিসর ছিঁড়েমুছে ঢুকে পড়ে এক অপরূপ আলোআঁধারি সুররিয়ালিস্ট মায়ালোকে, যেখানে বাস্তবের বেড়া খুলে খলবল করে ঝুলতে থাকে, যেখানে কবির রক্ত-মাংস-ঘাম-স্বেদের ভিতরে ঢুকে পড়ে কল্পজগতের লাল, নীল সবুজ জল। ঢাকের বাজনা, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, কাশফুল, বোনাস, ধনেখালি শাড়ির নতুনগন্ধ, সম্পূর্ণ শরৎকাল সেই জলে ভাসতে ভাসতে ‘চন্দননগর পেরিয়ে, নৈহাটি পেরিয়ে, গঙ্গোত্রী পেরিয়ে পৃথিবীর বাইরে অন্য কোনো পুজোপ্যান্ডেলে’ নিয়ে যায় কবিকে যেখানে তিনি বসে থাকেন ‘গ্রীষ্ম, বর্ষা, হেমন্তের প্যান্ডেল’ নিয়ে। একা। আর দেবী যান ‘ভাসানে’। তারপর একদিন কবির সঙ্গে দেখা ‘ভারতবর্ষের পিওন’ এর সঙ্গে, ‘ব্যাগভর্তি পুরুলিয়া নিয়ে’ যে ‘ছুটছে সারা জীবন’; কবি পোস্টকার্ড খুলে দেখেন ‘প্যাস্টেল রঙের মেঘ/ বৃষ্টির ইচ্ছেটুকু নিয়ে বেঁচে আছে’। কবি হেঁটে যান এক ভালো লাগা বিকেলের দিকে যখন ‘গানের স্কুলগুলো হাসপাতালের দিদি হয়ে’ সেবা শুশ্রূষা করে কবির ক্ষতবিক্ষত (“বিকেল”); এই বিকেল আসলে কবির হঠাত দেখা প্রেমিকার মতঃ ‘একেবারে মুখোমুখি— টুকটুকে তার মন’, যে ‘বিষন্নতা বোঝে আর যাকে পেলে ‘অক্ষয়কুমার বড়ালও নির্ঘাত মধ্যাহ্ন ছেড়ে উঠে আসতেন’। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থের অসামান্য কিছু কবিতা হল “পঁচিশে বৈশাখ”, “আমেরিকা থেকে গোল আসছে”, “পাওনাদারদের উঠোন”, “২২ শে শ্রাবণ”, “পোকাদের নিয়তি যেমন”, “একটি অল্পবয়সী মৃত্যু”, “ছাতা”, “কৃষ্ণনগরের দিকে যেতে যেতে”, “বাংলাভাষার মাদুর”, “দেবী”, “ডিসেম্বর”, “বাজনা” “অ্যাকসিডেন্ট”, “কলকাতা মানে কি”, “একটি অল্পবয়সী ঘুম”, “ডানায় ট্যবলেটের শব্দ”, “ছাতা”, “বাংলাভাষার মাদুর” ও “পাজামা এবং টুকিটাকি” ইত্যাদি ইত্যাদি।
কবি রাণা রায়চৌধুরীর কবিতার আর একটি বিশেষ দিক যা আলাদা করে উল্লেখের দাবী রাখে, তা হল তার ‘ইমেজারি’ অথবা উপমা চয়ন। তাঁর উপমাগুলি আশি-নব্বই দশকের মফস্বলীয় জীবনের আটপৌরে স্মৃতিমেদুরতা, আশি-নব্বইএর সাংস্কৃতিক স্মৃতির (Cultural Memory) জলে চুবানো। সেই কারণে টিভির উপমা এসেছে বারবার। “আমেরিকা থেকে গোল আসছে” কবিতায় কবি দেখছেন ‘আমাদের ঘরভর্তি আমেরিকা/ এন্টেনা দিয়ে গোল আসছে,/ আর আমরা জাল থেকে বল কুড়িয়ে আনছি”। এই জাল আসলে একটা সীমা, একটা লক্ষ্য— খেলোয়াড় এবং সব দর্শকের (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য কবি প্রথম জীবনে ফুটবলার হতে চেয়েছিলেন, যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ), এই জাল আসলে মধ্যবিত্তের পাঁচিল, যাঁর ওই পারে আছে আমেরিকা ও মারাদোনা; আর আট নয়ের দশকে সকল বাঙালিকে জাল থেকে বল কুড়িয়ে আনার সাহস দিয়েছিল টিভির পর্দা। “২২ শে শ্রাবণ” কবিতায় টিভিতে নামছে তুমুল বৃষ্টি; ৮.৩০ এর রাণাঘাট লোকালে ‘মারের সাগর পাড়ি দিলেন সুচিত্রা মিত্র’ সঙ্গে ‘টিফিন কৌটো, জোয়ানের শিশি, অম্বলের ওষুধ’। এইভাবে কবি বুনে চলেন তাঁর নিজস্ব ম্যাজিক রিয়াল জগৎ যেখানে কল্পনার জগতে অনায়াসে ঢুকে পড়ে বাপী চানাচুর, ট্রেডার্স এসেম্বলি এবং কুকমী ডাটা।  ‘চাপা উচ্ছাস’ কবিতায় কবিতায় এক দুপুরে কবি বোকা বোকা থেকে ‘গাড়ল’ হয়ে ওঠেন, তিনি একাকীত্বে যৌনকাতর হয়ে ওঠেন; তাঁর বি-কম সার্টিফিকেট থেকে ধোঁয়া উড়তে থাকে, তিনি আগুনের ‘কমা বাড়ার’ (‘আমি তার আগুন কমাচ্ছি। আগুন বাড়াচ্ছি’)ভিতর দিয়ে স্বমেহন উদযাপন করেন— তাঁর ‘চাপা উচ্ছাসে ভিজে যাচ্ছে ইকনমিকসের প্রশ্নপত্র/ অ্যাকাউন্টেন্সির বই থেকে দ্রুত নিঃশ্বাস পড়ছে’। সত্যি, একজন তরুণ কবির দুপুররঙের শাদা থকথকে উচ্ছাসের কাছে কত অসহায় লাগে প্রতিষ্ঠান, সার্টিফিকেট, ইকনমিকস, অ্যাকাউন্টেন্সি ও বি-কম ডিগ্রি।
কবির আর একটি পছন্দের উপমা হল ‘মশারি’; “কলকাতা মানে কি”, “বাজনা” ও “একটি অল্পবয়সী ঘুম” কবিতায় ‘মশারি’র উপমা এসেছে ঘুরেফিরে “কলকাতা মানে কি” হল এমন একটি কবিতা যাঁর সামনে চোখ বন্ধ রেখে হাঁটু মুড়ে বসা যায়। প্রথম কয়েকটি লাইন— ‘কলকাতা হল বাংলাভাষার মশারি। কলকাতা মানে/ চারকোণ টানটান— পেরেকে আটকে থাকা রাত/ কলকাতা মানে সাকসেস রিভিউ অবধি কমপিটিশান/ কলকাতা মানে ঝাঁকঝাঁক তরুণ স্টেটবাস, যেন এইমাত্র ইয়ার্কি মারল গ্যারেজের ভিতরে/ .../ ধরা যাক শিয়ালদার ন’নম্বর প্ল্যাটফর্মে কবিতা পড়তে এসেছে গিমিকবাজ চাঁদ/ ধরা যাক, ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে প্রাতভ্রমণে এসেছে গ্রামবাংলার হ্যারিকেন এবং ঝোপঝাড়ের বাঁশ/ .../ কলকাতার মানে এসবও হবে হয়তো’। শেষমেশ কবি ‘কলকাতার আসল মানের’ জন্য পৌঁছে যান ‘১৯৫৪ সনে, ট্রামের তলায় লেখা কবিতার পান্ডুলিপি যেটি আজও প্রকাশিত হয়— টালিগঞ্জ ট্রামডিপো থেকে; যেন কবির কলকাতার আসল মানে খোঁজা জীবনানন্দ অনুসন্ধানে সম্পূর্ণ হয়। আর একটি অনবদ্য কবিতা “ডানায় ট্যাবলেটের শব্দ”; কবির অনুনকরণীয় উচ্চারণ— ‘বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের চরাচর দেখে যখন বেরলাম/ তখন আমার গা ভর্তি পাখি/ আমার আকাশ তখন পিজি হাসপাতালের ছাদ টপকে/ সম্ভবত ডায়মন্ডহারবারের দিকে ঝুঁকে পড়েছে/ ডায়মন্ডহারবারের ঐ দিকেই বোধহয় দিগন্ত আছে—/ পাখিরাই দিগন্তের খোঁজ জানে—/ চরাচর দেখার পর আমি পাখি দ্বারা আক্রান্ত/ আমি দিগন্ত দ্বারা আক্রান্ত/.../ আমার ৩২ বছরের আকাশ ঠিক উত্তর চব্বিশ পরগনার সাইজে/ পৃথিবীর এক কোণে পড়ে আছে’। একজন আত্মদ্রষ্টা দার্শনিক কবিই পারেন এই অমোঘ উচ্চারণের সামনে দাঁড়াতে— ‘চরাচর আমার মান্থলি টিকিটের মতোই/ চৌকোণো এবং পকেট সমান’। “পাজামা এবং টুকিটাকি” এমন একটি কবিতা যা প্রতিটি তরুণ কবির মনের কথাকে কি অনায়াসে কি সহজে অথচ কি গভীর ব্যঞ্জনায় ব্যক্ত করে। কবিতাটি শুরু হয় এইভাবে ‘পাজামা মানে তিরিশ টাকা দামের রাত্রি/ আর রাত্রির ভিতর পাখির বাসা’; তারপর দ্বিতীয় স্ট্যানজায় ‘পাজামা মাঝে মাঝে চাকরি খুঁজতে যায়/ তার চাকরি চলে যায় তেপান্তরের মাঠে—/ তেপান্তরের মাঠের ধারে পার্টি অফিস/ পার্টিঅফিসের ধারে শনিমন্দির। শনিমন্দিরের ভিতরে চাকরি।/ আর চাকরির ভিতরে তেল চকচকে বাঁশ/ আর বাঁশের ভিতর তরুণ কবির ছটফটানি/ ছটফটানির মানে কি? ছটফটানির কোনো মাণে নেই/ শুধু বলা যেতে পারে তাকে অনেকটা পাজামার মতো দেখতে—/ শাদা এবং দড়িতে ঝুলে থাকা অসমাপ্ত প্রাণ’। আসলে এই পার্টিঅফিস, শনিমন্দির, চাকরি, তরুণ কবির ছটফটানি মুর্শিদাবাদ থেকে মেচেদা, বিষ্ণুপুর থেকে ব্যারাকপুর, ডায়মন্ডহারবার থেকে ডোমকল, শিলিগুঁড়ি থেকে সালকিয়া সব জায়গার অত্যন্ত চেনা চিত্রকল্প যা অসামান্য দক্ষতায় কবি তুলে ধরেছেন কবিতাটিতে।
