Thursday 15 March 2018

বেবী সাউ



তৃতীয় নয়নে 'ক্ষত'

এক।

"ক্ষত"; একটি রক্তাক্ত ধারাভাষ্য

"একোবেশী সর্বভূতান্তরাত্মা একং রূপং বহুধা যঃ করোতি।

তমাত্মস্থংযেহনুপশ্যন্তি ধীরাস্তেষাং সুখং শাশ্বতং নেতরেষাম।।" (কঠোপনিষদ 2/2/12)



এই শ্লোকটি ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি। দেখতাম, কারণে অকারণে দাদু বারবার আওড়াতেন। চুপচাপ বসে থাকতেন তারপর। স্থির। মৌণ। যেন কারও আসার অপেক্ষায় দিন গুণছেন। অবাক হতাম। তখন মানে বুঝতাম না কিছুই। আজকাল দেখি বাবাও বিড়বিড় করেন। কী আছে এতে? দর্শন? আত্মখনন? নিজেকে আবিস্কার? নাকি নিজস্ব অপারগতাকে ঢাকতে সান্ত্বনা বাক্য পাঠের মত জাস্ট ক্ষতের মলম?

উপরের শ্লোকটিকে বাংলা অর্থ করলে যা দাঁড়ায়-

-- যিনি এক সকলের নিয়ন্তা, সর্বভূতের অন্তরাত্মা এবং যিনি একরূপকে বহুরূপে প্রকাশ করেন, এমন পরমাত্মাকে যিনি আপন অন্তরে দর্শন করেন তিনিই জ্ঞানী, শাশ্বত সুখের অধিকারী, অন্য কেউ নয়।

এখানেও সেই অসীম ক্ষমতাধর নিজত্বের প্রকাশ। পরম আত্মা। আর তাকেই খুঁজতে বসেছে, দিনের পর দিন, সমস্ত জন্মমৃত্যুশোক। জন্মগত সূত্রে হোক আর যাইহোক এইরকম একটা অনুভূতির প্রতিফলন স্বাভাবিকভাবেই আমাদের সঙ্গে মিলিত হয়েই আছে। আমাদের ভাবনায়, চলনে-- যাই বলি না কেন। তাই যখন যুগ পেরিয়ে, সময় ভেঙে মুখোমুখি দাঁড়াই, দেখি, এখানে আজ  এতদূর পৌঁছেও  একজন কবির একান্ত লালন করা অক্ষরগুলি উচ্চারণ করছে নিজস্ব ক্ষত, নিজস্ব আবেগ, অসংখ্য সমর্পণ আর তৃষ্ণার্ত নিজত্বের খোঁজ। বিস্মিত হতে হয়। অথবা ভেবে নিতে হয় সময়ই শুধু পাল্টায় আর কিছু না। কবিতা কী তবে প্রকৃত আয়না? ভুল বললাম, আয়নাও মিথ্যে বলে। অথচ, কবিতার কাছে আছে সমর্পণ; আত্মার প্রকাশ। সবকিছু খুলে বলা যায় তাকে। যে কথা গোপনতর, বেদনায় ঢাকা, হৃদয়ের জ্বলন্ত লাভার স্রোত কিংবা ক্ষত,দহন, পীড়ন সবকিছুই ধারন করতে সক্ষম সে। কেননা, 

"
রাত্রিডাক শুনতে পাচ্ছি। ওই শোনো রাত্রির উদ্যানে
একেলা কোকিল ডাকে। কবিতা তো বোঝার শিল্প না।

কবিতা খোঁজার শিল্প। যার কোনও পরিত্রাণ নেই
যার কোনও প্রেম নেই রতি নেই অনুভব নেই
সেই যায় কবিতায়, ক্ষতমুখে তুলো চেপে ধরে
তুলোটে কাগজে ফোটে রক্তের অক্ষরসমূহ।

কবিতা খোঁজার শিল্প। তার কোনও পরিত্রাণ নেই।" ( "কবিতার কথা")

