Friday 16 March 2018

দেবব্রত কর বিশ্বাস




        তুমি খুব গভীর চিন্তা করো

অরিত্রর কোনও বই নিয়ে, এমনকি কোনও লেখা নিয়েও আগে লেখা হয়নি কখনও। কবি অরিত্র সান্যাল। আমার এক সময়ের বন্ধু। এখন আর তেমন যোগাযোগ নেই। কিন্তু সত্যিই কি যোগাযোগ নেই? একই সময়ের ফসল আমরা। একই প্রজন্মের। আর সময়টা যখন আমাদের ক্ষেত্রে কমন, তখন একটা যোগাযোগ নিজে থেকেই তৈরি হয়ে আছে। আর তাই ওর লেখা পড়তে পড়তে আমার চোখের সামনে হাট করে খুলে আসে ওদের মেসবাড়ি। চূড়ান্ত অগোছালো একটা বিছানার একপাশে গুটিয়ে থাকা মশারি। বাঁকানো সিঁড়ির গায়ে লেগে থাকা শনিবারের বিকেল। এসব মহার্ঘ্য দৃশ্যের পাশে অরিত্র কেমন উদাসীন হয়ে থাকত সারাক্ষণ। যেন একটা দ্রুতগামী বাস এসে শরীর ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল। তবু টোল পড়ল না পথিকের মন্থরগতিতে। তেমনই এক রাজকীয় চলন আছে অরিত্র-র কবিতায়। অরিত্র আসলে হাঁটতে হাঁটতে কবিতা লেখে। লিখতে লিখতে বসে পড়ে উত্তর কলকাতা সুলভ রকে। সিগারেট ধরায়। দেখেও দেখে না চারপাশে বয়ে চলা রাস্তার স্রোতকে। এই যে দেখেও না দেখা, এটাই ওকে আলাদা করে দেয় অন্যদের থেকে। তাই ও দেখতে পায় রোজকার চেনাজানা জীবনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অচেনা সব কোডকে। আর ডি-কোড করতে থাকে নিজের লেখায়। এই যে যেমন ও দেখতে পায় "সবকিছুতেই ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর বয়স/ যে বিশাল ইমারত, এরপর, নজরে আসে/ তা পরিত্যক্ত, ধাতব এক হানাবাড়ি/ ভিতর দিয়ে হেঁটে ফিরছে জং প্রজাতির মৃত মানুষ-/ কোথাও কিচ্ছু নেই-উৎপাদনের ধাতু শব্দ হচ্ছে..." আমি অবাক হই। এই যে দেখা, এই যে বলে ফেলা সবকিছুতেই ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর বয়স... আমরা কি ভাবিনি? আমরা কি দেখিনি পুরনো কলকাতার পুরনো বাড়ির ভিড়ে এমন অনেক ছড়িয়ে থাকা বয়সের অনুষঙ্গকে। তারপর দেখুন,  ও বলছে জং প্রজাতির মৃত মানুষ। একাধারে জং এবং মৃত, এ এক অব্যর্থ কথা। ক্ষয়ে যাওয়া প্রজাতির মরে যাওয়া মানুষ। বাঙালির জীবনকে আর কেউ ধরেছে এভাবে? তাই এত অস্থিরতা খুঁজে পাই আমি অরিত্রর ভিতরে। সৃজনের অস্থিরতা। তাই ও লিখে ফেলতে পারে "আমার মাথার মধ্যে কী ভীষণ অস্থিরতা-/ লাইনে একবার দিতেই হু হু ছুটে গেল ট্রেন-" আমি বুঝতে পারি, এই অস্থিরতা কোথাও গিয়ে থামে না। গন্তব্যহীন ঢেউয়ের মতো সে বারবার আসা-যাওয়া করে সমুদ্রের তীরে। আমাদের গায়ে হাওয়া লাগে। আমরা হোটেলে ফিরে আসার ভান করে হাঁটতে হাঁটতে বারবার পিছন ফিরে দেখে নিতে থাকি সেই অস্থিরতা। কেমন একটা ঘোর চলে আসে অরিত্রর লেখা পড়তে পড়তে। চন্দ্রাহতর মতো সেই মায়াবী চুমুক, যা নেশা