কবির প্রথম দুই কাব্যগ্রন্থ প্রকাশকালের ঠিক  মাঝে পরলোক গমন করেন কবির মা। তাই কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থের (“শরীরে সন্দীপন নেই” উৎসর্গ পাতায় লেখা ‘২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৭, যাঁরা শ্মশানে গিয়েছিলেন’।প্রবেশক কবিতাটিতে কবি লিখছেন, ‘মাঝে মাঝেই মনে পড়ছে তোমার মুখ/ সেই তুমি পান সাজছো, রান্না করছো/ সাধারণ শাঁখা-পলার মত পলকা দিন কাটাচ্ছো/ ... কাজের ফাঁকে ফাঁকে/ মনে হয় তুমি পানকৌড়িদের দলে ভিড়ে গেছ’; “চিল” কবিতায়— ‘তুমি কী ঈশ্বর ছিলে? ছিলে কী?/ তোমার কৌতুহল মাংসের কারুকাজ ছেড়ে/ আজ শান্ত,/ ব্যথা পাও, কষ্ট পাও।/ আয়ুকষ্ট লেখো তুমি আকাশে আকাশে...’কবির জীবনের না থাকা, না পাওয়া, ‘নেই’ গুলো এসেছে বারবার নান আঙ্গিকে নানান ভঙ্গিমায়; “তোমাকে বিশ্বাস করি বলে” কবিতায় কবি লিখছেন, ‘হর্ণ নেই, বাতি নেই উচ্চ-আকাঙ্ক্ষা নেই এমন রিক্সায়/ চলেছে আমরা টুকরো টাকরা মৃত্যু/ আমার কেরানিজীর্ণ দুর্বল মৃত্যু/ কতদূর যাবে সে?’; “তেরে কেটে তাক-তাক’ কবিতায়— ‘আমার কোনওটাই নেই/ সমুদ্র নেই, দে’জ নেই, ২০% ছাড়ের স্তব্ধতাও নেই/ আমি হস ধাতুর হায়ের মধ্য থেকে বেরিয়র আসা গমগম/ আমি সুতির-তরুণ, আমি টো টো চপ্পল/ আমি হঠাৎ ফেটে যাওয়া আনন্দধারা’; “একটি অ-যৌন কবিতায়”— ‘রবিবার নৌকোর ভিতরে হাওয়া নেই/ রবিবার অনিশ্চয় নেই/ রবিবার— ‘ইচ্ছে করছে না, আজ থাক, কাল আবার স্কুল আছে’... অনিশ্চয় জানে না – কে বলেছে? অনিশ্চয় জানে যে, সমস্ত আদর্শের পিছনে, হস্তমৈথুনের স্পিড কাজ করে।/ কারও এক হর্স পাওয়ার, কারও কারও হর্স দাঁড়িয়ে ঘুমচ্ছে—’এর পর চুপ করে যাওয়া ছাড়া কাজ নেই।
এই কাব্যগ্রন্থের অসম্ভব সুন্দর বৈশিষ্ট্য হল নিজস্ব এবং সামাজিক যন্ত্রনা-ক্ষতর অপরূপ বর্ণনা। কয়েকটি উল্লেখযোগয় কবিতা হল “চিল”, “কোলাহলের শেষ অংশটুকু”, “একটি রোগা কবিতা”, “একটি অ-যৌন কবিতা”, “চেয়ার”, “একটি এবড়ো-খেবড়ো কবিতা”, “একটি মনমরা কবিতা”। এই কবিতাগুলি এতোটাই স্বকীয় ভাবনায় ভাস্বর যে লাইনগুলির ভিতরে মাদুর পেতে ঘুমিয়ে পড়া যায়, ঘুম ভেঙ্গে নিজেকে ও কবিতার চরিত্রদের প্রশ্ন করা যায়। “একটি মনমরা কবিতা” নামক কবিতায় কবি লিখছেন “আগামীকাল যে-মেয়েটি নষ্ট হবে তার কথা ভাবি।/ নষ্ট হবার আগে তার মনের কথা ভাবি। কাঠবেড়ালির দৌড়ঝাঁপ/ পুড়ে যায় তার মনের ভিতরে/.../ আমি দেখি তার দীর্ঘশ্বাস পায়ে হেঁটে/ জল কুড়োতে যায় কলমিনদীর ধারে—/ উতপল্গাছের নিচে, ভাস্করগাছের নিচে.../ ময়ূরবাগান পুড়ে যায়.../ পুড়ে যায় মেঘের স্নায়ু। বৃষ্টির শিরা বেয়ে পুঁজ নামে/ আমাদের লিরিকের ভিতর’। কবির নিজস্ব যাপন, সাইকেল যাপন উদযাপিত হয় “দুর্যোধন”, “একটি অন্যমনস্ক কবিতা” প্রভৃতি কবিতায়; যেমন “দুর্যোধন” কবিতার শেষ অংশ— ‘দ্রৌপদী ভালো আছে ফার্ণ রোডের বাড়িতে/ গান শেখে, রবীন্দ্রনাথ—/ তাঁতের পাছা, অবসরে টিভির ফেনা মাখে গায়ে/ আর তুমি – ব্রণ-অধ্যুষিত, মাছি অধ্যুষিত,/ খুঁজছো টিউশনি, ‘রক্তমাখা ঠোঁটে’—/ মফঃস্বলে, সুতির সাইকেলে’; “একটি এবড়ো-খেবড়ো কবিতা”য় ‘আমি সারারাত আমার ক্লান্ত ক্ষতের দিকে চেয়ে থাকি/জ্যোৎস্না পড়ছে তাতে/.../চুলকে চুলকে কেরিয়ারের রঙ তুলে ফেলি/ কেরিয়ার থেকে কষ গড়ায়, রঙ বেরঙের কষ, বোকা বোকা কষ/ আর অবসাদ থেকে রক্ত ঝরে, লেখাপড়া জানা রক্ত। গ্রাজুয়েট রক্ত”। এইভাবে বারবার মধ্যবিত্ত জীবনের আকুতি-কান্না-যন্ত্রণা-স্বীকারোক্তি নানান আটপৌরে অথচ গভীর চিত্রকল্পের মাধ্যমে।
কবির জীবনানন্দ অনুসন্ধান শেষ হয় কাব্যগ্রন্থের শেষ কবিতা “অন্ধকার আত্মার উপস্থিতিটুকু”তে যেখানে কবি দেখতে পান— “ঐ তো তাঁর গা দিয়ে মাঠের আভা। কুয়াশার আভা—/ঐ তো জীবনানন্দ দাশ পলতাবাজারের বাইরে দিয়ে/ চলে যাচ্ছেন/ চলে যাচ্ছেন অন্ধকারের আত্মা টপকে, বই খাতার কঙ্কাল টপকে/ পৃথিবীর শতাব্দী-শতাব্দীব্যপী জলের ভিতর”। আর আমাদের কবি বসে থাকেন একা এক ‘থেঁতলানো-মনখারাপ’ নিয়ে, কোন ‘মিছিল নেই, ঝান্ডা নেই’, কবির থলের ভিতরে সিঙাড়া সাইজের ‘মৃদু আয়ু’, কবির ‘শরীরে কোন সন্দীপন’ (সন্দীপন কথাটির অর্থ আকুতি কিংবা কান্না)নেই। যখন ‘আমজনতা ভাস্কর-আলো, শঙ্খ-রশ্মি গায়ে মেখে, রাঙা-ক্লান্তি ভেঙে/ বেড়াতে যাচ্ছে কোনও অরণ্যের সবুজ হৃদয়ের দিকে’ তখন আমাদের কবি রাণা রায়চৌধুরী ‘ব্যারাকপুর থেকে শিয়ালদা’ ছাড়িয়ে চলেন ‘গোধূলি রিক্সার’ পিছুপিছু ল্যা-ল্যা রোদে ‘মফঃস্বলে সুতির সাইকেলে; কবির পায়ে পায়ে ‘ঠাট্টা-ইয়ার্কির’ মত জড়িয়ে যায় ‘শাদা-দৌড়ঝাঁপ’; কবি একে একে পেরিয়ে যান উৎপলগাছ, গৌরাঙ্গদেবগাছ, শৌনকগাছ, কল্পর্ষিগাছ, ভাস্করগাছ; কবি রাতের কোটরগুলি ভরে দেন তাঁর আগুনবীজ ও আগুনপুঁজ দিয়ে; কবির ঢলঢলে জীবন-মৃত্যুখানি ধেয়ে যায় ‘অরুন্ধতী তারা’টির দিকে। আমরা আমাদের ব্রণময় উচ্ছাসে, পাজামায়, পাজামার দাগে, দোলের দিনে বসন্তের দিনে আমাদের উত্তর-আধুনিক জীবনানন্দের পিছুপিছু আধুনিক-আগুনপুঁজের সন্ধানে মন্ত্রমুগ্ধের মত হাঁটতে থাকি।








 অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের “বউপদাবলী”: দাম্পত্যের আশ্চর্য পাকশালা  

কবি অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায় নয়ের দশকের এক উজ্জ্বল কণ্ঠ এবং একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি। কবি অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ষষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ "বউপদাবলী" সিগনেট থেকে প্রকাশিত হয়েছে ২০১৮ বইমেলায়। “বউপদাবলী”র আগে প্রকাশিত তাঁর কয়েকটি বই যেমন “কবিদানব” (আনন্দ), “উল্কাখোর ছেলে” (একুশ শতক) প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের মূল বিষয় ছিল নিজস্ব যাপনচিত্র, যন্ত্রণা ও শহরতলিতে এক যুবকের বড় হয়ে ওঠার আলেখ্য। “বউপদাবলী” স্বাদে ও গন্ধে তাঁর আগের কাব্যগ্রন্থগুলির তুলনায় আলাদা। এই কাব্যগ্রন্থের মূল উপজীব্য প্রেম, রোমান্টিকতা, বিশাস এবং মূল্যবোধএই কাব্যগ্রন্থটি এক চিরন্তন সামাজিক প্রথায় বিশ্বাসের দলিল যা মনুষ্যজীবনের পরিপূর্ণতা, ভালোবাসা এবং সম্পর্কের সুস্থ ও ইতিবাচক দিকের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে।
দান্তের যেমন বিয়াত্রিস, সিডনির যেমন স্টেলা, স্পেনসারের যেমন্ এলিজাবেথ, অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের তেমনই শুভ্রা। এই চিরন্তন প্রেমের কবিতাগুলি যেন এক প্রবহমান চলন্ত প্রেমের গাড়ি; অনায়াস এবং কি দুর্দান্ত সাবলীল ভঙ্গিতে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় প্রণয়, খুনসুটি, কলহ, যৌনতা, দেহরস, দেহাতীত অনুভব, পবিত্রতা ও আরাধনা নামের চিরন্তন দাম্পত্যের স্টেশনগুলি। কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘প্রেমাস্পদী’তে তাই এই কাব্যগ্রন্থের সমস্ত দিকগুলি সুচারুভাব্র ধরা আছে; দেহবাদ (‘ছোঁয়াছুঁয়ির সৃষ্টিধারায় লজ্জা পাচ্ছে মাটি...’), অনুভব (ধরো উপচার, আনন্দ আর আবেশ আমার, যাহা...!/ ধুপগুড়ি যাক গঙ্গানদী, হুগলি ফাটক পাহাড়...’, আত্মুনুসন্ধান (‘চতুর্দিকেই শব্দসাড়া... ডাকছে এসে কারা!/ নিজের দিকে তাকাও পাবে ভিতর থেকে সাড়া’), আরাধনা (‘আস্তে আস্তে আসছে সবাই একজনা দুইজনা—/ শুভ্র শুভ্রা মন্ত্রে দেবীর আরাধনা’)

সপ্তদশ শতকের বিখ্যাত মেটাফিসিকাল কবি জন ডানের সেই অমর কবিতা ‘The Good Morrow’ মনে পড়ে যায়, যেখানে একদিন সকালে দুজন প্রেমিক-প্রেমিকা আবিষ্কার করেন তাদের চিরন্তন ও আসল প্রেমের উপলব্ধিটি। সারারাত প্রেমিকার সঙ্গে কাটানোর পর প্রেমিকটি উপলব্ধি করেন তার আগের সব প্রেমগুলি আসলে মোহ এবং মিথ্যা ছিল, শৈশবের খেলা ছাড়া কিছু ছিল না। সে কারণে প্রেমিকটি তাদের নব-উপলব্ধ/ নব-উদ্ভাসিত প্রেমের সত্তাকে (Newly awakened souls) সম্ভাষণ/ ‘Good Morrow’ জানান। এই কাব্যগ্রন্থেও কবি পূর্ব ব্যর্থতা, গ্লানি মিথ্যে মোহ ভুলে তার ‘বৌপরি’র মধ্যে আবিষ্কার করেন নতুন, উদ্ভাষিত ও পবিত্র এক প্রেমের সকাল; তাই এই কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি লাইন প্রতিটি অনু-পরামানুতে প্রেমের পবিত্র মন্ত্রে যেন জারিত হতে থাকে দুই চিরন্তন প্রেমিক-প্রেমিকা।

উপমা চয়নের সময় ভৌগোলিক সীমারেখা, সাধারণ সাংসারিক বেড়াজাল ভেঙে কবি এক অপার বিশ্বলোক হতে উপমাগুলি তুলে আনেন। ‘শাঁখারিনী’ কবিতায় খুবই অর্থপূর্ণভাবে কবি বলছেন ‘একের থেকে বেরিয়ে আসছে হাজারখানা বউ’, আর পুরো কাব্যগ্রন্থেজুড়ে সহধর্মিনী শুভ্রা-বউ এর হাজার হাজার রূপ খুঁজে চলেন কবি।'কুজন কাব্য' কবিতা্য় কবি বলছেন— 'শুভ্রা-সুনীল, শক্তি-শুভ্রা, শুভ্রা-কৃত্তিবাস/ ধুকপুকুনি ধড়ফড়ানি নাভির থেকে শ্বাস'শুভ্রা নাম্নী 'বউ' ব্যক্তিগত পরিসর থেকে বেরিয়ে চিরন্তন প্রেমিকা হয়ে ওঠেন। বউ এর তুলনায় এসেছে রাধা, ম্যাডোনা-ডিলান, জাহানআরা, মমতাজ, মুখ্যমন্ত্রী, ইত্যাদি। ‘স্ত্রীয়াশ্চরিত’ কবিতায় কবির আনন্দময় অনুভব— ‘বরকন্দাজ বউ মুমতাজ বানাচ্ছি তাজমহল/সদা-সতর্ক দিন পাহারায়, প্রহর প্রহর টহল / বউটি আমার জাহানআরা, শতায়ু মমতাজ/ দিবস রজনী সজন-সজনী চালায় সৃষ্টিকাজ.../ বউ হল ঝি, মুখ্যমন্ত্রী, স্টুডেন্ট, হিরোইন.../ ডাঙায় তোলা পুং-ইলিশের অবস্থা সঙ্গিন’/ .../ বউ পাগলা, বউ পিপাসু, বউ প্রণয়ী আমি—/ এক রাতেই বদলে হলাম গরিব থেকে আমির/ .../ সুজন যদি হয় তাহলে তেঁতুল পাতায় ন’জন—/ ‘বউ ভজনা শেষ হবে না’ কহেন কবি অয়ন’। এই ভাবে কাব্যগ্রন্থের ছত্রে ছত্রে বউ এর নানান রূপ অসামান্যভাবে ফুটে উঠেছে।

