Saturday 17 March 2018

গৌতম বসু



হাকিম সানাই


বাড়ি থেকে বেরিয়েই, যে পথটি ধরে আপনি হেঁটে যান প্রত্যহ, তার কি কোনও বিশেষত্ব আছে ?  উঁচু একটা পাঁচিল কখনও চোখে পড়েছে আপনার, পায়ে-চলার পথের সমান্তরাল, যা চলে গেছে বহুদূর, যতদূর দুচোখ যায়? দেখেন নি ? হায়, আমিও দেখি নি সেই উঁচু ও দীর্ঘ পাঁচিল, কেবল শুনেছি  তার কথা । আমাদের প্রত্যেকের জীবনের এক ধার দিয়ে না কি চলে গেছে সেই লম্বা, টানা পাঁচিল -  ভুল বললাম, কোথাও যায় নি সেটা, রয়ে গেছে এখানেই, আপন দৈর্ঘ্যে ও ভারে, অনড় । প্রশ্ন ওঠে, কী আছে  পাঁচিলের ওধারে ? ফিরদৌস ? দিব্যবাগান ? আপাতত, তোলা থাক এই আলোচনা -  আমরা বরং পুরাতন এক গল্পে প্রবেশ করি ।

        গল্পটি সেই সময়ের, যখন গজ়নি-র সুলতানদের ঘন-ঘন আক্রমণে   ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত ঘোরতর বিপন্ন । অশ্বারোহী সৈন্যদলের স্রোতের পর স্রোত ধুলো উড়িয়ে প্রবেশ করত এ-দেশে, সামনে যা পেত লুঠপাট করে, আবার ধুলো উড়িয়ে ফিরে যেত। আমাদের গল্পের সকালটি ওইরকমই একটি  সকাল; সব প্রস্তুতিগ্রহণ সম্পূর্ণ, সুলতান ইব্রাহিম কিছুক্ষণ বাদেই  তাঁর নতুন অভিযান শুরু করবেন। ওদিকে, তাঁর দরবারের জ্যোতিষ্ক, তরুণ প্রতিভা, হাকিম সানাই এক প্রশস্তিমূলক কাব্য রচনা করেছেন সদ্য, লেখাটি হাতে নিয়ে তিনি ব্যস্ত পায়ে,সেই পাঁচিলের ধার দিয়ে চলেছেন রাজপ্রাসাদের দিকে, দ্রুত চলতে-চলতে ভাবছেন, লেখাটি সংশোধন করতে-করতে দেরি হয়ে গেল খুব, শীতকালের এই ঝল্‌মলে  সকালে মহামান্য সুলতান বুঝি  এতক্ষণে সৈন্যদলের পুরভাগে, হিন্দ্‌-এর উদ্দেশে রওনা হয়ে গেছেন !

            পাঁচিলের ওধারের বাগানে বসবাস করত লাই খুর  নামের  এক কুখ্যাত, অসামাজিক, দুর্বিনীত লম্পট-ভিখারী কেউ-কেউ আবার, লম্পট নয়, তাকে সাধু হিসেবে মান্য করতেন। সে যাই হোক, দৌড়তে-দৌড়তে হাকিম সানাই  শুনতে পেলেন লাই খুর-এর উচ্চস্বর, এক সহচরকে সে বলছে : সাকি, আরও এক পাত্র সুরা এগিয়ে দাও আমায় ,আমি সুলতান ইব্রাহিম-এর অন্ধত্ব কামনা করি!সহচর বললে, ‘ চুপ, চুপ ! অমন কথা বলতে নেই, তিনি  যে আমাদের সকলের সুলতান!সহচরের সতর্কবাণীতে কর্ণপাত না করে লাই খুর  উচ্চস্বরে বলে চলল, ‘কোনও  সুস্থমস্তিষ্কসম্পন্ন সুলতান এই প্রবল শীতে, আমাদের এই রূপসী শহর ছেড়ে - যে শহরের মানুষ তাকে এত ভালবাসে, এবং যাদের রক্ষা করা তার অন্যতম প্রধান দায়িত্ব নিজের দেশের মানুষকে সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় ফেলে রেখে, নির্বোধের মতো সমূহ সেনাবাহিনী নিয়ে  ভিন্‌দেশে যেতে পারে ! এই তার কর্তব্যবোধ! লোকটা তো অন্ধ হয়েই রয়েছে!        
          হাকিম সানাই এই সমস্ত বাক্যালাপের  জন্য আদৌ  প্রস্তুত ছিলেন না, হতচকিত হয়ে লাই খুর-এর তিরস্কার শুনতে-শুনতে তিনি এগিয়ে চললেন বটে, কিন্তু তাঁর চলার গতি হ্রাস পেল । নিজেকে সামলে নেবার আগেই তিনি আবার  শুনতে পেলেন লাই খুর-এর সেই  দৃপ্ত কণ্ঠস্বর,‘আরও একবার, সাকি, আরও এক পাত্র সুরা এগিয়ে দাও আমায়, এবার আমি কবি সানাই-এর অন্ধত্ব কামনা করব!সহচরের কণ্ঠে তীব্র প্রতিবাদ শোনা গেল এবার, ‘ কী বলছেন আপনি ! মানুষ যে কবি সানাই-কে সুলতানের চেয়েও বেশি ভালবাসে ! তাঁর উদ্ভাস , তাঁর শব্দের জাদুবল, অপূর্ব তাঁর ছন্দমিলের কারুকার্য, এ যে সত্যিই বিরল! আমার তো মনে হয়, অভিশাপ নয়, আপনার উচ্চ প্রশংসা তাঁর প্রাপ্য ।