রাত্রিডাক! চারপাশে ছড়িয়ে থাকা নিজের খণ্ড খণ্ড অস্তিত্ব? কবি খুঁজতে বেরিয়েছেন? হতাশ হচ্ছেন কিন্তু আশাও ছাড়েন নি। দূরে তাই ব্যঞ্জনাময় কোকিলের ডাক। দূরে তাই ভোরের ইঙ্গিত। এই সমাজ ভেঙে, সংসার ছেড়ে নিজের খননকার্য। আর তারপরেই তো কবিতা উঠে আসে। আলোকিত হয় আত্মা। কবিতারূপী আত্মাটিকে তখনই কবি খুঁজে পান। রতি নেই, অনুভব নেই, প্রেমও নেই। নিস্পৃহভাবে খোঁজ, নিস্পৃহতার চরমে অবস্থান করার পরেই কবি আঁকতে সক্ষম হন তার ক্ষত চিহ্ন গুলিকে। জ্বলজ্বল করে ওঠে। সাদা তুলোট কাগজ বহন করে ক্ষতের চিহ্নগুলি রক্তাক্ত অক্ষর। এখানে তুলোট কাগজের ব্যবহারটাও লক্ষনীয়। স্থায়ী। এমন এক কাগজে রক্তের দাগ অর্থাৎ ক্ষতের অক্ষরগুলি চিরস্থায়ী।

দেখা যাচ্ছে, কবিতা মানেই সমাজের একটা রূপ। যেখানে পাওয়া যাচ্ছে বাস্তব আর মনের ভেতর কবির আকাঙ্খার সংমিশ্রণ। যশোধরা রায় চৌধুরীর কবিতায় এই দিকটি নিমর্ম সত্য রূপে আমরা পাই। কবি কখনোই, শুধুমাত্র কল্পনার স্রোতে ভাসেন না। একদিকে যেমনভাবে তাঁর অক্ষরে ফুটে ওঠে কৌতুক, রঙ্গবোধ তেমনি সমাজের বাস্তববাদ; নারীর মনস্তাত্ত্বিক দিক। আর কবি এখানে কখনও ছোট্ট খুকীটির মত অভিমানী অথবা প্রৌঢ় মায়ের ভূমিকায়। এক লহমায় ছিঁড়ে ফেলছেন সমস্ত অপমানের, লাঞ্ছনার ক্ষত। আবার আঁকড়ে ফিরছেন ঘরে, মায়ার কোলে।

"তোমাদের হেলাফেলা ভুলে গেছি
তোমাদের দুর্ব্যবহার পেরিয়ে এসেছি
তোমাদের সবার অতিকায় না দেখতে পাওয়া, না শুনতে পাওয়া
ধামাচাপাগুলো
একটু একটু করে হেঁটে হেঁটে
শেষ করে এসেছি।
একাকী বসার দিন বসেছি
একাকী গাওয়ার দিন গেয়েছি
পিঠময় ব্যথা একা একা সেও সমঝে ফেলেছি।
বারান্দায় ভিজে ছাতা মেলে দিয়েছি।
সব ভাল খবরের তলানি পান করেছি।
এখন আর অন্যদের জীবনের দুঃসংবাদে
ম্রিয়মাণ হওয়া মানায় না।
কাজ করতে হবে, কাজ করতে হবে।
রোগে শোকে ক্ষয়ে যাতনায় কাজ করতে হবে।
ভাল থাকতে হবে। …( বেদনার সন্ধে)"

 এই পেরিয়ে আসাটাই সাধনা। এই ভাঙনটা একটা নারীর একান্ত ব্যক্তিগত। সারাজীবন চেষ্টা করে পেরিয়ে যাওয়ার-- হয়না! ছোটবেলায় মাকে দেখেছি, আমরা ভাইবোনেরা যখন খুব বিরক্ত করতাম, মা চুপ হয়ে যেত। রেগে বলত "চলে যাবো!" কিন্তু কত যুগ পেরিয়ে দেখি মা সেখানেই আছে। কোথাও যায়নি। গান নেই, কবিতা নেই, মায়ের জীবন থেকে বেরিয়ে গেছে বায়োলজির সমস্ত ডেটা; রশিদ খান এমনকি সুমনও বেরিয়ে যাচ্ছেন মায়ের কাছ থেকে কিন্তু মা নিজে আর যেতে পারেনি। এক জায়গায় স্থির, অবিচল। বেদনা কী তবে মুক্তি দেয়? নতজানু হতে শেখায়? নাকি দাসী? ক্রীতদাসী? নাকি প্রকৃত দর্শন? বেদনা তো নির্মম ভাবে মৃত্যুর দোসর। যদিও ' জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যু'-- কিন্তু ক্ষতের কাছে কবি নিজেকে নতুন করে খুঁজে পেয়েছেন সেই প্রকৃত দর্শনকে। তখন তাঁর কাছে ' ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ'। আলো আছে, আলো আছে--- চিৎকার করে উঠছে তাঁর ষোড়শী সত্ত্বা। এই চিরন্তন সত্যের কাছে থেকে তিনি আবৃত্তি করে ওঠেন--

