ধূসরতার মধ্যে চেনা তুমি...
একজন শিল্পী তার চিরকালের শিল্প
যাত্রায় নিজস্ব চিন্তা চেতনা দিয়ে বাস্তব থেকে অতি বাস্তবিক এক জগতের রেখা অংকন
করেন। বিমূর্ততার দিকেই মূলত এই যাত্রা, এবং সেই মহার্ঘের স্বাদ খুব সামান্য
কয়েকজন মানুষ ছারা কেউ গ্রহণ করতে পারেন না। এবং সেই রসবোধের মহৎ অধিকারী হল একজন কবি।
বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় প্রায় দু’দশকেও
বেশি সময় পরে এমনই একটি বোধি ও আদ্যন্ত রোম্যান্টিক কাব্যগ্রন্থের জন্ম হল। বলা
ভালো, রচিত হল মনের অতি গভীরে আত্মগোপন করে থাকা এক মরমিয়া ধ্বনি যা এই মুহূর্তে
বাংলা কবিতার ঘরে নতুন প্রজন্মের মধ্যে প্রায় নিঃচিহ্ন।
কবি অর্ণব চৌধুরী’র ‘ সকালের কাছে
নতমুখ ‘ এমন একটি কাব্যগ্রন্থ যা কিনা প্রেমের মাধুর্যে ও বিষাদের বাতাস মিশ্রিত
এক ছান্দিক ও মগ্ন বহিঃপ্রকাশ যার প্রতিটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র শব্দের মধ্যেও এক
প্রাকৃতিক জীবনের লক্ষণ দেখা যায়।
আমার এই নিবন্ধের উদ্দশ্য কেবল মাত্র
এই কাব্যগ্রন্থের ভেতর যে হৃদয় উৎসারিত বোধের আলো-আঁধার রয়েছে তাকে সামান্য ছুঁয়ে
পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়া। বইটির পাঠ প্রতিক্রিয়া লেখার মধ্যে দিয়েই আমি কিছু কবিতা
বা কবিতার অংশ উল্লেখ করছি শুধু মাত্র তার আঙ্গিক গত দিক থেকে নয় বরং সার্বিক
কবিতার যাত্রায় তার স্পন্দনের এক অভূতপূর্ব বোধের জায়গা থেকেও।
যেমন,
“ ধূসরতার মধ্যে চেনা তুমি আমার কেউ
হবে না
সার্থকতা হারাই বসে আমি
মজে ছিলাম সুরের টানে নেশার মতো বিষাদযানে
সে সব কিছু ভুলেই গেলে তুমি “
সার্থকতা হারাই বসে আমি
মজে ছিলাম সুরের টানে নেশার মতো বিষাদযানে
সে সব কিছু ভুলেই গেলে তুমি “
অথবা
“ আসলে জানি এসব শুধু অভিমানের ব্যথা
যা কিছু আজ ঈষৎ কেঁপে দোল খেয়েছে মনে
চোখের জলে ভিজেছে কত স্মৃতিমুগ্ধ পাতা
সারাটাদিন ছুটেছি আমি প্রহেলিকার টানে “
যা কিছু আজ ঈষৎ কেঁপে দোল খেয়েছে মনে
চোখের জলে ভিজেছে কত স্মৃতিমুগ্ধ পাতা
সারাটাদিন ছুটেছি আমি প্রহেলিকার টানে “
কবিতাগুলির মধ্যে খুব নিপুণ ভাবে ধরা
আছে একজন কবির মনের গভীরে গূঢ় অভিমান যার পরিধি ঠিক শব্দে মাপা যায়না, কেবল অনুভব
করা যেতে পাড়ে। অর্ণবের কবিতার মধ্যে দিয়ে উঠে এসেছে এমন কিছু বাকস্পন্দের চলন যার
লক্ষ এক বিমূর্ত জগতের যেখানে সমস্ত কিছু গভীর ও এক মায়াময় সুরে লিপ্ত। যখন তিনি
লেখেন- “ বোঝা না বোঝার মাঝে বুনে ওঠে ভেজা ঊর্ণাজাল “ বা “ ছায়া এসে ভর করে, ছায়া
নাকি অতল সঙ্গীত “