            তৎক্ষণাৎ  বন্ধ হয়ে গেল হাকিম সানাই-এর ধীর পায়ে চলাও । দাঁড়িয়ে পড়ে তিনি শুনতে লাগলেন লাই খুর-এর  ব্যাখ্যা : থামো তুমি ! আমি ঠিকই বলছি । এত বোধবুদ্ধি যার, এত গভীর অন্তর্দৃষ্টি, সেও তার বর্তমান অস্তিত্বের অন্তঃসারশূন্যতা  বুঝতে পারছে না ! নিজের অন্তরাত্মার পানে চোখ মেলে চাইল না একবারও ? চৈতন্য লাভ করুক সে, এই আশায় সম্পূর্ণ নিশ্ছিদ্র অন্ধত্ব কামনা করছি আমি, তার জন্য!

                                                            


*

          পাঠক সহজেই অনুমান করতে পারছেন, প্রশস্তিমূলক কবিতা হাতে রাজদরবারে     হাজির হওয়া সেদিন আর সম্ভব  হয়নি হাকিম সানাই-এর, সেদিন তিনি নিজের গৃহে ফিরে এসেছিলেন, তারপর অনির্দিষ্টকালের জন্য  বেরিয়ে  পড়েছিলেন আবার। অন্ধত্বের অভিশাপ কাঁধে বয়ে-বয়ে, শুষ্ক, দুর্গম, মরুপ্রতিম সেই পাহাড়ি এলাকায় কোথায়-কোথায় যে ঘুরেছিলেন, আমাদের পাণ্ডিত্যপূর্ণ ইতিহাস তার সব খবর হয়ত রাখে নি, কিন্তু, দেখা গেল, স্বয়ং মহাকাল হাকিম সানাই-এর প্রতি সদয় ছিলেন । 
   
≈≈≈≈≈≈≈










হাকিম সানাই-এর হাদিকাতুল হকিকৎথেকে চারটি  টুকরো

অদ্বিত্ব বিষয়ে প্রত্যয়ের প্রকাশথেকে

বৃহৎ অথবা ক্ষুদ্র, কোন্‌ স্থানে মিলবে তার স্থান, কারণ, সত্য এই যে, স্থানের নেই কোনও স্থান । স্থানের সৃষ্টিকর্তার জন্য কোনও পৃথক স্থান কীভাবে গড়ে উঠবে, স্বর্গের সৃষ্টিকর্তার জন্য পৃথক কোনও স্বর্গ ? তাঁর নিকটে, স্থান উপনীত হতে পারে না, পারে না কালও ; বিবরণ তাঁর সংবাদ বহন করতে পারে না, পারে না বীক্ষণও । স্তম্ভ নির্মাণের পরে নির্ভরশীল নয় তাঁর স্থায়িত্ব, তাঁর অস্তিত্বের নেই কোনও নির্দিষ্ট বসতি ।