"   Into this universe, and why not knowing
Not whence, like Water willy- nilly flowing:
And out of it, as Wind along the Waste ,
I know not whither, willy-nilly blowing."(29)--- ফিটজেরাল্ড


অনিঃশেষ রূপকল্পের কাছে এসে, বসে থাকি অসহায়।
ওদিকে আলো করে সূর্য ওঠে,
এদিকে নিবিড় করে রাত হয়।
তার মধ্যে আমরা ক্ষুব্ধ ছোট ছোট বাক্যে
লিখে চলছি আমাদের জীবিতের শুষ্ক অন্ন
জল দিয়ে খেয়ে ফেলার কথা।
……………
মেঘের মন্দির থেকে একটু একটু করে ঝরে পড়ছে রঙ।
আর আমরা বাষ্পের মতো
কেটলির মতো
আগুনের মধ্যে পটপট করে পুড়ে যাওয়া ভুট্টার মতো
একটু একটু করে জ্বলছি ধুঁয়োচ্ছি
আর লিখে রাখছি সমসাময়িক।"


চার্বাক দর্শন বলছে- 'ভস্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনং কুতঃ'--- একবার মৃত্যু হলে ফেরা যায়না কখনও। নেগেটিভ মুহূর্তের প্রতিফলন। যেখানে ফেরা নেই, সেখানে মায়াও নেই। আমি আছি কিন্তু আংশিকভাবে। তাই 'যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ......"। গ্রীক দর্শনও তাই বলে-- ইন্দ্রিয় সুখভোগই শেষ কথা। কিন্তু কবি এখানে স্থির। ক্ষতের কাছে, বেদনার কাছে থেকে তিনি উপলব্ধি করছেন কবিতা রূপী আত্মাকে। সত্যকে। আলোকিত পথের দিকে হাঁটাপথ খুঁজে চলেছেন তিনি। বিসর্জন শেখেননি তিনি; বরং সৃজনের কাছে তুলে ধরছেন তাঁর মর্ম স্পর্শী অক্ষরমালাকে।  মায়াকে ভালোবাসেন তিনি। সংসার সত্য। জীবন সত্য। তাই তাঁর কাছে সমস্ত কষ্ট সন্ধের উপপ্রান্তে এসে হাজির হয়। যার একটু পরেই ভোর। আলো। " আত্মদীপ হয়ে উঠে তোমাকে তো যেতে হবে ঘুটঘুটে আন্ধারে"( আলো)।

"আলো

 আত্মদীপ হয়ে ওঠ। আর পায়ে পায়ে যাও অন্ধকারে, নিশ্চিন্তি-গুহায়

যেখানে জ্বালাতে হবে। বেদনা জ্বালাতে হবে। গুহাগাত্রে হাতের ছাপ

                                                                     রক্তমাখা, কার?

সেই সে দেওয়ালচিত্র দেখতে গিয়ে হয়েছ মশাল

…………



আত্মদীপ হয়ে উঠে তোমাকে তো যেতে হবে ঘুটঘুটে আন্ধারে

সঙ্গে মশাল নেই, সঙ্গে জ্বালানি নেই, জ্বালানির কথা তুমি ভেবেছ!

