Friday, 16 March 2018

সেলিম মণ্ডল


স্পর্শকাতর পদাবলী: এক আলোর সন্ধানরেখা

প্রত্যেকবছর মেলার আগে একটা লিস্ট বানাই কী কী বই কিনব কিন্তু সেই লিস্ট কখনই সম্পূর্ণ হয় না এবারো তাই হল এবারের বইমেলায় দুটি সেরা সংগ্রহ ছিল স্বদেশ সেনের কবিতা সংগ্রহ আর রূপা দাশগুপ্তের কবিতা সংকলন কতদিনের ইচ্ছে এদের কবিতা সংকলন পড়ব বইমেলা থেকে সংগ্রহ করা অস্তনির্জন দত্তের  কাব্যগ্রন্থ 'জাহাঙ্গীরকে লেখা কবিতা' নিয়েও আমি খুব উচ্ছ্বসিত আরবি শব্দের সঙ্গে তার কাব্যভাষা মিলেমিশে নতুন একটা ধারা তৈরি করেছে কিন্তু অধিক কারুকার্য যাপনকে যেন অবদমিত করেছে মনের আরাম পেলাম না তবে শেষদিন দেবোত্তম আমায় একটা পাতলা দু-ফর্মার বই দিয়ে বলল, দুটো কবিতা পড়ে দেখ দুটো কবিতা পড়েই আনতে দিলাম বইটির নাম ‘স্পর্শকাতর পদাবলী’। বইটি অনেক আগে প্রকাশিত হয়েছিল দেবোত্তমকে তক্ষুনি বলেছিলাম বইটির - কপি যা আছে সবই আনতেকিন্তু এক কপিই পেল
হিন্দোলদা ইনবক্স করল, সেলিম এবার বই রিভিউ লিখবে? সত্যি বলছি, আমি ভালো পাঠক হিসেবে কখনই নিজেকে দাবি করি না কবিতা পড়ি ঠিক, আড়ালে থাকা নির্জন কবিদের খুঁজে খুঁজেই পড়ি কিন্তু আমার বোঝা নিয়ে নিজের কাছেই কত প্রশ্ন তাও আবার কোনো পত্রিকায় বই রিভিউ!!! সম্ভব নয় বলব ভেবেও সাহস করে বলে ফেললাম, হ্যাঁ লিখব তবে বই রিভিউ নয়। এক খুঁজে পাওয়া আলোরেখা নিয়ে। আর এই আলোরেখার নাম সরসিজ বসু। কবি নিয়ে কে এই সরসিজ বসু? চিনি না আগে পড়িনি তবে এক দু-ফর্মার বইটি পড়তে পড়তে মনে হয়েছে— একজন দার্শনিক উনি একজন শব্দ কারিগরএকজন ভাবুকসৈনিক আমি এত কবিতার বই খুঁজে পড়ি কিন্তু ওনাকে পড়ছি এই ২০১৮তে এসে আমার ব্যর্থতা  ঠিক করলাম, আমার এঁনাকে নিয়ে লেখাটা দরকার ভালো লিখি, খারাপ লিখি— তবুও লিখব কিছু মানুষ অন্তত এঁনার লেখার সঙ্গে পরিচিত হবেন

বইমেলাতেই বইয়ের যে পাতায় চোখ আটকে গেছিল—

দুর্দশাই সঠিক আয়না,
ক্রমে এই গুঞ্জনই গম্ভীর হয়েছে

স্মৃতির অদূরে ব্যক্ত ছোট ছোট বলিরেখা
নিজের নকল
বানাতে বানাতে ক্লান্ত

বিষন্নতা: পরশপাথর
যাতেই ছোঁয়াও তুমি সে তোমার সঙ্গে কথা বলে

সত্যিই তো দুর্দশাই আমাদের সঠিক আয়না। একমাত্র এই সময়ই আমরা পারি নিজেকে স্পষ্ট দেখতে। সুসময় আমাদের কাছে জাদুকরের একটা বিরাট মঞ্চ। চোখ সবসময় ওই মঞ্চেই আটকে থেকে। চারিপাশ কিছুতেই দেখে না। একমাত্র দুর্দশার সময় আমরা দেখতে পারি— সময় ক্লান্তি নিয়ে কীভাবে আমাদের ভিতর জাঁকিয়ে বসছে। স্মৃতির অদূরে আমরা কেবলই দর্শক। আমাদের কথা বলার জন্য দরকার সেই পরশপাথর যাকে ছুঁয়ে দেখার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা বেশি প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

কেন জানি না, যে শব্দগুলো নিজের সঙ্গে কথা বলে... সেই শব্দমালায় সজ্জিত কবিতাকে নিজের মনে হয়। মনে হয়, টুপ করে কবির নাম মুছে দিয়ে নিজের নাম বসিয়ে নিই। দাবি করি এ লেখা আমার। অনেকটা স্বার্থপরের মতো।

অবজারভেশন কবিতায় হৃৎপিন্ড, দর্শন ফুসফুস আর যাপন হল কিডনি। তবে নির্মাণ কবিতাকে আলো দেখায়। সে আলোতে আমাদের পথের সমস্ত ঢিবি আমরা মাড়িয়ে যেতে পারি। সরসিজ বসুর কবিতা পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল, সবটাই তিনি রেখেছেন হয়ত বা রাখার চেষ্টা করেছেন।