ধরায়, নেশা ধরায়, নেশা ধরায়। ঘোরলাগা চোখে দেখি, "একটা লোক চাঁদ ফেটে মারা গিয়েছে-/ তার কোনও মানে নেই। এবং সারাজীবন কোনও মানে ছিল না।" কবিজীবনের কথা লেখে অরিত্র। কবিতাযাপনের কথা লেখে। সত্যিই তো, এই কর্পোরেট স্মার্ট-দুনিয়ায় এভাবে চন্দ্রাহত হয়ে মরে যাওয়ার কোনও মানে নেই। সৃজনের খিদে আসলে তাড়িয়ে মারে কবিকে। অরিত্র লিখেছে "একমাত্র খিদে পেলেই তুমি সহজ ঝড়ে ধ্বংস হও"। ঝড় কখন সহজ আর কখন সে ধ্বংসপ্রবণ, সে কথা ভাবতে ভাবতে এই কবিতাটার প্রথম দুটি লাইনে আবার চোখ চলে যায়- "নিদ্রা বড় জটিল জিনিস-/ আচমকা ভাঙলে জল ছলকে ওঠে মাথার ভিতরে" ব্যাপারটা বোঝা গেল? যে সমুদ্রের পাশ থেকে ফিরে আসার পথ নিয়েছিল অস্থিরতা। আবার ফিরে গেছে সেখানেই। ঘোর এখানে নিদ্রার অলটার ইগোসব এলোমেলো হয়ে যেতে থাকে এইসব ভাবনাপ্রবণতার কাছে এসে। যে প্রবণতা সরীসৃপের মতো বক্ররেখা রচনা করতে করতে শরীরী হয়ে ওঠে। মিলনের কামনায় ঢেউ খেলে যায় কল্পনায়। আমি অরিত্রর চোখ দিয়ে দেখতে থাকি সেই সব- "মাঝরাতে অনন্ত থেকে তোমার ভ্রুয়ের আলো দেখা যায়/ নিটোল বক্র, কোনও উদ্বেগ নেই/ যেন দূর থেকে মানুষের মিলনের দৃশ্যটুকু দেখতেই রামধনু এসে আকাশে।" এই চরম আসক্তির জায়গা থেকে হঠাৎ করে সরে যায় অরিত্র। আর এভাবেই সরে যেতে পারে বলে ও ঠিক বুঝতে পারে "একখণ্ড পাথরের নিকটতম মানে ছিল রেলপথ/ আর এক টুকরো রুমালের মানে সামান্য একাকিত্ব" কী অদ্ভুত এবং অনন্য এই দেখা, তাই না?  আমি আবার পড়ি, আবার ভাবতে থাকি এক টুকরো রুমালের মানে সামান্য একাকিত্ব! সত্যিই তো। এই লেখা পড়ার পর আর কোনও কথা থাকতে পারে না। শহর, শহরের মধ্যে ঢুকে পড়া একা থাকার গ্রাম, সেই গ্রামের ভিতরে আবার ঢুকে পড়া একাকিত্বের শহর... এসব নিত্যনতুন ডিসকোর্সের ভিতরে জন্ম নিতে থাকে অরিত্রর কবিতা। ওর কবিতা কখনও দূরে কোথাও বেড়াতে যায়, কখনও যৌনভাবে মাতাল হয়ে ফিরে আসে শহরের ক্লিভেজে, কখনও আবার একা একা বসে থাকে বিকেলের অপূর্ববেলায়। যাদের স্বভাবেই কবিতা মিশে থাকে, তেমন দুর্লভ মানুষের নাম অরিত্রওকে খুব কাছ থেকে দেখেছি বলে আমি জানি। মহাকাল তার প্রতিটা সময়খণ্ডের জন্য কয়েকজন কথক নির্ধারিত করে রাখেন। তাঁদের কেউ কবিতা লেখে, কেউ গান গায়, কেউ ছবি আঁকে। অরিত্র এই সবকটিই করে। কিন্তু লেখার মাধ্যমে করে। শূন্য দশকের এই অত্যন্ত শক্তিশালী এই কবির সাম্প্রতিকতম কবিতার বই 'একটা বহু পুরোনো নেই' পড়ুন। পড়লে অরিত্র-র লেখাই অরিত্রকে ফিরিয়ে দিতে ইচ্ছে করবে- "তুমি খুব গভীর চিন্তা করো/ বহুদূরে/ একজন/ ছাতা হাতে/ তোমার ভেতরে হেঁটে যায়।"  


গ্রন্থ - একটা বহু পুরোনো নেই/ অরিত্র সান্যাল/ পাঠক/ ৮০ টাকা

No comments:

Post a Comment