                                                              এক্ষুনি ভুলে যাও।"

এই ভুলে যাওয়া আসলে সমাজের সঙ্গে একটা সামঞ্জস্য খুঁজে নেওয়া। দেখে নেওয়া প্রকৃত সত্যকে যাকে খুঁজে ফেরা সে আসলে এই অন্ধকার কুঠুরিতেই। মশাল আর কতটুকু বা আলো আনতে পারে! কতটুকু দেখাতে পারে নির্মম সহজকে। যৌক্তিক সত্য কিছু মশালের তীক্ষ্ণ আলোয় খুঁজে পাওয়া গেলেও সমাজের প্রকৃত আলোক শিখা তো সমাজের মনে। তাকে জ্বালানোর জন্য প্রয়োজন এই 'ঘুটঘুটে অন্ধকার'।



ইতিকথা



……

সম্বৎসরের লাল পাড়, কাপড়ের স্তূপে চুপ

বসে থাকা গাঁটরি বাঁধা বালকের পূজায় উন্মুখ

চক্ষুদুটি। পদপ্রান্তে পড়ে থাকা আঁচলের গিঁট

কুয়াশা ছলাত শব্দ, কালো পাত্রে পিঠে পড়ছে, তেল ছিটছিট।



কালপাত্রে নিবু নিবু দীপ জ্বেলে অতিকায় নেমে আসা রাত

সুনিশ্চিন্ত তুলসীমূলে আকণ্ঠ সে প্রণাম, ও ডুবে যাওয়া ঝপাত ঝপাত।"

ইতিকথা? 'ক্ষত' কাব্যগ্রন্থটিতে কিছু কবিতা ন্যারোটিভধর্মী। কবি যশোধরা রায়চৌধুরী তাঁর কবিতাকে শুধু কল্পনার ফ্রেমে বন্দি করেননি, বাস্তব জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ করে তুলেছেন। পৌরুষতান্ত্রিক সমাজে এখনও যে নারী সম্বৎসরের লাল পাড়ে বসে থাকে-- কিন্তু এখানে নারীটি নিজেই এই অবস্থানের জন্য দায়ী। বেরোতে পারেনি, বেরোতে চায়নি বলেই। কারণ এই একবিংশ শতাব্দীতেও সে ভেবেছে সুনিশ্চিত আশ্রয়। ভেবে নেয় কাপড়ের স্তূপেই তার জন্মমরণ। বাঁধা তুলসীমঞ্চ। আর আরও ডুবে যাওয়া অতল দাসত্বে। ক্ষতে।

 "ক্ষত" বর্তমান সময়ের, সমাজের প্রকৃত ফলক। প্রতিটি কবিতাই উঠে এসেছে প্রকৃত আত্মখনন থেকে। উপলব্ধির উপর নির্ভর করে। অহং অস্মি বোধ। সমসময়ের মধ্যে এক চিরকালীন সময়। সমাজের দুর্নীতি, ভণ্ডতা, আবেগহীন বাস্তবতা যুগ যুগ ধরে যেভাবে চলে আসছে; তেমনই চলছে। কবিও যেন এখানে উদাসীন, নিস্পৃহ। ঠিক যেন ওই ক্যান্সার রোগীকে যে ডাক্তারবাবুটি দেখেন; তাঁর মতো। বুঝতে পারছেন, রোগী আর কিছুকাল, রোগ ছড়িয়ে পড়েছে বহুদূর। মৃত্যু শিয়রে। উপশমের কোনও লক্ষণ নেই। কিন্তু ওই রোগীকে ঘিরেই তাঁর ডাক্তারি পেশার যাত্রাপথ। ঔদাসীন্য নয়, আশাও নেই! যা আছে তাই নিয়ে কিছুকাল চলা। কবি যশোধরার কবিতায় আগে আমরা পেয়েছি নারীদের কষ্ট-যন্ত্রনা। বেদনা। হাহাকার। আর তার থেকে মুক্তির আপ্রাণ চেষ্টা। কিন্তু "ক্ষত" কাব্যগ্রন্থটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানেও জ্বালা আছে, যন্ত্রণা আছে, বেদনা-অপমান-কষ্ট; কিন্তু বেরোনোর আকুলতা নেই। থেমে থাকাও নেই। বরং কবি সেই আত্মদীপের খোঁজে শুধু নিস্পৃহ ভঙ্গিতে হেঁটে চলেছেন, পা রেখেছেন জমাট অন্ধকারে। সব থাক, সবকিছুর মধ্য থেকে বরং খুঁজে দেখি নিজেকে।  দেখা যাচ্ছে, কাল, যুগপ্রবাহ ভেঙে, মানসিক আবেগ, আঘাত পেরিয়ে চিরন্তন এক যাত্রাপথে সামিল হয়েছে "ক্ষত"-এর কবিতারা। বর্তমান সময়ের প্রকৃত যাত্রাকে তুলে ধরেছে, যা এই সময়ে খুবই প্রাসঙ্গিক।