এক জায়গায় তিনি বলেছেন, “প্রকাশ্যে ক্ষোভের কথা বলতে পারো বলো/ বিষাক্ত বিবৃতি দিয়ে ফুর্তি কোরো না।” কবির এই অপকট বলা আমাদের ভিতরকার সংকুচিত অবস্থাকে তীব্র ধাক্কা দেয়। সেই তো, ক্ষোভের কথা আমরা পিছনে বলব? সেখানে কোনো মুক্তি নেই। নেই সমাধান। যা প্রকাশ্য তাই আলো। আবার কবি বলেছেন, বিষাক্ত বিবৃতি দিয়ে স্ফূর্তি কোরো না। এখানে দেখা যায় কবির নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি। বিষাক্ত বিবৃতি দিয়ে স্ফূর্তি করার লোক ক্রমশ ভরে যাচ্ছে চতুর্দিক।   

দু-ফর্মার ‘স্পর্শকাতর পদাবলী’তে অজস্র মণিমুক্তোর মতো পংক্তি পাওয়া যায়। কিছু পংক্তি নীচে তুলে দিলাম—

ক।
এমন একটা স্বর্গ নাগালের মধ্যে
যেখানে প্রত্যেকেই মূর্খ, আর সকলেরই
ভয় শুধু পাছে পড়ে যায়

খ।
হেঁয়ালি করতে দেখে ডাউট হয়েছে।
জাল ছিঁড়ে বেরোলেও, জল ছেড়ে কোথায়ই-বা যাবে?

গ।
নষ্ট তারার খোঁজে, লাঠি হাতে
চলেছে নাইট গার্ড

ঘ।
স্পর্শকাতর বন্ধুকে দাহ করে এসে
সকলে নতুন নাম নিই

ঙ।
জীবনে ঢোকার মুখে কী বিপত্তি,
মুখে পড়া ফৌজদারী আলো
আক্ষরিক অর্থ ছেড়ে বেরোতে চায় না!

চ।
নৈঃশব্দ্য রচনা করে আমরা তা
মাতলামোয় খরচ করি

উপরের পংক্তিগুলো পড়ে বোঝা যায়, কবির চিন্তা ও বোধের জায়গা কতটা মসৃণ ও বিস্তৃত। জীবনকে নানাভাবে দেখেছেন কবি। কবির দেখার পরিধি অনেকটাই বিস্তৃত। জীবনকে নিয়ে কবি হেঁয়ালি করেছেন, ছুঁড়ে দিয়েছেন নানা প্রশ্ন। উত্তর তিনি পেয়েছেন কিনা হয়ত আমরা জানি না। কিন্তু আমরা পাঠকরা তাঁর কবিতার মধ্যে দিয়ে অনায়াসেই চলে যেতে পারি অনেকদূর। আমি বরাবর বিশ্বাস করি, কবিতাকে কবি পাঁচমাথার মোড়ে রেখে দিক। আর সব প্রান্তে থাকুক পাঠক। পাঠক যেদিকেই চাইবে কবিতা যেন সেদিকেই যেতে পারে। সবদিকেই সহজ রাস্তা। দুর্গম নয়। আমি হয়ত কোনো একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে কবি সরসিজ বসুর কবিতাকে পেয়েছি খুব সহজভাবে। খুব কাছ থেকে। কাছের করে।

আরও একটি সম্পূর্ণ কবিতা নীচে দেওয়া হল। পাঠক আপনি পড়ুন। আর দাঁড়িয়ে থাকুন কোনো এক মোড়ে।

আমরা কি আজকের চিতা!
গায়ে ময়লা ছাল সেই কবে থেকে, ধোপার বাড়িতে দিইনি
গুটি বসন্তে রং জ্বলে পোকায় কেটে ছোটো হয়ে গেছে

গুপ্তকথা: গুপ্তধন-প্লাস। আমরা কি আরো নগ্ন আরো
খর্ব কুৎসিত নিয়েছি? হিস্টিরিয়া ফিরে এল পাইরেট হয়ে

হিংসাই যদি না থাকে, ভয়ডর, ঘৃণাও না থাকে
মনের সমস্ত ভুল যেন বুড়ো হয়ে যায়
মহাকর্ষ কমে আসে, হাসি পেয়ে বসে   


5 comments:

  1. আমিও পড়িনি...ভালো লাগলো! পড়তে হবে...বেশ সংবেদী লেখা।

    ReplyDelete
  2. সরসিজ বসু এই সময়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কবি বলে মনে করি।
    প্রসঙ্গত,তাঁর গত কয়েক বছরে প্রকাশিত অধিকাংশ কবিতার বই নিজেই প্রকাশ করেছেন মুক্তাঞ্চল নামক প্রকাশনার ব্যানারে, যা আমারই কয়েন করা।
    ওনার প্রতিটি বইই ভাবনায় দাগ রেখে যায়।

    ReplyDelete
  3. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  4. রূপা দাশগুপ্তের কবিতা সংকলন বইটার প্রকাশনী আর প্রকাশকালটা যদি একটু বলেন, তাহলে খুব ভালো হয়।

    ReplyDelete
  5. দাদা, অনুগ্রহ করে একটু জানাবেন। খুবই প্রয়োজন।

    ReplyDelete