কিন্তু কাব্যগ্রন্থের আসল উপজীব্য হল এক অসামান্য সহজ-সরল-সতস্ফূর্ত ভালোবাসা-খুনসুটি-প্রেমরস। কবি দাম্পত্যের অমর বন্ধন উদযাপন করেন দারুণ সব বর্ণনার মাধ্যমে। ‘রঙ্গসার’ কবিতায় কবি বলছেন ‘বউতরণী পার হয়ে যাই— রক্ষে করো বাবা/ চৌষট্টি খোপের মধ্যে দাম্পত্যের দাবা/ একটুখানি মরিচ-হাসি, মাখন-আঙুল ছোঁয়া—/দিনগুলো সব প্যাকেটভর্তি জয়নগরের মোয়া/.../ রক্তকণায় আরাম— ত্বকে স্ত্রী-সোহাগী-ঘা—/ আমরা দু’জন, নই তো সুজন, অয়ন ও শুভ্রা’; ‘কল্পলোক’ কবিতায় কবি বলেন ‘একজন্মেও খুলবে না এই শক্ত গিঁটের বাঁধন/ যেদিকে চাও রূপতপস্যা মুগ্ধ মন্ত্র সাধন/.../ সংসার সরছে এখন কাজ কুড়োনো ছুটি—/ টক-নুন-ঝাল-তিক্ত-মিঠে কলহ খুনসুটি’/; ‘লীলাখেলা’ কবিতায় ‘বউ-পুতুলের পাশেই দাঁড়ায় সত্যি পুতুল বর/ খেলনা-বাটির গৃহস্থালি ভরন্ত সুন্দর/.../ গাছের মতন বাড়ছি আমরা অনায়াস অভ্যাসে/ পাতায় পাতায় দুলছি আমরা নিশ্বাসে-প্রশ্বাসে...’; মেঘ ও রোদ্দুরের মত দাম্পত্যের মান-অভিমান সুন্দরভাবে প্রকাশিত হয়েছে ‘নিবেদনমিদং’ কবিতায়— ‘আচমকা সব অভিমান-মেঘ, গোঁসাঘরের খিল—/ আকাশ আবার গড়িয়ে পড়লো রোদ্দুরে খিলখিল’; ‘প্রণয়-যজ্ঞ’ কবিতায় ‘রূপসাগরে ডুব দিয়েছি, অরূপরতন মুঠোয়.../ নাকছাবি-দুল, ঠোঁটে তিলফুল, দুরন্ত চুল লুটোয়...’; দাম্পত্যের রোজনামচা ফুটে উঠছে এই লাইনগুলিতে— ‘বেলা আটটার বাজারফর্দ, বিকেলবেলার দাবি।/ দুলছে গলায় সুতোয় বাঁধা কাঙালপনার তাবিজ/.../ দাম্পত্যও ঝঞ্ঝাপ্রবণ। মায়ার বাঁধন বাঁধা/ ঝগড়াঝাঁটি, কথাবন্ধ, সেই তো পায়ে সাধা/ শয্যা ঘিরে পৃথিবী ঘোরা। দু’জনই পর্যটক।/ দশক দিয়ে চাইছি ছুঁতে অসম্ভবের শতক’; ‘স্ত্রীয়ংবদা’ কবিতায় ‘প্রণয়পাশায় মুশকিলাসান, জিতে গেছি শেষ দানে/ গুপ্তধনের হেঁয়ালির মানে— বউ জানে। বউ জানে’/.../ বউকে নিয়ে রাত্রে কাব্যি, সকালে যাচ্ছি বাজার.../ রূপকথা শুরুঃ রানির দু’হাত দু’হাতে ধরল রাজা’; ‘গাছকৌটো’ কবিতার অসম্ভব সুন্দর কিছু লাইন— ‘বউ-বর মিলে চৌপর দিন খেলে দেখো ডাংগুলি.../ কখনো ছুটেছে পিছু পিছু জোরে, এ-যদি ‘চোর’, ও ‘পুলিশ’.../.../ আবারও ‘বদল’? ভোর আসতেই উলটপুরাণ ফের...!/ ঘুলঘুলি ফাঁকে চড়ুইপাখিরা বাসা বানিয়েছে ঢের...।/এ-বাসও পাখির/ আচমকা যদি ভাঙল হা-ঘরে বাতাসে!/ তবু তুলিটান ফুটিয়ে তুলেছে হবে না কারোর পাতা শেষ.../ ছবি আঁকে আর ছিঁড়ে ফেলে দেয় স্তুপ হয়ে জমে স্কেচবুক.../ সমস্ত দেহ সাদা ক্যানভাস, একাকার মাথা-পেট-বুক.../ রক্তমাংস দিয়ে গড়ে তোলা দুটো ‘পোট্রেট’ এখানে.../ রং-ব্যবহার, ব্রাশের আকার, যে জানে শুধুই সে জানে’। এইভাবে রাজা-রানি, তিলফুল, নাকছাবি, মোয়া, ব্রাশ প্রভৃতি অভূতপূর্ব সব উপমা কবি রোজকার সংসার, ইতিহাস, ভূগোল থেকে তুলে এনেছেন। একটি ভীষণ সুন্দর মিষ্টি প্রেমের কবিতা ‘আবদারগাথা’য় কবি তাঁদের দাম্পত্য-প্রেমের মূল চালিকা শক্তি ‘আবদার’কে বোঝাতে গিয়ে তাঁর সহধর্মিনী শুভ্রাকে শুভ্রাদিদি, শুভ্রা মা, শুভ্রা মাসি, শুভ্রা বুড়ি, শুভ্রা সোনা, শুভ্রা রানি, শুভ্রা প্রিয়া, শুভ্রা ডিয়ার, শুভ্রা পত্নী, গিন্নি শুভ্রা, শুভ্রা বধূ প্রভৃতি রূপে অনবদ্য দক্ষতায় কল্পনা করেছেন যা আসলে কবির জীবনে তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায়।

একটি অত্যন্ত লক্ষনীয় বিষয় হল এই কাব্যগ্রন্থটির রচনাকাল ফেব্রুয়ারি ২০১৫ থেকে জুলাই ২০১৫ অব্দি;  কবি তাঁর বিবাহ-পরবর্তী নব উপলব্ধ প্রেমরসে ডুবিয়েছেন তাঁর কলম। আর সেই কারণে এই কাব্যগ্রন্থটির ভিতরে আছে এক দুর্ধর্ষ জীবনীশক্তি, অবিশ্বাস্য প্রাঞ্জলতা, এবং সতস্ফূর্ত প্রাণবন্ততা। আর তাই স্বাভাবিকভাবে কবির বর্ণনায় এসেছে অপূর্ব দেহ-উদযাপনের চিত্রকল্প। ‘কল্পলোক’ কবিতায় ‘রোমাঞ্চ আর হর্ষ মিলেছে ইভ-আদম/ গায়ে হাজার ট্যাটুর ছ্যাঁকা অজস্র অর্গ্যাজম’; ‘পরিব্রাজক’ কবিতায় ‘নাভির ভেতর চোরাবালি, তলায় গোপনটান—/ ডুবতে ডুবতে হাত-পা ছোড়ার অনন্ত আহ্বান/ পাতাল ফুঁড়ে দাঁড়ায় উঠে দীর্ঘদেহী শ্রমিক/ সামনে জেগে সভ্যতা তার— ইট-পাথরের জমিন.../ খননকার্য শেষ হবে না; নিত্য আবিষ্কারক/ টুকরো করে ছড়িয়ে দিলাম একের পর এক বারণ’; ‘ফুলশয্যা’ কবিতায় ‘পাগলা-পাগলি রেখেছে আগলে, শরীর চাইছে শরীর’; ‘তৃতীয় নয়ন’ কবিতায় ‘স্নানাধার খোলাঃ ভিজছে... ওমা! ও’ সত্যিকারের পরি?/ চুল দুজনে, চুপ গোপনে, একহয়ে স্নান করি...’; ‘পঞ্চশর’ কবিতায় ;কনে-পাওয়া আলো, না জেনে রাঙালো, ‘রেনবো’ ঢুকল ভিতরে.../ তির দুই স্তন, এইদেহমন গাঁথল এমন, কী করে!...’; ‘যদিদং হৃদয়ং’ কবিতায় ‘এত অসহ্য এই কম্পন, অতি অপূর্ব কাঁপা...!/ প্রতি রোমকূপে তুফান তুঙ্গে ভিতর-বাইরে লাফায়...’। ‘চর্যাপদ’ ও ‘বৈষ্ণবপদাবলী’র মত এই কাব্যগ্রন্থেও বারবার ঘুরেফিরে আসে দেহরস।

দেহ-উদযাপনের মধ্যে দিয়েই কবি পৌঁছান দেহাতীত এক স্বৈর্গিক আনন্দ-অনুভব-পবিত্রতা-আরাধনায়। বউ এবং দাম্পত্য নিয়ে কবির সৎ উচ্চারণ— ‘ “শ” আর “ভ”য়েই মন্ত্র তন্ত্র, শুভ্রা শুভ্র জপ.../ শুভ্র নিয়েই আমোদ আমার বেঁধেছে মন্ডপ’; ‘প্রেরণাপুরান’ কবিতায় ‘তাহলে সতীর বাহান্ন পীঠ। শেষ্ অঙ্গ তুমি/ হন্যে হয়েই ফেলেছি চষে পাহাড়, বনভূমি’; ‘গন্ধর্ব বচন’ কবিতায় ‘জোট বেঁধেছি সবার সঙ্গে আমরা মরমিয়া/ ভ্রমণ কাটুক এমনভাবেই দৈব-দরদিয়া’ কিংবা ‘বর্ষামঙ্গল’ কবিতায় প্রেমের এই উত্তরণটি সুস্পষ্টরূপে লক্ষ করা যায়— ‘নামো মেঘদূত, এবারে বধূর মিলনের লাগি লগ্ন...!/ ছন্দে ছন্দে যুগলবন্দি, সন্ধে হয়েছে নগ্ন...!/.../ ১ লা নয়তো, দোকলা এখন, শোকলাগা লেখা ছিঁড়ছে...!/এ-ভরা বাদরে, মন্দির খোলা, শ্যাম ও রাধায় ফিরছে...!/.../ এই মেঘদূত, সন্ধির সুত, শঙ্খ-লাগার সাক্ষী...!/দুইখানি মন, জুড়েছে এমন, অন্তহীন এ রাত্রি...!/.../  এমন দিনেই তারে বলা যায়...! কবেই বলেছ সেইসব...!/ বৃষ্টিশব্দে ছড়িয়ে পড়ছে যুগযুগান্তে এই স্তব...!/ .../মন-ভাল-করা অঝোর আকাশ...তলায় অয়ন-শুভ্রা...!/ চিরকাল থাক দোকলা আষাঢ়... হোক অন্নত সুখরাত...!’ এইভাবে প্রেম ও দাম্পত্যের উত্তরণ ঘটে শরীর থেকে শরীরাতীত, বৃষ্টি থেকে বৃষ্টি-অতীত এক অপার্থিব এক মায়াজগতে যেখানে এক ‘মন-ভাল-করা অঝোর আকাশ’ এর তলায় বিশ্রাম নেন দুই চিরকালীন প্রেমিক প্রেমিকা অয় ও শুভ্রা।

কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতা মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্তে লেখা। ‘আবদারগাথা’ কবিতাটিতে আছে বর্ণানুক্রমিক অন্তমিল। ‘লিভ আপ্লিকেশন’ এর মত কয়েকটি কবিতা লেখা হয়েছে মন্দাক্রান্তা ছন্দে। কিন্তু যেটা একান্ত লক্ষনীয় তা হল এই কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতাই (প্রায় সমস্ত কবিতা, চার পাঁচটি বাদে) দ্বিপদী। এটি কবি অত্যন্ত সচেতনভাবে করেছেন বলে আমার মনে হয়। দ্বিপদীতে যেমন দুই লাইন পরপর বা পাশাপাশি থাকে, এখানেও দুজন চিরপ্রেমিকের আজীবন পাশাপাশি হাঁটা/ থাকার বিষয়টি সূচিত করা হয়েছে। আর পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতেই কবি মেলে ধরেন প্রেম-দাম্পত্যের শ্বাশত খুনসুটি, কলহ, দ্বন্দ্ব, ঝগড়া, বিশ্বাস, বন্ধন, বন্ধুতা নির্ভরতা, ও এক নতুন প্রানবন্ত ভালোবাসা। শুধু ভালোবাসা নয় আমাদের চোখের সামনে যেন দুজনের প্রাণ-ঝরঝর চরিত্রটি পরিস্ফুট হয়ে ওঠে, আমরা উপভোগ করতে থাকি দুই দম্পতির প্রেমের উল্লাস, চিৎকার, শীতকার, আনন্দ, প্রেমের অভূতপূর্ব বারোমাস্যা, যাত্রপালাগান, ‘বছরভোর’ এর ‘ফাগুন দোল’, যেন আমরা অনাহুত অবস্থায় ঢুকে পড়েছি স্বর্গে আদম-আর ইভের প্রেমের বাগানে যেখানে অয়ন ও শুভ্রা নামের দুই হরিন-হরিণী বাস্তব-জগতের অনুভূতি রোহিত হয়ে নিজস্ব আনন্দে হেসে খেলে বেড়ায়। আমরা পুড়তে থাকি তাঁদের প্রেমরস ও হৃদয়রসে আর যেন, ‘দেয়ালে দেয়ালে হৃদয়-চিহ্ন ছেয়ে গেছে সব পাড়া’ (‘সিদুরলেখা’)। এইভাবে ‘কান্না-হাসির, মুরগি-খাসির আশ্চর্য পাকশালা’য় ‘বউ আর বর, সম্বৎসর বিলাপ-আলাপ ঝালায়’ (‘কূটগীতি’)।

কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতার ভিতরে একটি সুপ্ত কথোপকথনের চলন আছে। শুধু একে অপরের সঙ্গে নয়, এই কথকতা কবি ও কবিপত্নী পাঠকের সঙ্গেও যেন চালিয়ে যেতে চান। নিজেদের অপরূপ প্রেম-মাহাত্ম্য বর্ণনার শেষে তাই কবি বলেন ‘ধারা-বিবরণ, পড়ে অগণন, শুভ্রা-অয়ন চলি.../ জলের ফোঁটায় লেখা হয়ে থাক এই বউপদাবলী’ (‘নির্বন্ধ’)। বাংলা সাহিত্যে পুরো একটা কাব্যগ্রন্থ নিজের বউ নিয়ে লেখা হয়েছে কিনা জানা নেই। তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায় বাংলা প্রেমের কবিতার ইতিহাসে এই কাব্যগ্রন্থটি জলের ফোঁটায় লেখা থাকবে।



সেলিম মল্লিকের “প্রতিপদ কৌমুদী”: ‘রৌদ্রে রোদনের রেখা’



একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে যে সমস্ত উল্লেখযোগ্য কবি লেখালিখি শুরু করেন তাদের মধ্যে অন্যতম সেমিল মল্লিক। “প্রতিপদ কৌমুদী” কবির তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ। ২০১৩ সালে ছোঁয়া প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়। কবিতার পরতে পরতে কবি ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর ছোটবেলা, গ্রাম্যজীবন ও জন্মভিটা। প্রকৃতি, প্রকৃতির শান্ত মুখশ্রী এবং কবির স্মৃতি এই কাব্যগ্রন্থের উপজীব্য। স্মৃতির নানান অনুষঙ্গ কবির কাছে তাঁর একান্ত নিজস্ব আয়নার মত; তিনি প্রতিবার স্মৃতির আয়নায় মুখ দেখেন আর খুঁজে ফেরেন তাঁর শৈশব, কুসুমগ্রাম, নয়ানজুলি, তাঁর মা, মানসী ও সর্বোপরী তাঁর মায়াকে। এত বিশ্বস্ত এত গভীর তাঁর চিত্রায়ণ, এত ব্যপ্ত তাঁর চিত্রকল্প যে কবির কলমের পাশে পাশে আমাদের চুপচাপ ঘুরতে হয়, যেন কোন শব্দে এখুনি ভেঙ্গে যেতে পারে সব নিস্তব্ধতা।
কাব্যগ্রন্থের শুরুর প্রবেশক লাইনগুলিতে কবি লিখছেন ‘ধুলো-পড়া মলাটের ভেতর, পুরোনো বইয়ের/ হলুদ পৃষ্ঠাতে, বুনো ফলের পাকা-গন্ধের মত তোমার নামঃ/তুমি জেগে আছ নিঃসঙ্গিনী, পুত্তিকা খেয়েছে চারপাশ।’ কাব্যগ্রন্থের একাধিক কবিতায় চলতে থাকে এই ‘তুমি’ অন্বেষণ। ‘সোঁদাল গাছ’ কবিতায় ‘দাঁড়িয়ে আছি সোঁদাল গাছের তলায়, তোমার কথা/ ভাবতে গিয়ে বিমনা হয়ে রাখালবালকের মতো বাজিয়ে ফেলেছি সোঁদাল পাতার বাঁশি/ .../ তোমার কালো শরীর দিয়ে ঢেকে দেবে ডুবতে-না-চাওয়া তারাদের?’; ‘নয়নতারা’ কবিতার অসামান্য বর্ণনায়— ‘কীভাবে বলি তোমায় কেমন লাগছে! বিভূতিভূষণ হলে/ হয়তো বলতেনঃ সন্ধ্যা নামার সময়/ বনের মাথায় গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে ভেসে থাকা হালকা নীল রঙের বুনো তেউড়ির ফুল/.../ তোমাকে দেখাচ্ছে আমার মায়ের মুখে শোনা তার ছোটোবেলাকার জীবনের মতোঃ/ ময়লা ফ্রক-পরা এক কিশোরী মেয়ে, উনুনে জ্বাল দিয়ে/ মাটির খোলাতে ভাজছে শালুকবীজের খই.../; ‘কাক’ কবিতায় যেন পদ্ম পাতার জলে তোমার উদয় হল, ভোরের অশ্রুর মতো/ প্রথম আভার স্বরে বলছঃ একা ফেলে এভাবে চলে যেয়ো না/; ‘কী’ কবিতায় ‘অর্ধেক অং না অর্ধেক জীবন— তুমি আমার কী যে!/ এই জিজ্ঞাসার উপর মাথা রেখে চিত হয়ে শুয়ে আছি, ভূমিকার মতো/... / ...ঘরের দলিজে/ কালো পোশাকে গান গাইছে ফকির, অন্ধ ভোমরা/ সারা অন্ধকারে কাদঁছেঃ তুমি কোথায় তুমি কোথায়!/ পদ্ম জ্বলছে মনি জ্বলছে আশমান জ্বলছেঃ/ সাদা আগুন লাল আগুন নীল আগুন/ তোমায় খুঁজছে জ্বলতে জ্বলতে— তুমি কেমন!’; কিংবা ‘আলেক’ কবিতায় – ‘কে ডাকে? একটু একটু করে/ মরে নিঃশেষ হয়ে গেল জোনাকি-আলোর রাত।/ তুমি কে গো? কোন শুকনো কোটর হতে ডাক—/ হৃৎপিন্ডের কুঠি চোখের ঘর/ কেমনে বিজন আর অবাত হল তোমার!/.../ বড়ো অদিনে ডাকলে, বেরঙের ভিতরে/ তোমার মূর্তি দিশা থির পায় না, আত্মা উলটে/ ঝোলে যেন বাদুড়ের শব্দ, কেমন চঞ্চলা/ মনীষা আজ/.../ আলেক মনের নিশিরঃ একা ভাসে ন্যাবারুগুন চাঁডের সোদর।’ কে এই তুমি?কে এই মানসী? কে এই মায়া? রবীন্দ্রনাথের কথা মনে পড়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ প্রচুর কবিতায় ও গানে ব্যবহার করেছেন ‘কে’ কিংবা ‘কে বলে গো’ জাতীয় শব্দের ব্যবহার। কবির অবিরাম এই ‘কে’ অন্বেষণের মধ্যে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গিয়েছে জন্মভিটা, জননী, কুসুমগ্রাম, রান্নাঘর, উনুন, দুপুরিয়া গান ও ‘সিঁদুরে লেপা লাঙ্গলের কাঠ’।
কবির কবিতার অসম্ভব সুন্দর বৈশিষ্ট্য হল তাঁর চিত্রকল্পের প্রয়োগ। তাঁর চিত্রকল্প তাঁর কল্পনার কুসুমগ্রামের মাটির ঘরবাড়ী, পুকুর, গোরুগাড়ি, ভীরু কাঠবেড়ালি, লেবু পাতার গন্ধ,নিজঝুম কন্দ, পদ্ম পাতার জল, সোনালি রঙের মেঘ, অন্ধকার ডুমুর গাছ, জলের মাদুরে পদ্মলতা, হলুদ বাটা জল, নকশা আঁকা কলসীর গা, তিলফুল, সোঁদালগাছ, কুমড়ো ফুল, মাটির গন্ধ থেকে উঠে এসেছে। কয়েকটি এমন শব্দের ব্যবহার আছে এই কবিতায়, যা আমাদের অনায়াসে ফিরিয়ে দেবে আমাদের ছোটবেলা, গ্রাম, ইস্কুলবাড়ি, ঠাকুমার কাছে; যেমন ‘টঙ’, ‘ষাঁড়া’ ‘নিদুটি’ ‘তালের ডোঙা’, ‘দুপুরিয়া গান’, ‘দুপাখা উনান’, ‘পিঁড়া’, ‘পুআ’, ‘পুন্নমি’ রাত, ‘গাহন’, ‘ন্যাড়ামুড়া’ ‘দলিজ’, ‘পুইমাচাভরা মিচুড়ি’ ইত্যাদি। অন্য আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হল কবিতার শান্তরস কিংবা বলা যেতে পারে নিমগ্নতা। সমগ্র কাব্যগ্রন্থটির মর্ম দিয়ে কুলকুল করে বয়ে যায় শান্ত নদীর জল যা শুধু ভাষা নয়, শব্দ নয়, যাকে বোঝার জন্য কান, ত্বক, ভিতরের চোখ লাগে— যেমন ‘জাতক’ কবিতায় ‘হস্থীযূথের পায়ে পায়ে অকালের এই বনগমন,/ স্বপ্নে যেন স্বর্ণবৃষ্টিতে ভেজে মিলন আমাদের—/ জলের ঘায়ে খসে পড়ে ফুলের বিরহ’/.../ ‘গাছের তলায় ছায়ায় বিলীন হয়ে/ আয়ু কখন ঘুমিয়ে পড়ে শরীর পেতেঃ/ বাতাস বইছে নিত্যদিনের—/ দেহের ভিতর জেগে উঠছে দেহ; ‘কাঠগোলাপ’ কবিতায় ‘... শান্ত নিথর/ দিনের বেলাও চাঁদ উঠে আছে/ যেমন গোল পাত্রে হলুদ-বাটা-হাত-ধোয়া জল’; ‘আহ্লাদ’ কবিতায় ‘...দাও তোমার/ পায়ের পাতা, আলতা পরাই— রক্তের মত মর্মের রং ফুটে উঠছে অন্ধকার; ‘রূপকথা’ কবিতায় ‘আশ্বিনের অল্প হিমে তোমার বুকের তলায় ঘুম—/ বিহঙ্গমা এক রূপকথা বলে পালকে ঢেকে দিল,/ চন্দনের ঘ্রাণ তোমার গায়ে, সিঁদুরের গন্ধে/ কপালের ফোঁটা ফোঁটা ঘাম স্বপ্নে জাগাল, ঘন চুমোয়/ যেন গো দুধের শিশুকে নিদুটি দিলে তুমি’
একজন সার্থক কবিকে শব্দের ভিতরে যে মায়া, শব্দের সঙ্গে শব্দের যে নিভৃত খেলা সেটি কবিতা লেখার সময় আবিষ্কার করতে হয় প্রতিমূহুর্তে। কবি সেলিম মল্লিক তাঁর বহু কবিতায় সেই অনন্ত উপলব্ধিটি স্পর্শ করে ফেলেন বারংবার। তাঁর কবিতায় জীবন রহস্য, জন্ম মৃত্যু, পূর্ব জন্ম বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে— ‘হেন দেশ ছেড়ে’ কবিতায় ‘পোকা-পূকী গুঞ্জই ঘুরে-ফিরে, পুন্নমি রাত/ চাতালে বসল এসে পিঁড়া পেতে, কথা কইছে সকলে/ হাঁপ-টানা বুকে হাওয়া দেয় তুলসী গাছ— ফের জন্মিয়ো—/ হলহলিয়ে বাড়ে যেন আশু ধানের পুআ’; ‘...আ লেবু পাতার গন্ধ/ কে যে নাকের রন্ধ্রে ধরল! রঞ্জাবতী নিশ্বাস ফেলছে কাঁচা সবুজ ফুসফুসের কোঠা খুলে, রক্তের ভিতরে/ টের পাচ্ছি মৃত্যুর আগে ও পরে সবকিছু’ (রঞ্জাবতী); ‘জনম’ কবিতায় ‘... মৃত্যুর সময়/ কামিনীর মাতাল-করা গন্ধ নাকে এসে লাগছে,/ শরীরে বল নেই— নইলে এমন ভোরে গাছতলায় গিয়ে/ বিছানা পেতে নিতাম, বনের সেখানে/ ঘরের দুয়ারদরজা খোলা, তুমি আসবে/ আর সটান ঢুকে পড়বে আমার ঘুমের মধ্যে। পরের জন্মে/ একসঙ্গে দুইজনাতে জাগব তখন’; ‘বসন্তের দূত’ কবিতায় ‘... জলের তলায় দেখা যাবে যৌবন/ ভরতে এসেছে কালো শূন্য কলস/ কলসি বাজিয়ে রং খেলবার গান গাইছিঃ/ এসো না এসো— মরি কি বাঁচি কি আবার জন্মাই’। কবির কবিতায় বারবার সাবলীলভাবে ঘুরেফিরে এসেছে ভক্তিরস, বৈষ্ণবীয় ভাবধারা, রাধা ও চৈতন্যের অপরূপ অনুষঙ্গ ‘মেঘঘন জল’, ‘পুতলি’, ‘নিমফুল’, ‘শান্তিপুর’, ‘কাব্যলতিকা’ এবং ‘পয়ার’ কবিতায় 
‘আপনি কী পুনর্জন্মে বিশ্বাস করেন?’ এই প্রশ্নের উত্তরে কবি জানালেন— ‘ঠিক পুনর্জন্ম নয়, আমি পুনরাবর্তনে বিশ্বাসী’। আর সেই কারণেই ছত্রে ছত্রে কবি মিশিয়ে দেন জন্মভূমি, ভিটামাটি, পূর্ববর্তী জন্ম; মৃত্যু পরবর্তী কথোপকথন চলতে থাকে অবিরামকান পাতলেই শোনা যায় ‘বিদেহী শব্দ আজ ঘুরতে এসেছে বাঙালি ঘরের উঠানে’ (কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘ওই যে লতাটি’)। কাব্যগ্রন্থের শেষকবিতা ‘বিদেহী’র অবিস্মরনীয় পঙতি— ‘পুথির পাটার বুক-ভরা লতার ফাঁক দিয়ে চন্দ্রাবলী/ নকশা এঁকেছে বিদেহী কবির গোরের মাটিতে, মাঘের নিশীথে/এখন শোনা যাবে শেষ-প্রহরের গাহন, ধুয়া ধরতে/ কোকিল এসেছে— সঙ্গে এসেছে দক্ষিনের বাতাস।/ এসবের আরও ক-দিন বাদে মধু ও মাধব এল,/ বর্ষ শুরু হল আবার একটি আমার জীবনপঞ্জীতে,/ পঞ্জিকার ভিতর আবারও উড়ে যেতে দেখলাম পরি...’। কবির এইসব দৈন্যন্দিন জীবনপঞ্জীর মধ্যে মিশে থাকে চিরন্তন ও শাশ্বত উপলব্ধি। কবি ‘মাটি’ কবিতায় বলছেন—‘তোমাকে যদি কিছু বলতেই হয়/ তবে বলিঃ “বিচ্ছেদে বিচ্ছেদে জীর্ণ হয়ে/ মাটির মধ্যে মিশে যাই এসো।” মাটির ভিতর দিয়ে আবার প্রত্যাবর্তন ঘটল— এবারও/ আমাদের মাটির রং হল, গায়ের গন্ধ হল মাটির গন্ধের মত’। আমাদের মনে পড়ে পড়ে যায় কবর দেওয়ার সময় ইসলাম ধর্মের সেই তিনটি পবিত্র বানীর কথা। মাটি দেয়ার সময় সমবেতভাবে আরবী যে বাণী উচ্চারণ করা হয় তার সারমর্ম হলোঃ "এই মাটি থেকে তোমার সৃষ্টি, এই মাটিতেই তোমার প্রত্যাবর্তন এবং এই মাটি থেকেই তোমার পুনরুত্থান"এইভাবে হিন্দু ও মুসলিম ধর্মের মূল শান্তরস ও ভক্তিরসে জারিত হয়ে কাব্যগ্রন্থের বহু লাইন ‘রৌদ্রে রোদনের রেখা’ হয়ে ফুটে থাকে আমাদের মনে। সমসাময়িক হিংসা, সাম্প্রদায়িকতা, ও হানাহানির প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে কবি সেলিম মল্লিকের কবিতা সবার অবশ্যপাঠ্য, যা আমাদের অনন্ত শান্তি, আমাদের ফেলে আসা জন্মভূমি, ধর্মীয় সম্প্রীতি ও মাটির কাছাকাছি পৌঁছে দিতে পারে।