দুই।

বর্তমান সমাজ একটা পলিটিক্যাল সার্কেলের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। জয়ের  জন্য, জেতার জন্য-- অবস্থা বুঝে ব্যবস্থিত হচ্ছে সবকিছু। আর তাতে যা হচ্ছে অর্থনীতিকে, কালচার এমনকি মনুষ্যত্বকেও বামাডোলে ফেলা। হিংস্রতা যেমন বাড়ছে তেমন নিজস্ব বুদ্ধিবোধ, ভাবনা চিন্তা স্রেফ ব্যক্তিগত পর্যায়ে পড়ে থাকছে। মূল্যের মূল্যায়ন তাই আজ শুধু মাত্র বিড়ম্বনা মাত্র। কিন্তু এই পলিটিক্যাল সার্কেল ব্যাপারটা খুব অন্যরকম বিশেষত ভারতে। জেতা আর জয়ীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। সাধারণ মানুষ শুধু ভোগে। ভোগ করতে পায়না। ঠিক যেন চোখের সামনে আঙুরের গুচ্ছ তুলে ধরা হয়েছে। দেখো। হাসিলের চেষ্টা করতে করতে দিনরাত কাটাও। অথচ, নাগাল পাবেনা কোনমতেই। উন্নত মস্তিষ্কের কার্যকারণ পদ্ধতি। জয়ের পদ্ধতি। আর যেহেতু সাহিত্যটা সমাজের বাস্তবচিত্র তাই এর প্রভাব গাঢ় ভাবে পড়ে তার ওপর । কার্য আর কারণ এখানে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বলে রাজনীতির সূক্ষ্ম কৌশল জনগনের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এর প্রভাব পড়ে দেশের অর্থনৈতিক ভিতের ওপরে। আর এটা বোঝা যায় যখন অন্য সরকারের মাথায় হাত। লুটেপুটে নিয়ে কেটে পড়া সরকার ততদিনে পগারপার। বিশেষত দেখা যায় আমাদের দেশে বাজেট পদ্ধতিটাও একটা পলিটিক্যাল স্টেপ। সরকারের রোজনামচা পাবলিকলি দেখানোর উত্তম প্রয়াস। যাতে দেখা যায়, কিছু করি না করি একগাদা, গাদাগুচ্ছের প্রকল্প তুলে ধরতে পারি। বলার সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারি । তখন সাধারণ মানুষদের 'অচ্ছেদিনের' ভাবনায় ঢুকিয়ে দিয়ে; নিজস্ব কাজ হাসিল করে কেটে পড়। সাধারণ মানুষের তখন হাত কামড়ানো ছাড়া কিছু থাকে না। আর তখনই দরকার পড়ে বাস্তব আর কল্পনার দুটি চোখকে বাদ দিয়ে 'তৃতীয় নয়নে জাগো' অর্থাৎ জাগার ব্যাপারটিকে। কার জাগা? কীভাবে? কেন? নিজেকে জাগাও! অনুভব করো। সত্য মিথ্যা যাচাই করো। আর সেটি সম্ভব মস্তিষ্কের দ্বারা। তাই কী তৃতীয় চোখ! প্রাচ্য পুরাণ বারবার গুরুত্ব সহকারে সমস্যার সমাধান হিসেবে 'ধ্যান'( meditation) টিকে তুলে ধরেছে। আত্মোপলদ্ধি। কেননা--

 " এলোমেলো হারিয়ে যাচ্ছ তুমি
লেগে আছে দাগ
মাটিতে ঘষটে টেনে নিয়ে যাওয়ার
এই দাগ ধুয়ে যায় না
আরও চেপে বসে
যতদিন না
তুমি প্রশ্ন করছ
নিজেকেই
যতদিন না, তুমি ঘুরে দাঁড়াচ্ছ
নিজের বিরুদ্ধে।" ( লাশ)

---ততদিন মৃত হয়ে থাকবে এই শহর। সমাজ। জাগো আর জাগো। অংশত দৃশ্য বস্তু সবটাই সঠিক নয়। আবার কল্পনাটাও বাড়াবাড়ি ধরণের বোকামি। তখন স্থির ধৈর্য সহকারে বিবেক মূল্যবোধ কে জাগরণের দরকার হয়ে পড়ে। এই একবিংশ শতাব্দীর ভারতে আজ সেই জাগরণ অর্থাৎ নিরপেক্ষ তৃতীয় চোখটির খুব প্রয়োজন। জনগণকে জাগৃত করা অথবা নিজে বুঝে নেওয়া। সমাজকে জানা। নিজেদের অবস্থানের মুখোমুখি হওয়া।

"প্যাস্টেল রঙের শহর, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, বিশ্বাস করতেও
তুমি তার মধ্যে একা দাঁড়িয়ে রয়েছ অপেক্ষায়
দিন বদল হবে, ভালোবাসা আসবে আবার, নিহত হবে না আর গাছ..."( নেমেসিস)

এই আশা করে বসে থাকা অনন্তের দিকে তাকিয়ে। আসবে। আসবে? আসবে! শিওর নই। আবার অবিশ্বাসও দৃঢ় নয়। প্রতিটি ভোটদানের মুহূর্তে, একটি নতুন সরকারকে ঘিরে এইযে পলিটিক্যাল ভিউ গড়ে ওঠে মানুষের মধ্যে-- তিন প্রকারের; আসবে। আসবে! আসবে? শুধু রাজনীতির ক্ষেত্রে নয়। সমাজ, সংসার জীবনেও। স্বাভাবিকভাবেই অপেক্ষা ব্যর্থ হবে। মানুষের মধ্যে বড্ড অভাব যে আজকাল তৃতীয় নয়নের।

কবি দুটি কবিতাতে তুলে ধরছেন ছাপান্ন ভোগের কথা। শ্রীক্ষেত্রে জগন্নাথদেবের ভোগ রান্না হয়। ছাপান্নটি পদ। বিভিন্ন নৈবেদ্য, উপাচারে। একটা বিরাট মিথ।  'ভোগ' কবিতাটিতে দেখা যাচ্ছে ছাপান্ন ভোগের পরে সেই সাধক বিশ্রাম নিচ্ছেন। নিশ্চিন্ত। পৃথিবী তখন শান্ত। তাই নগরকীর্তন অংশ নিয়েছেন নগরবাসী। সাধারণ মানুষ। কেননা, পাবলিকও নিশ্চিন্ত। পুরুষোত্তম তাকিয়ে আছেন তাদের দিকে। ভয় নেই। তারপরেই দেখি 'মাথায় শকুন উড়ছে' মানে অশুভ আবার অরাজকতা। অথচ পুরুষোত্তম নিদ্রায়। সাধারণ মানুষ অসহায়। এরপরের কবিতাগুলিতে সেই অস্থির দোলাচল সময়টি ফুটে উঠেছে। একে একে উঠে এসেছে 'ত্যাগ' 'অহিংসা' 'জন্মভূমি'র খোঁজ। নিজেকে জাগানো। মূল্যায়ন নিজের সঙ্গে নিজের। এবং শেষ কবিতা ' আনন্দ' তে দেখা যাচ্ছে দীর্ঘ অবসরে কবি ক্লান্ত। নিজেকে সমর্পণ করেছেন 'পরিবার থেকে দূরে, সেভাবে সকলে সরে যায়।/ এও তো কাছেই আসা, সব ঘাটের জল খেয়ে/ নদী যেরকম যায় মোহানায় ফিরে/ ছাপান্ন ভোগের রান্না প্রস্তুত হয়েছে'। ঠিক যেভাবে দীর্ঘ দুর্যোগের পর ব্রজবাসীদের মতো ছাপান্নটি পদ রান্না করে নৈবেদ্য হিসাবে দিতে চান স্বয়ং উদ্ধারকর্তাকে।

" হে পুরুষোত্তম, তুমি ঝাঁপিয়ে পড়েছ ঝড় হয়ে

তোমার পায়ের কাছে তুমি নিজে কেন
অবিশ্বাসী মানুষের কান্না হয়ে যাও?
এও  কি তোমার ইচ্ছা? সংশয় যখন
তোমার নীরবতায় চিৎকার ভীষণ?"

দেখা যাচ্ছে তৃতীয় পুরুষ হিসেবে কবি যে পুরুষোত্তম কে কল্পনা করেছেন তিনি কী সত্যি এক পলিটিক্যাল লিডার নাকি কোনও ধর্মগুরু! এখানে যদি আমরা ভাবি ধর্ম মানে বাঁচাবাড়ার একটা স্টেপ, তবেই কিন্তু সঠিক ভাবে কবিতাটিকে বোঝা যাচ্ছে। পুরুষ উত্তম তখনই হয়, যখন সমস্ত মূল্যবোধ, দয়া বাৎসল্য সহকারে বাঁচাটা কে বিস্তৃতের দিকে নিয়ে যায়। কবিও তাই চান। বোধহয়। তাই পুরুষোত্তম রূপে ভেবে নেওয়া সেই অসীম অদৃশ্য অথচ সত্যের সাধককে ভেবেছেন বারবার। অথচ, সেই সত্য সাধক কে? রাজনৈতিক নেতা? ধর্মগুরু? কবি? কলম? লেখক? নাকি ভারতীয় কৃষ্টি, সংস্কৃতির ধারক বাহক? যুগ ভেঙে, গতানুগতিক দুরাচার ভেঙে যিনি এগিয়ে আসেন বারবার? সাধারণ অথচ অসাধারণ সেই নেতা? যাকে হৃদয় আপন থেকে বশ্যতা শেখায়! নাকি স্রেফ আমি? এবং আমি এবং আমি! অহং অস্মি! কবিতা গুলিতে এই ভাবনাটির প্রকাশ বারবার মুগ্ধ করেছে।

"ধ্বংসস্তুপের মধ্যে হাওয়া ঘোরে, হাওয়া জন্ম নেয়
আমার বিষাদটুকু ধুয়ে যায় বালির ভিতর
এই তবে লেখা ছিল সাধনায়? নশ্বর জীবন
ধ্বনি আর প্রতিধ্বনি হয়ে থাকে পাথরে পাথরে" ( সূর্যমন্দির)

এখানে কবি যেন ভ্রমণে বেরিয়েছেন। চারপাশে ছড়িয়ে আছে মৃতের খুলি। ধ্বংসস্তুপ। সূর্যমন্দির। আলো হারিয়ে যাওয়া সেই কোনারকের ভাঙা অপবিত্র মন্দিরের ছবিটি ভেসে ওঠে আমাদের চোখে। যেন বহুকালের রক্তস্রোত উঠে এসেছে তাঁর সামনে। সেই যুদ্ধ ক্ষেত্র। অশ্বক্ষুরের শব্দ। ফিসফিস ষড়যন্ত্রের শব্দ।

'আমার বিষাদটুকু ধুয়ে যায় বালির ভিতর'

কোনারক সূর্যমন্দির থেকে পাঁচ ছয় কিলোমিটার দূরে রামচন্ডী মন্দির। তার পাশেই বিখ্যাত সেই কুরুক গ্রাম। চোরাবালির গহ্বর। শোনা যায় সমুদ্র গুপ্ত পুরী সাম্রাজ্য দখল করতে এলে, এই চোরাবালির গহ্বরে হাজার হাজার সৈন্য তলিয়ে যায়। কবিও আজ তার সমস্ত বিষাদকে তলিয়ে দিতে চান ওই নশ্বর বালিঘরে। মুক্তি তবেই আসান হবে যেন। 'তৃতীয় নয়নে জাগো' র প্রতিটি কবিতাই ধর্ম, রাজনীতি, মূল্যবোধ, বিবেকের এর নিরলস খোঁজ। আর কবি এখানে অক্লান্ত। প্রতিটি কবিতায় তাই ফুটে এসেছে। পুরীর চারপাশে কবি কাকে খুঁজছেন? ওই মিথ পুরুষকে? যিনি একমাত্র এই অধঃপতন সমাজকে রক্ষা করতে পারেন! নাকি ক্লান্ত কবি নিজেকে খুঁজে ফিরছেন মুক্তির আলোকে; ভিড়ের মধ্য থেকে!

প্রকৃতির সঙ্গে দর্শকের, দর্শনের সঙ্গে আত্মা তথা মনের, মনের সঙ্গে কুটনীতিজ্ঞ এক মেলবন্ধন যেন 'তৃতীয় নয়নে জাগো'-র কবিতাগুলি। আশ্চর্য এক সুন্দর পথের ম্যাপ তুলে ধরেন কবি; পরমুহূর্তে দেখেন 'অন্ধকার অবয়ব ছুঁয়ে ছুঁয়ে এই বেঁচে থাকা-'। যুদ্ধই নিয়তি ভেবে নিজেকে সাজান। আদেশ করেন

"এখনও সময় আছে, ওঠো;
তৃতীয় নয়নে জাগো, জাগাও আমায়।"

 এই যুদ্ধ ধর্মের। সত্যের। বাঁচা বাড়ার। এগোনোর। ওই আলোর দিকে-- সুন্দরের দিকে। যেভাবে শস্য জেগে ওঠে, নতুন পৃথিবীতে নেমে আসে আলোকস্তম্ভের ভোর। ধর্মের( এখানে ধর্ম মানে কোনও সম্প্রদায় নয়; মনুষ্যত্ববোধ; মানুষ ধর্ম) কাছে নিজেকে সমর্পণ।  'হাতড়ে' চলতে চলতে এগোনো। নিজেকে প্রকাশ। পুরুষ উত্তম রূপে। কাব্যগ্রন্থটি পড়তে পড়তে নিজের ভেতরে একটা শক্তি অনুভব করতে পারছিলাম। বারবার মনে হচ্ছিল সময় হয়েছে এবার। সমস্ত মিথ্যের যাপন ভেঙে, ভুলভ্রান্তি ছেড়ে, 'কাঁটাতার নয়' ওই 'প্রকৃত দেশের কাছে আমাদের চলে যেতে হবে'। আর তখনই 'তোমার আমার মধ্যে যেখানে দেবতা নেমে আসে'। তাই কবি বিভাব কবিতাটিতে আপন মনে বলে ওঠেন ' যে সুর, সে নিজেই বাজনা, চিরদিন অপেক্ষা তাদের'। কবি প্রাধান্য দেন কর্মকে। শ্রমকে। তাই তিনি তাঁর 'ধর্ম' কবিতাটিতে ফুটিয়ে তুলছেন এক গৃহস্থের চিত্র। সংসার। অসংখ্য কাজ। আর এক গভীর নিষ্ঠায় চলছে এই যাপন। 'হাঁড়ি-ডিঙি থালা-বাটি হাতায় চামচে।'

তাই কাব্যগ্রন্থটি জুড়ে 'তৃতীয় নয়নে জাগো' মানে তিনটি নয়নে জাগা বলা যেতে পারে। একটি চোখ সমাজ-রাজনীতি, অন্যটি সংসার-সম্পর্ক এবং মোক্ষ চোখটির ধর্ম মনুষ্যত্ববোধকে জাগিয়ে তোলা। অহং অস্মি। আমি আছি। আমার সর্বস্ব নিয়ে আমি আছি। নিজেকে জয়। জিজ্ঞাসা। অসীমতার দিকে নিয়ে যাওয়া। সিক্ততায় তাই মন বারবার আবৃত্তি করে ওঠে,

"শ্রাবণ অঝোরে ঝরে তোমার ভিতরে
আমিও সামান্য ভিজি-- যেরকম মাটি ভিজে যায়
এ জীবন বৃথা হতে হতেও হল না ভেবে
তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে দেখি
                     আপলক, একা।

আরও বৃষ্টি হোক, জল, উঠে এসো বিপদসীমায়। "


কাব্যগ্রন্থ- ক্ষত  / যশোধরা রায়চৌধুরী / প্রকাশকঃ  কাগজের ঠোঙা

কাব্যগ্রন্থ- তৃতীয় নয়নে জাগো /হিন্দোল ভট্টাচার্য /প্রকাশক: ভাষালিপি

No comments:

Post a Comment