Sunday 18 March 2018

চন্দন ঘোষ


নতুন ধারাবাহিক

            চিকিৎ-'শকিং' ডায়রি



সৌম্য জানে এই স্টেথো ছাড়া তার আর কোনো আত্মরক্ষার অস্ত্র নেই। এই এত বছরে সে এই সিদ্ধান্তে এসেছে যে ডাক্তারিতে পজিটিভ অ্যাপ্রোচ যতটা কাজ করে নেগেটিভ তার থেকে কম করে না। যেমন ধরুন, কেউ এসে বলল, ডাক্তারবাবু কোনো ভয় নেই তো? সে বলবে, ভয় নেই কী মশাই। চাদ্দিকে তো ভয় হী ভয়। এই যে বেঁচে আছেন এটাই তো চূড়ান্ত ভয়ের। লোকটা আর ঘ্যান ঘ্যান করবে না। কেউ ডাক্তারবাবু সুস্থ থাকব তো? মরে যাব না তো? সে বলবে, সুস্থ থাকার কোনো গ্যারান্টি হয় মশাই? জন্মেছেন যখন, একটাই গ্যারান্টি, নিশ্চিত মরে যাবেন। কাল আপনার এই ডাক্তার বেঁচে থাকবে কিনা, কেউ বলতে পারে? ন্যাগিং রোগীটি চুপ। এই রকম করতে করতে সৌম্য গত কুড়ি বছরে খুব নিস্পৃহ হয়ে গেছে। তাই বলে কি তার কোনো সিমপ্যাথি এমপ্যাথি নেই। আছে বৈকি। যথাস্থানে আছে। যে রিক্সাওয়ালা এসে বডি ফেলে দেবে তার কাছে, তার জন্যে  জান দিয়ে দেবে সে। আর তুমি ইজম-মারানো  ব্রহ্ম-আঁতেল, তুমি সবজান্তা বিড়িখোর কবি, তুমি পেছনপাঁকা দুনম্বরী রাজনীতির মেজদা, তোমাদের জন্য সেই বিখ্যাত নিঃস্পৃহতা, চাপা একটা স্যাডিজম। "যান, বাড়ি গিয়ে ভাবুন, বিড়ি ছাড়বেন কিনা। যদি উত্তর 'না' হয় তবে এই চেম্বারের ত্রিসিমানায় আসবেন না।" "ডাক্তারবাবু, আমি তো ফাইভ ফিফটি ফাইভ খাই"। "ওই সবই আমার কাছে বিড়ি"। এই ট্যাকটিক্সটা বেশ কাজ হয়, দেখেছে সৌম্য। লোকগুলো ঠিক ফিরে আসে। ভেগে যায় না।

এইসব এলেম একদিনে আসেনি তা সৌম্য ভালো করেই জানে। রেলের চাকরি ছেড়ে হেলথ সার্ভিসে জয়েন করার প্রথম দিন তাকে প্রায় মবড করে দিয়েছিল লোকাল এম এল এ। হই হই করে এক ঝাঁক ক্যাডার নিয়ে সি এম ও এইচ অফিসে ব্রেক ইন করে তাকে প্রায় কোলে তুলে নেয় আর কি! "দেখি, কোথায় আমার এম ও, দেখি তো।" তার আগে সাত বছর ওই সেন্টারে এম ও ছিল না। একেবারে বুভুক্ষু বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তারা। সেই দিনই সৌম্য টের পেয়েছিল, এ কোথায় খাপ খুলেছ সিরাজ, এ যে পলাশী।

তা প্রথম পোস্টিং ছিল সেই পলাশীর নিকটেই নবদ্বীপে। স্পেশাল পোস্টিং। চৈতন্য দেবের ৪০০ না কি, কত যেন বর্ষপূর্তি উৎসব হচ্ছে। সেই উপলক্ষে স্পেশাল পোস্টিং এক মাসের জন্য। সে সময় পোড়ামাতলা পার করে হসপিটালের রাস্তা ধরতেই শুনশান জঙ্গুলে একটা পরিবেশ। সে রাস্তায় কেউ কেটে রেখে গেলেও অন্যেরা খোঁজ নেবে না। সন্ধে হলেই খালি বোমের আওয়াজ। আর দুই গোষ্ঠির খুন খারাবি। হসপিটালে পৌঁছোনোর পর সৌম্যর প্রতি প্রথম যে উপদেশ দেওয়া হল তা হল, ডাক্তারবাবু ভুলেও সন্ধেবেলা নদীর দিকে যাবেন না। আর হাসপাতাল চত্বরের মধ্যে যতদূর থাকা যায় ততই মঙ্গল।