খুব গভীরে গিয়ে কান পাতলে ঠিক সেই সঙ্গীতের মুগ্ধতা অনুভব করা যায় যা ঠিক বসন্তের অলস হাওয়ার মতো মন স্পর্শ করে। বইয়ের কবিতাগুলির ভেতর এক অস্বচ্ছ কুয়াশার স্তর আছে যার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে রয়েছে এক অমোঘ প্রেমের চরাচর, বলা যেতে পারে অর্ণবের কবিতার যাত্রায় Grey Romanticism ‘ এর সুত্র পাওয়া যায়।
খুব গভীরে গিয়ে কান পাতলে ঠিক সেই সঙ্গীতের মুগ্ধতা অনুভব করা যায় যা ঠিক বসন্তের অলস হাওয়ার মতো মন স্পর্শ করে। বইয়ের কবিতাগুলির ভেতর এক অস্বচ্ছ কুয়াশার স্তর আছে যার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে রয়েছে এক অমোঘ প্রেমের চরাচর, বলা যেতে পারে অর্ণবের কবিতার যাত্রায় Grey Romanticism ‘ এর সুত্র পাওয়া যায়।
বইটি আপাত ভাবে দুটি ভাগে বিভক্ত হলেও
এই ভাগ বা এই space’ এর মাহাত্য বেশ গভীর। এই শূন্যতার ভেতর বুনে ওঠে এক অন্ধকারাচ্ছন্ন
জগত যার অধিকারি অর্ণব লিখে রাখেন এক অপূর্ণতার আভাস-
“ রাত্রি থেকে ধরে রেখেছি শিয়রে
জাগা ঘুম/ সন্দেহের তুষার যেন ঝরছে
নিঃঝুম “
বা “ তামস ভরা এমন জীবন আকাশ থেকে
জানলা বেয়ে/ পিঁপড়ে হয়ে নামলো চোখে,
সামনে কোনো খাদ ছিল না “
জীবনের গাঢ় অন্ধকার বোধ বরাবর উঠে আসে
কবিতাগুলির মধ্যে এবং আরও লক্ষণীয় হয়ে দাঁড়ায় এই বোধ সঞ্জাত ভাবনার প্রকাশ
“ আমাকে যারা আড়াল করে রাখো
প্রদীপটুকু নিভিয়ে দাও জ্বেলে
পরাগ মেখে তোমরা শুয়ে থেকো
ভাসবো আমি চিরকালীন জলে “
প্রদীপটুকু নিভিয়ে দাও জ্বেলে
পরাগ মেখে তোমরা শুয়ে থেকো
ভাসবো আমি চিরকালীন জলে “
“ অনেক দূরে ওই যে ভেসে যায়
ইতিহাসের কুয়াশালীন শব
সংসারের মধ্যে পড়ে থেকে
দূরত্বই আমার কলরব “
ইতিহাসের কুয়াশালীন শব
সংসারের মধ্যে পড়ে থেকে
দূরত্বই আমার কলরব “
যদিও এই বাঁধা পরিশরে বইটি সম্পর্কে
খুবই সংক্ষিপ্ত একটি ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া রাখলাম। এই কবিতাগুলির বিস্তার আরও সময়
ও বড় পরিশরে ধরে ভালো হত, কিন্তু উপায় নেই। সব শেষে একটি কথা বলার, বাংলা কবিতায়
এই সময়ে যে ছন্দের এবং শব্দচয়নে এই বইটিতে অর্ণব চৌধুরী কবিতাগুলি রেখেছে তার জন্য
হৃদয়ের অন্তর থেকে ভালোবাসা এবং শুভ কামনা রইল। ভবিষ্যৎ’এ আরও সুগম ও মায়াময় হয়ে
উঠুক তার কবিতা এবং পাঠকের মনে অবশ্যই স্থান গ্রহণ করুক।
বইটির প্রস্তাবনা খুবই ছিমছাম ও
সুগঠিত। সাম্প্রতিক প্রচ্ছদের রীতির বাইরে গিয়ে একটি অপূর্ব মৌলিক প্রচ্ছদের ভাবনা
ফুটিয়ে তুলেছেন প্রচ্ছদ শিল্পী আনন্দী চট্টোপাধ্যায় , তাকেও আন্তরিক শুভ কামনা ।
আরও দীর্ঘ হোক শিল্পের যাত্রা।
বইঃ সকালের
কাছে নতমুখ
কবিঃ
অর্ণব চৌধুরী
প্রচ্ছদঃ
আনন্দী চট্টোপাধ্যায়
প্রকাশকালঃ
২০১৮ বইমেলা
দামঃ পঁয়ষট্টি
টাকা
No comments:
Post a Comment