 কৃষ্ণ মন্ডলের “আস্তাবল কিংবা সমুদ্রের খোঁজে”: ভুড়রুপাকার গন্ধ



কবি কৃষ্ণ মন্ডলের লেখালেখি শুরু শূন্য দশকের শেষদিকে। কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘আস্তাবল কিংবা সমুদ্রের খোঁজে’ প্রকাশিত হয় ‘নাটমন্দির’ থেকে ২০১৬ সালে। এই কাব্যগ্রন্থে কবি অভূতপূর্ব দক্ষতায় এবং সৎভাবে চিত্রিত করেছেন তার জন্মভূমি, শৈশব ও নিজস্ব জীবনযাপন। সেলিম মল্লিকের ‘প্রতিপদ কৌমুদী’র মতই তাঁর কবিতায় বারংবার ঘুরেফিরে আসে তাঁর ফেলে আসা গ্রাম, জন্মভিটা ও স্বপ্নের মত সাজানো দেশবাড়ি। কবি তাঁর কাব্যগ্রন্থে খুঁজতে চেয়েছেন ‘পাখির-ডিম-ভেঙে-যাওয়া বাসার খড়কুটো/ জ্ঞানের রং ঢেকে দেওয়া/ অল্পসল্প কুয়াশা, তুষার বৃষ্টি...’ (প্রবেশক কবিতা)। ‘পাখির-ডিম-ভেঙে-যাওয়া’ শব্দবন্ধটি লক্ষণীয়; পাখি ও ডিম এই দুটি বিশেষ্যপদ এবং ভাঙা ও যাওয়া এই দুটি ক্রিয়াপদের মাঝে হাইফেনটি খুব গুরুত্বপূর্ন। কবির কাছে তাঁর ফেলে আসা ‘পাখির-ডিম-ভেঙে-যাওয়া বাসার খড়কুটো’ কুড়নোর দিন যেন কোন বিচ্ছিন্ন বা হারিয়ে ফেলা দিন নয়; তা যেন কবির বর্তমান জীবনের সঙ্গে প্রবহমান এবং ওতপ্রোতভাবে সমপৃক্ত; কবি তাঁর চেতনায়, অবচেতনায়, ঘুমে, অবিরল জীবনরহস্য সন্ধানে সেই ফেলে-আসা-ভেঙে-যাওয়া খড়কুটো নিজের সঙ্গে প্রতিনিয়ত বয়ে নিয়ে চলেন। কবি তাই জ্ঞান নয় বরং চেয়েছেন জ্ঞানের রং ঢেকে দেওয়া ‘অল্পসল্প কুয়াশা, তুষার বৃষ্টি...’। জ্ঞান ব্লেকিয়ান ব্যাখ্যায় হল ‘Experience’ (Songs of Experience);  কবি বরং আত্মুঅনুসন্ধানের শুরুতেই ঝুঁকতে চেয়েছেন Innocence এর দিকে, অর্থাৎ তার শৈশব, সরলতার দিকে।
শৈশব হারানোর প্রথম চিহ্ন হল যন্ত্রণা এবং কান্না। কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘সরলরেখা’য় কবি তাঁর শৈশবরেখার সরলতা খুঁজতে গিয়ে কান্না নিয়ে ফেরেন। শুরুতেই যেন কবির উপলব্ধি ‘নীরব কান্নাই বাঁচার খোরাক/ তাই পর্দার ফুলকে কাদাঁই ভেতরে/ হৃদয় থেকে কানে আনি তার ফোঁপানির শব্দ’। দ্বিতীয় কবিতা ‘হা!’ তে আবারও কান্নার শব্দ— ‘পিঠের তলায় দিয়ে গেছে সাদা থান। থানের উপরে তার কান্না। হাত ছোড়া পা ছোড়া হিসি আর উপর থেকে টুকটুকে লাল বটফলের ঝরে পড়া! হা! বেওয়ারিশ শিশু, তোমার জন্মই কবিতা!; ‘তারা খসার আগে ও পরে’ কবিতায় ‘জলের নীরবতার উপর স্ট্রিট-ল্যাম্পের খ্যানখ্যানে গলাকে মনে হয় আলো/ মাইকের ভেতর দিয়ে আসা শব্দকে মনে হয় সাদাবাতাস/ শিরীষফুলকে— মৃত সব হাঁসেদের অশ্রু/ দু-একদিন শব্দের ভেতর থেকে/ বেরিয়ে আসে তুলোর কান্না/ শিমুলবীজের খয়েরি পেচ্ছাব...’; ‘ব্যবধান’ কবিতায় ‘এমন গভীর রাতে বালতির জলে ফুঁ দিয়ে/ আমি জলের যন্ত্রণাকে দেখি/.../ চোখে এত জল নিয়ে কেন উঠলে পাহাড়ে/ আজ যদি পাহাড় গলে যায়/ যদি দুঃখের কাছে হেরে যাও তুমি’; ‘হারিয়ে যাওয়া বাতাস’ কবিতায় ‘যেভাবে কাঁদলে পাথরের মতো বুক নড়ে ওঠে/ সেভাবেই কাঁদে আজ, কেঁদে মুগ্ধ কর চারপাশ’। এইভাবে কাব্যগ্রন্থের বিভিন্ন কবিতায় ঘুরেফিরে আসে কান্না ও যন্ত্রণার অনুষঙ্গ, আর ‘আস্তাবল কিংবা সমুদ্রের খোঁজে’ ক্রমশ এগিয়ে যায় ‘Songs of Innocence’   থেকে ‘Songs of Experience’ এর দিকে।

শুধু শৈশব হারিয়ে ফেলাই নয়, কবির মৃত্যু-চেতনাও এই যন্ত্রণার অন্যতম কারণ। বড় হয়ে ওঠার সময় কবি দেখেছেন একাধিক মৃত্যু। তাই মৃত্যুর কথা বারবার ঘুরেফিরে আসে তাঁর কবিতায়রাতের আকাশ’ কবিতায় ‘বিশাল আয়নার মতো একটি তারা/ খুঁটিয়ে মুখ দেখছি আমি/ দেখিছি আমার ঠিক পেছনেই ছোটোকাকার পেছনে ঠাকুরদা/ তার পেছনে বাবা/ যেন পুরো একটা বংশ/ লাইন দিয়ে টিকিট কাটছি/ হাওয়ার গাড়ির/ আর দূরে হর্ন বাজাচ্ছে মৃত্যু’; ‘আত্মহত্যার আঠারো বছর’ কবিতায় কবি তাঁর পরিবারের অত্যন্ত প্রিয় এক মানুষের মৃত্যুর কথা তুলে আনেন— ‘যেন সে মরেনি।/ যেন একান্তে আরও একটি চিঠি লিখবে বলে পাশের রুমে চলে গেছে সে/.../ আমি তার মুখাগ্নি করিনি/ হাতঘড়িটি পুড়িয়ে দিয়েছি আড়ালে/ .../ আজও রাত্রিবেলা ঘড়ির দিকে তাকাতে ভয় করে/ যদি আবার আগুন/ তার সেই আধ-খাওয়া মুখ নিয়ে ফিরে আসে’; ‘শূন্যের শূন্য’ কবিতায় ‘চাইনিজ ব্যাম্বো ফ্লুটের ভেতর দিয়ে/ মৃতদেহটি মাথায় করে/ বয়ে আনছে ফ্লুটবাদক; ‘নাচ’ কবিতায় জীবনের অপার শূন্যতা ও অসহায়তা চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে এই লাইনগুলিতে ‘গ্রামের মাথায় নতুন কীটনাশকের হোর্ডিং/ হোর্ডিংয়ে বৈদ্যুতিক আলো/ মৃত্যুর কাছে চলে এসে/ পোকাদের নাচানাচি’ কিংবা ‘চামুন্ডায় নমঃ’ কবিতায় ‘একদিন সব মন্ত্র/ চলে যাবে টেবিলের তলায়/ মৃত্যু এসে বসবে চেয়ারে/ পা নাচাবে রাতদিন’। এইভাবে মৃত্যুর প্রতি এক সহজ ও উদাসীন ভঙ্গি পোষণ করেন কবি, এবং সেই মৃত্যু-চেতনাকে নিজস্ব যাপনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জড়িয়ে নেন। আর সেই উপলব্ধি থেকে কবি উন্নীত হন সেই গূঢ় দার্শনিক সত্যে যখন তিনি উচ্চারণ করেন ‘এই পারে মানুষের বেড়াতে আসার মিছিমিছি খেলা’ (‘আস্তাবল কিংবা সমুদ্রের খোঁজে’)
কবির এই জীবন-অন্বেষণে তাঁর জন্মভূমির সঙ্গে বারবার উঠে আসে তাঁর ঠাকুমা, ঠাকুরদা (প্রসঙ্গতঃ উলেখ্য, বইটি উৎসর্গ করাও হয়েছে তাঁর ঠাকুরদাকে), বাবা-মা, টিউশনি মাস্টার, মেজমামা, কীর্তন, গান, কবি-মানসী সুনন্দা, মহুলের দেশ, ‘কোদালের ঠনঠন শব্দ’, বুধু মান্ডি এবং আরো  অনেকে। একটি অসামান্য কবিতা ‘পাহাড়’ এ কবি বলছেন ‘সামনে কাপড় খুলে বসে আছে ভাষা।। ভাষার শরীরে জ্যোৎস্না। খিদে বহু জন্মের। ছেনিবাটালিড় খুটখুট শব্দে ধুলো হয়ে যাচ্ছে কালো পাথরের অংশ। এই লোকটা, এই মানুষটা কেটে চলেছে পাথর, শুশুনিয়া পাহাড়ের নীচে। এতদিন তোমাকে চিনতে পারিনি বাবা!’; ‘খয়েরের দাগ’ কবিতায় কবি খুঁজছেন তাঁর ঠাকুরদাকে— ‘ঠাকুমার টিনের বাক্সে আমাদের বাস্তুভিটার দলিল/ তার তলায় ঠাকুমার ধুতি/ খয়েরের দাগ/ পনেরো বছর আগের দাগ নিয়ে খুঁজতে বেরোলাম/.../ আমি খেই হারিয়ে ফেললাম/ কোন দিকে ঠাকুরদার পথ?’; আর ‘ঠাকুমার কবিতা’য় ঠাকুমার ভাষ্যে ও কবির স্মৃতিচারনায় সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে কবির পূর্বসূরীর যাপনচিত্র— ‘তোর দাদুরা তখন গান গাইতে যেত/ রাতের পর বাড়ি ফিরত না/ সেই গানের দলে তোর দাদু সাজত রাধা/ কার না কার হাত ধরে নাচত/ রাতের পর/ এদিকে আমি একগন্ডা ছেলেপুলা্ন নিয়ে/ চাল মাগছি গুড় মাগছি এর তার ঘরে/ এক রাতে সন্নাসী দেখা দিলেন/.../ সন্নাসীর দীর্ঘ পায়ের ছায়ায়/ অন্ধকারে হারিয়ে গেল আমার একগন্ডা ছেলেপুলান/.../ যেন তোর দাদু হাঁপাতে হাঁপাতে/ ছুটতে ছুটতে ফিরে এসে আমাকে/ জিজ্ঞেস করছে—/ ছা-গুলান কোথায় বল মাগি ছা-গুলান কোথায়/ সাক্ষাৎ রাধার ওই রূপ ভোলা যায়!’ কবির ঠাকুরদা যাত্রা গান করেন, আর রাতের পর রাত ঠাকুমা ছেলে পুলে নিয়ে জেগে বসে থাকেন এই দৃশ্যকল্প যেন চোখের সামনে দেখতে পাওয়া যায়। ঠাকুমা সেই গল্প বলছেন কবিকে আর কবি বলছেন আমামদেরকে— এই আবহমান কথকতাকে জুড়ে দেয় যাত্রাপালাগান। আর সেই কারণে  কবির নানান কবিতায় উঠে এসেছে যাত্রার অনুষঙ্গ, যেমন ‘গ্রিনরুম’, ‘যাত্রার মুখ’ প্রভৃতি কবিতায়।
গ্রাম্যজীবনের স্মৃতি-যন্ত্রণা-বেদনা অত্যন্ত সুচারুভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ‘হ্যারিকেন’, ‘আসর’, ‘নাচ’, ‘মে দিবসে তোমাদের’ প্রভৃতি কবিতায়। গ্রামীন ও নাগরিক জীবনের দ্বন্দ্ব অপরূপভাবে ফুটে উঠেছে ‘আদিবাসী’ কবিতায়— ‘বুধু মান্ডির মতো/ মাঝজঙ্গলে দাঁড়িয়ে জিরোচ্ছে শালগাছ/.../ বুধুর বউ মহুল তার সবুজ কাপড়ে/ মুছে দিচ্ছে গায়ে লেগে-থাকা/ শহরের ধোঁয়া ও ধকল।/.../ গাছ-জীবনের ভিতর দিয়ে মাটিতে যায় উন্নয়নশীল বাতাস/ নড়ে ওঠে বুধুর আদিবাসী শিকড়/ দূরে, অনেক দূরে গড়ে ওঠে/ যুদ্ধজাহাজ এবং বন্দর’। একটি অনবদ্য কবিতা ‘কোথায় কীভাবে কেন’ যেখানে আমাদের কবি ফিরিয়ে দেন প্রায় এক দশক আগে ঘটা জঙ্গলমহলের সেই মর্মন্তুদ স্মৃতিতে; কবি বলছেন— ‘মহুলের দেশ বলে কিছু নেই আর/ শুধু যৌথবাহিনির বুটের দাগ পড়ে আছে/ নীলমাছিরাও আজ কর্মহীন/.../ বুধু মান্ডি তীর-বর্ষা ফেলে ব্রয়লার মুরগি কিনে/ঘরে ফিরছে বিকেলবেলা/ শিকার পোড়ানোর গন্ধ নেই/ নেই হৈ চৈ সন্ধে/.../ গাছেরা ফুঁপিয়ে কাঁদছে অন্ধকারে/ যেন অনেক সস্তায় সবুজ/ বিকিয়ে গেছে...’। আদর্শ আর যৌথবাহিনীর যাঁতাকলে এইভাবে বিকিয়ে যায় বুধু মান্ডি, ‘জঙ্গলঘেঁষা মেয়েরা’ আর নিস্তরঙ্গ সবুজেরা।
এই কাব্যগ্রন্থের একটি ঈর্ষণীয় সম্পদ হল কবির কাব্যভাষা। নিজের জন্মভিটা ও জীবনরহস্য অনুসন্ধানে কবি যে কাব্যভাষাটি ব্যব্যহার করেছেন তা যেন কবি কোন এক রহস্যময় অতল, এক অবচেতন, কিংবা ঘুমের দেশ থেকে খুঁড়ে এনেছেন। বেশ কিছু কবিতা তাই অত্যন্ত নিবিড় পাঠের দাবি রাখে। আর সেই কারণেই কবির কবিতায় একাধিকবার এসেছে ঘুমের উপমা। এই ঘুম সাধারণ ঘুম নয়। কবি যেন সেই মিথিকাল লিথে (Lithe) নদীর জল খেয়ে আচ্ছন্ন অবস্থায় ফিরে পেতে চাইছেন তাঁর সরলতার গান। ‘সমুদ্রকে লেখা কবিতা’য় কবি বলছেন ‘লবনাক্ত তোমার ডাক/ তোমার গর্জনে শুধুই লবণ/ অশিক্ষিত এই চৈতন্য/ নির্বোধ এই জিভ/ কতটুকু স্বাদ পায় তার?’ আর সেই জন্য কবি অশিক্ষিত এই চৈতন্য থেকে বারংবার ফিরে গেছেন শিক্ষিত এবং আলোকিত অচৈতন্যে/ অবচৈতন্যে। ‘ঘুমের ভেতরে ঘুম’ কবিতায় ‘ঘুমের অতলান্তে আরও এক ঘুম/ উঁচু উঁচু দালানের ছায়া/ ছায়ায় শুধু বেড়ালের ঝলমলে চোখ/ সামান্য আলোয় কি সুন্দর দেখাচ্ছে তোমাকে’; ‘ঘুঙুর-বর্জিত পা’ কবিতায় এরকম একটি আলো-আঁধারি দৃশ্যকল্প তৈরি হয়— ‘মাঝরাতে টিকটিকির উপর/ শুয়ে থাকে টিকটিকি/ মাঝরাতে জানালা খোলে সুনন্দা/ ধান-উঠে যাওয়া মাটির গন্ধ/ অন্ধকারের সাথে খেলা থামায়/ বহুদূরে শুরু হয় খেলা শেষের হৈ হৈ’; ‘ঘুমের দেশ থেকে’ কবিতায় অসামান্য কয়েকটি লাইন— ৩ নম্বর পঙতিঃ ‘পেয়ারার ভেতরে বীজের মতো সে আমাকে দেখে নিচ্ছে। আমি বসে বসে হৃদয় দেখাচ্ছি তাকে। জীবিতের সহিত মৃতের এই কথোপকথনের দিকে নেমে আসছে আস্ত একটা সিঁড়ি। সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাচ্ছে কলম-কাগজে ঘর্ষণের মায়া-শব্দ’; ৬ নং পঙতিঃ ‘মাঠ ছেড়ে উঠে গেছে মেঠোফুল। দুঃখ নিয়ে চলে গেছে দুঃখিত মানুষেরা। মাঠের এক প্রান্তে ফকিরের কুঁড়েঘর থেকে ভেসে আসে ওইসব সুর। উড়তে উড়তে ফেসবুক-যুগ পেরিয়ে পাখিরা নিয়ে এসেছে কবিতা। মাঠের চার কোণে পোঁতা হয়েছে কবিতার পতাকা। হাওয়ায় নাচছে শব্দরা...’; ‘গাধার ঘুম কবিতায়’— ‘আমি যত শুনি রাত কাঁদে তত/ রাতের কান্নায় তুমি আছো না কি— সেই খোঁজ করি/ খুঁজতে খুঁজতে দু-একদিন গাধার মতো ঘুমিয়ে পড়ি’; ‘ফুসফুসের দিন’ কবিতায় ‘যেখানেই পা ফেলেছি, মনে হচ্ছে মাটির নীচে/ ঘুমন্ত বেড়াল শুয়ে আছে,/আমার পায়ের শব্দে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে তার’; কিংবা ‘ঘুমিয়ে থাকো ছবি’ কবিতায় ‘গাছের ছায়ায় একটি কুকুরির জেগে ওঠা দেখলাম। চারপাশ থেকে ডাকছে বাচ্চারা। প্রতিটি ডাকেই কেঁপে উঠছে স্তনের দেশ। কুঁইকুঁই শব্দে ডাকছে কবিতা। আমি কি কাঁপতে পারব কবিতা?/.../ আমি বেড়ালকে ডাকছি। বেড়াল আমাকে/ যেন কেউ কোনোদিন এভাবে ডাকেনি আমাদের। এক কার্নিশ থেকে আরেক কার্নিশে লাফ দিল সে, আমার পা শিরশির করছে...’। এইভাবে ঘুম-জাগরণ-শিহরণ অবিরাম এবং নিদারুণ সুন্দরভাবে এসেছে কবির কবিতায়।
কবির প্রিয় দুই অনুষঙ্গ কান্না ও ঘুম আবার ফিরে এসেছে শেষ কবিতায় যেখানে কবি নিজেকেই প্রশ্ন করেন ‘কীসের এট ট্যাবলেট! কীসের এত না-ঘুম!/.../ সেই যে দেখেছিলে সূর্যটা ভেঙ্গে/ হাজার হাজার টুকরো লাল ছড়িয়ে পড়ছে তোমার মাথায়/ সেই তোমার সৃষ্টির মুহূর্তে তুমি/ কেঁদে ফেলেছিলে—/ কোথায় সেই কান্নাকাটি—/ কোথায় হারালে তুমি/ শেকড়ওয়ালা কবিতা তোমার’। কবি এইভাবে কান্না, ঘুম, অবচেতনা, মহুলের দেশ, শিকড়, যাত্রা-কীর্তনগান, নতুন বিচ্ছেদ কাহিনী, শব্দের ঢেউ, শব্দের আঁশ, আদিগন্ত সমুদ্র, জলশূন্যতা, জলের যন্ত্রণা খুঁড়ে খুঁড়ে খুজে ফেরেন তাঁর শৈশবের আস্তাবল যেখানে থমকে আছে হারিয়ে যাওয়া বাতাস, যেখানে চৈত্র পূর্নিমার দিনে চাঁদের আলোয় দেখতে পাওয়া যায় ‘একান্যা ডুংরি’ আর শালপিয়ালের বন, আর আমাদের নাকে এসে লাগে ‘ভুড়রুপাকার গন্ধ’; ‘বেড়াতে আসার মিছিমিছি খেলা’ আর ‘ভুড়রুপাকার গন্ধে’র অমোঘ আকর্ষণ— এই দুই বিপরীত জীবন-অনুসন্ধান ও উপলব্ধির আন্তঃসম্পর্ক, দ্বন্দ্ব, যাতায়াত, দোলাচল ও সর্বোপরী নিবিড় পরিপূরকতা এই কাব্যগ্রন্থের মূল উপজীব্য।



                                         


No comments:

Post a Comment