তা প্রথম দিন দশেক মন্দ গেল না। অসিতাভ, ওর রুমমেট, আসলে ওর কলেজেরই এক বছরের জুনিয়ার। ওর সঙ্গে হেভি দোস্তি হয়ে গেল। এগারোতম দিনে সৌম্যর নাইট ডিউটি। মেডিকেল কলেজের নাইট ডিউটি আর এই নাইট ডিউটি যে বেহেস্ত আর দোজখের ফারাক তা কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারল সৌম্য। এই স্ট্রোক আসে তো ওই সাপেকাটা। এই হার্ট অ্যাটাক তো ওই ওলাওঠা। এই রকম জেরবার এক অবস্থায় সাড়ে আটটা নাগাদ দুই সিস্টার এসে দাঁড়ালেন সামনে। তাদের অবস্থা বিধ্বস্ত, মুখ ফ্যাকাশে। কী হয়েছে সিস্টার, জিজ্ঞেস করতেই দুজনেই কাঁদো কাঁদো। বলল, স্যার আজ সব্বোনাশ হয়ে যাবে। 'কী ব্যাপার'। 'আজ ইভনিং-এ কালু গুণ্ডার বাচ্চা ভর্তি হয়েছে। অবস্থা ভালো না। সিভিয়ার ডিহাইড্রেশন। বাচ্চাটা মারা গেলে হসপিটাল ভাঙচুর হয়ে যাবে। আপনিও রেহাই পাবেন না স্যার। আর আমাদের কী লাঞ্ছনা হবে কে জানে। এমনিতেই কালু ভয়ঙ্কর। এলাকার ত্রাস। আমরা ডিউটিতে আসা-যাওয়ার সময় ও আর ওর সাঙ্গোপাঙ্গো টোন কাটে। আজ বলেছে,কান খুলে শোনো সিস্টার, আজ আমার বাচ্চার কিছু যদি হয়, তোমাদের রেপ করিয়ে দেব, ভগবানের বাবাও বাঁচাতে পারবে না'।
#
এই কথা শুনে সৌম্য একটু কেঁপে গেল। খুব মেকদার নিয়ে ১৫ দিনে রেলের চাকরি ছেড়ে চলে এসেছে সে। আজ সেজন্য  নিজেকে একটু শাপশাপান্তই করল সে। তবু সাহস সঞ্চয় করে বলে, চলুন তো সিস্টার, একটু দেখি। গিয়ে দেখে আড়াই বছরের একটা বাচ্চা। ভয়ঙ্কর ডিহাইড্রেশন। অবস্থা ভালো ঠেকল না মোটেই। কী করবে সে এখন। পেডিয়াট্রিক ডিপার্টমেন্টের খাটুয়া স্যার বলেছিলেন, যা শিখিয়ে তোদের ছাড়ছি তাতে মাঠে তাঁবু খাটিয়ে বসলেও করে খেতে পারবি। সৌম্য ভাবল, যা থাকে কপালে, আজ জয় মা বলে একটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে দেখি। 
#
এই সব যখন সে ভাবছে তখন কানের কাছে একটা কর্কশ গলার আওয়াজ শুনতে পায় সে। 'ডাক্তার, কী রকম বুঝছ। আমার একটাই ছেলে। ওঠাতে পারবে তো। ভুল করে পেট খারাপের মধ্যে আমিই জোর করে সিঙাড়া খাইয়েছি, ডাক্তার। ও খেতে চায়নি। ওকে না তুলতে পারলে আমার দিনদুনিয়া অন্ধকার হয়ে যাবে, ডাক্তার'। সৌম্য বলে, ভাই, তোমাকে ভাই বলছি, দরকার হলে তোমার ছেলের পাশে সারা রাত বসে থাকব। বাকিটা ওপরওলার হাত। লোকটা গোঁজ হয়ে চলে গেল। সিস্টাররা তখনও ঠকঠক করে কাঁপছে। সৌম্য বলল, চলুন সিস্টার আজ একটা চ্যালেঞ্জ নিই। তা প্রায় সারাটা রাত ছেলেটার পাশেই বসে কাটাল সৌম্য। যেটুকু চিকিৎসা মেডিকেল কলেজ তাকে শিখিয়েছিল তার সবটুকুই সে উজাড় করে দিল। আর সারা রাত কালু গুন্ডা একবার ওয়ার্ডে ঢোকে আর বেরিয়ে যায়। বাচ্চাটা ক্রমে নেতিয়ে পড়ছে। শেষ পর্যন্ত ভোরের দিকে সেই ব্যাপারটা ঘটল। সব কিছু শেষ হয়ে এল। সব শেষ। বাচ্চাটা শেষ বারের মত কালু গুণ্ডা আর সৌম্যর সামনে শেষ হেঁচকিটা তুলে থেমে গেল।
#
সিস্টাররা অনেক আগেই ঘরের দরজায় খিল দিয়েছে। শুন্য ওয়ার্ডে মুখোমুখি কালু গুন্ডা ও সৌম্য। সৌম্যর মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এল, হল না, ভাই, পারলাম না। কালু গুণ্ডাও ফ্যালফ্যাল করে দাঁড়িয়েছিল। বলল, আপনার কোনো দোষ না, ডাক্তারদা। এ আমারই এতদিনের পাপের ফল। আপনি সারারাত কী করেছেন আমি দেখেছি। আমিই দায়ী। আমিই মেরেছি ওকে। তারপর পাথরের মতো মুখ করে হঠাৎ দু হাতে ছেলের বডি তুলে নিয়ে বলে, তা হলে বাড়ি যাই, ডাক্তারদা। সৌম্য বলে, দাঁড়াও ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে হবে। কালু অপরাধীর মতো দেহটা আবার নামিয়ে রাখে বেডে। তারপর ঘুরে দাঁড়ায়। 
#
নবদ্বীপের ত্রাস কালু গুণ্ডা এখন হেরে যাওয়া বাঘের মতো ধীরপায়ে ওয়ার্ড ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আর কাঁচা রক্তের মতো ভোরের লাল আলো এসে গড়িয়ে পড়ছে সন্ত্রস্ত হাসপাতালটার বেডে বেডে।


1 comment:

  1. দারুণ লিখেছেন। ছবির মতো একেবারে।

    ReplyDelete