*

 নীরবতা রক্ষা বিষয়েথেকে

ধর্মের পথ কর্ম দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় না, বাক্যের দ্বারাও নয়; তার উপর কোনও ইমারত নির্মিত হয় নি, সে এক জনবিরল প্রান্তর । সে-পথ অনুসরণ করার তরে যিনি নীরব হলেন, বাক্‌শক্তি তাঁর প্রাণময়, মধুর ; তিনি যদি কথা বলে ওঠেন, তা অজ্ঞতাপ্রসূত হবে না, আর, বিপরীতে, নীরবতা রক্ষা করেন যদি তিনি, তা আলস্যের ফসল নয় । জেনো, নীরব থাকার সময়ে তিনি যেমন চপলতা উদ্ভাবন করছেন না, ঠিক তেমনই, নিজেকে ব্যক্ত করার সময়ে তাঁর আলাপ  নিরর্থক প্রলাপ হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে না।    

       এই নির্বোধেরা, এই তস্করসকল ও গাঁটকাটা চোরেরা, রাজপথে ডাকাতির জন্য তাদের বিদ্যাবুদ্ধি সুরক্ষিত রাখে। তুমি দৃষ্টিসম্পন্ন, হে মালিক, বহু বাক্যের অধীশ্বর হয়েও, চিত্তে তোমার বাক্যেগুণের চেয়েও আলোর প্রভা অধিক ; তুমি যখন শান্ত, তোমায় তখন সর্বাধিক বাঙময় বলে বোধ হয়, আর, কথা বলে ওঠো যখন, তখন তুমি সমরবিজয়ী ! কুনশব্দটিতে দুটি অক্ষর, দুটি অক্ষরেরই কণ্ঠরুদ্ধ হূশব্দটিতেও দুটি অক্ষর, তারাও সম্পূর্ণ নীরব ।

_______
অর্থসঙ্কেত

১.  কুন -> হওয়া  সৃষ্টিরহস্য প্রসঙ্গে ব্যবহৃত ।
২.  হূ -> তিনি, ঈশ্বর । 
এই গ্রন্থটি ইংরেজিতে প্রথম অনুবাদ করেন মেজর স্টিফন্‌সন্‌, তাঁর মন্তব্য এইরকম : এই পঙক্তি বিষয়ে টীকাকারদের থেকে কোনওরকম সহায়তা পাওয়া গেল না । এমন একটি ইঙ্গিত এখানে পাওয়া যাচ্ছে যে, মহত্তম  অস্তিত্বের ক্ষেত্রে ভাষার কোনও কার্যকরী ভূমিকা থাকে না।

*

                                                 একটি গল্পথেকে

সমস্যাসঙ্কুল এই  পথমাঝে, এই ঘনতমসায়, হে সিকন্দর, তুমি  কি পয়গম্বর খিজ়র-এর মতো,  প্রাণদায়িনী প্রস্রবণ  লাভ করবে বলে, পায়ের নীচে আটক করেছ আমার রত্নখানি!

_______
অর্থসঙ্কেত

১.  সিকন্দর -> সম্রাট অ্যালেকজ়াণ্ডর
২.  খিজ়র -> একজন সন্ত / পয়গম্বর । কথিত আছে , ইনি অমৃত পান করে চিরজীবী হয়েছিলেন ।


*

                                                 স্বপ্নের ব্যাখ্যাথেকে

ঘুমের মধ্যে অশ্রুপাত আগামী দিনের সুখ সুনিশ্চিত করে;দাসত্বের অর্থ, লাঞ্ছনা হতে সুরক্ষা । ঘুমের মধ্যে শতরঞ্জ খেলার অনিবার্য ফল, যুদ্ধ আর  বিজয় আর হীনদশা ।



_____________________________
ঋণস্বীকার :

The First Book of the
Hadiqatu’l  Haqiqat
         or the
The Enclosed Garden of The Truth
         by
Hakim  Abu’l  Majd  Majdud  Sanai  of  Ghazna ( 1070 ? – 1150 AD ?  )

Edited and  translated by
Major J Stephenson, Indian Medical Service,
 Member of the Royal Asiatic Society and Asiatic Society of Bengal

Printed and Published by The Baptist Mission Press at Calcutta, 1910. 


4 comments: