Sunday 18 March 2018

দেবব্রত শ্যাম রায়

শ্বাসপ্রশ্বাসের গ্রাফশীট 




সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় একদা ঘোষণা করেছিলেন 'আপনাদের যাঁদের গল্পটা ভালো লাগল তাঁরা অনুগ্রহ করে আমাকেও ভালোবাসুন, কেননা, আমি ও আমার গল্প একই'। কথাটা ভাববার মতো। একজন লেখকের নিজের রক্তমাংসের মুখটাকে পাঠকের কাছে চেনানোর জন্য এই আকুতি কেন? অন্যদিকে, একবার সৃষ্টি হয়ে যাবার পর, গল্প উপন্যাস বা কবিতা তো এক-একটি স্বতন্ত্র সত্ত্বা যারা নিজেরাই শ্বাস নেয়, সৃষ্টির রসের স্বাদ নেবার জন্য গল্পকার বা কবির জীবনের সাথে তার যোগ খুঁজতে যাবার কোনও দরকার আছে কি? প্রশ্নটি বহু আলোচিত ও অমীমাংসিত। তাছাড়া এর উত্তর খোঁজার রাস্তাটাও বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। যেমন, জার্মান ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি রিলকে তাঁর সঙ্গিনীকে নিয়মিত নির্যাতন করতেন, এমনকি সিগারেটের ছ্যাঁকাও দিতেন, এইসব জানার আগে ও পরে তাঁর লেখা ভুবনবিখ্যাত 'ডুইনো এলিজি' পড়ার ক্ষেত্রে আগ্রহের কোনও তফাত হবে না কি? এসব সত্ত্বেও সারা দুনিয়ার পাঠক যুগে যুগে তাদের প্রিয় কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীর সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে মিলিয়ে পড়তে চান স্রষ্টার জীবনটাকে, জানতে চান তাঁর সময়কে। হাতে তুলে নেন স্রষ্টার জীবনী, আত্মজীবনী, স্মৃতিচারণ, সাক্ষাৎকার এমনকি ডায়েরিও। এগুলোর মধ্যে ডায়েরি-ই সম্ভবত সেই নিভৃততম লেখ, যেখানে পাঠক কোনওদিন পড়বেন এই আশা না রেখে একলা ঘরে বসে লেখক নিজের কাছে উন্মুক্ত করেন নিজের আত্মাকে। নাকি ভুল বললাম? তাঁর মনে কি আশা থাকে অন্তত কেউ একজন পড়বেন এই লেখা, না হলে এইভাবে দিনের পর দিন লিখে যাওয়ার মানেটাই বা কী? হাতে এল তেমনি একটি ডায়েরি। ডায়েরি প্রথম এন্ট্রির তারিখ ৭/১২/৮৬, সন্ধ্যা ৮.২০ মিনিট। এন্ট্রিটির অংশবিশেষ এইরকম -

'আমি জানি যে পৃথিবীর গোপনতম ডাইরীটিও (যদি তা কালগ্রাসে পতিত না হয়) তার লেখক ছাড়া
  অন্তত একজন কেউ পড়েই। অনেক সময় একাধিক জন। কখনো পাঠকেরা, কখনো স্ত্রী বা পুত্রকন্যা বা একান্ত বান্ধব। রোজনামচার একনিষ্ঠা একটা বাজে কথা। বাস্তবে হয় না। আর, সত্যি সত্যিই যদি জানতাম যে আর কেউ কোনওদিন পড়বে না আমার ডাইরী, যদি পেতাম এই নিশ্চিতি, তবে বোধহয় লেখার ইচ্ছে থাকত না। আরও হাস্যকর এই দ্বন্দ্ব। কি বলা যাবে একে? প্রকাশের ইচ্ছা না দুরারোগ্য নার্সিসিজম্?' (৭/১২/৮৬)

প্রকাশের ইচ্ছা বা নার্সিসিজম যাই হোক না কেন, এভাবেই শুরু হচ্ছে বাংলাভাষার এক গুরুত্বপূর্ণ কবি জয়দেব বসুর
(১৯৬২-২০১২) দিনলিপি। রুলটানা 'বঙ্গলিপি' খাতায় ১৯৮৬ থেকে শুরু করে ২০০৫ অবধি অনিয়মিতভাবে হলেও জয়দেব লিখে গেছেন তার এই 'শ্বাসপ্রশ্বাসের গ্রাফশীট'। আর আমরা ছুঁতে পারছি এই বিশ বছরের জীবনপর্বে তাঁর ব্যক্তিগত ওঠাপড়ার ইতিহাস, বিভিন্ন ইস্যুতে তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান, সিপিআইএম একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে পার্টির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের টানাপোড়েন, তাঁর প্রেম, হতাশা, সাহিত্যবিচার, আরও অনেক কিছু।

এক সমাজ-সচেতন, মানবিক, ও সংবেদনশীল মানুষের ঠিক যেমনটি হওয়া উচিত, নানা বিষয় নিয়ে নিয়ত ভেবেছেন জয়দেব। যেমন ডায়েরির একদিনের এন্ট্রিতে উঠে এসেছে রবীন্দ্র-পরবর্তী কবিদের রবীন্দ্র বিরোধীতার প্রসঙ্গ, এবং এইভাবে পূর্বসূরিকে একইসঙ্গে গ্রহণ ও অস্বীকার করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার যুগধর্ম। আবার নিজেই প্রশ্ন তুলেছেন- 'বিরোধিতা কি করতেই হবে? করেছেন কি রবীন্দ্রনাথ? বিপরীতবিহারী তো তাঁকে হতে দেখিনি একবারও। অবশ্য জানি না তাঁর জীবনের সবটা, শঙখবাবু হয়তো জানিয়ে দেবেন যে বিহারীবিরুদ্ধ হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ কখনো।' (৮/১২/৮৬)

আমরা দেখতে পাই রবীন্দ্র-প্রসঙ্গে জয়দেবের মতামত খোলামেলা, বুদ্ধিগ্রাহ্য। যে কমিউনিস্টরা দীর্ঘদিন রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে কোনও সম্মানজনক অবস্থান নিতে পারেননি, জয়দেব আমৃত্যু সেই কমিউনিস্ট পার্টির একনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন, এতটাই একনিষ্ঠ যে নন্দীগ্রাম-পরবর্তী সময়ে নিজের নাম লিখতেন 'জয়দেব হার্মাদ বসু', কিন্তু তাঁর মধ্যে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কোনও জড়তা দেখতে পাই না। অবশ্য এটাও মনে রাখতে হবে, জয়দেব যে সময়ে কবিতা লিখছেন বা সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দিতে এসেছেন, সেটা আটের দশক, অর্থাৎ তীব্র রবীন্দ্রবিরোধের জায়গা থেকে পার্টি ততদিনে সরে এসেছে।
অবশ্য এটাও নয় যে পার্টির সমস্ত মত, কার্যকলাপ, লাইন একবাক্যে স্বীকার করে নিচ্ছেন জয়দেব। পার্টির আভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীদ্বন্দ্বও ওঠে আসছে তাঁর ডায়েরির পাতায়। 'আরও একটি মৃত্যু। আরো একজন কমরেড। এবার এই শহরেই, যাদবপুরে, যক্ষা হাসপাতালের চৌহদ্দিতে।... কমরেড 'প' যে এর পিছনে আছেন, সেটা বোঝাই যাচ্ছিল। কিন্তু নাটের গুরু যে আসলে কমরেড 'ম', এটা জেনে সত্যি সত্যি হতবাক হয়ে গেছি।' (১০/১২/৮৬)

কিন্তু এইসব বিচ্যুতি পার্টিকে ও কমিউনিস্ট আদর্শকে অফুরান ভালোবাসা থেকে তাঁকে একচুল সরাতে পারেনি।
 ২৯/০৩/৮৭ তারিখে তিনি উচ্ছসিত হয়ে লিখছেন-
'নির্বাচন হয়ে গেছে। বামফ্রন্ট ফিরে এসেছে আবার। অনেক বেশী সমর্থন নিয়ে। কংগ্রেসের আসন কমেছে। আমার পার্টেও ভোট বেড়েছে, জিতেছ বামফ্রন্ট, যদিও আসনটায় হেরেছে।

বামফ্রন্ট জিতেছে। মানুষই জিতিয়েছে। মানুষ মানুষ- শব্দটার অনেক অপব্যবহার হোলো এতদিন। আর নয়। স্নান, নিরাময়, লড়াই, শান্তি।

আজ বিজয় সমাবেশ ব্রিগেডে।

আমরা কমিউনিস্ট, আমাদের গোটা দেশে বিপ্লব করতে হবে, একথা যেন ভুলে না যাই।

আমি - আপাদমস্তক একজন ব্যর্থ মানুষ;  আমাকেও কমিউনিস্ট হয়ে উঠতে হবে। তবেই বিপ্লব সম্ভব।
(২৯।৩।৮৭)

অবশ্য পার্টির নেতৃত্ব ও নীতির সঙ্গে তাঁর টানাপোড়েন
  কোনওদিন শেষ হয়নি। আমরা বুঝতে পারি তাঁর রাজনৈতিক জীবন ঘোরতর সংকটে পৌঁছেছে, যখন তিনি লেখেন-

'বিলম্বিত হলেও জরুরী একটা কথা:

গত ১৬ ই ফেব্রুয়ারি পার্টি থেকে আমাকে ছয় মাসের জন্য সাসপেণ্ড করা হয়েছে। কারণ? ঘোষিত কারণ হল, নিষেধ অমান্য করে 'দেশ' পত্রিকায় লেখা। আর, আসল কারণটা নোংরা। সত্যি বলছি, পার্টির প্রতি অবশিষ্ট শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও আনুগত্য সহকারেই বলছি - এরকম নোংরা খেলা যে হয়, সেটা আগে শুধু শুনেইছি, এবার অভিজ্ঞতাও হল।

তাতে অবশ্য কুছ্ পরোয়া নেই। আগেকার মত দুবলা মানসিকতার ছেলে আর নই আমি। লড়াই জারি আছে। শেষ পর্যন্ত জারি থাকবে। পার্টি আমি ছাড়ছি না। অন্তত আগামী দু বছরের মধ্যে তো নয়ই। এর মধ্যে আমাকে ছাড়িয়ে দেওয়া হতে পারে, কিন্তু স্বেচ্ছায় আমি ছাড়ছি না।

চাকরিটা প্রায় ধাতস্থ হয়ে এসেছে। অবশ্য, শেষ পর্যন্ত যদি চাকরিটা থাকে, তবেই। ওই যে বললাম, নোংরা খেলা চলছে...। তবে হ্যাঁ, এটাও ঠিক, পার্টিতে আমি নিঃসঙ্গ নই, এটাই আশার। এছাড়া ব্যক্তিগত জীবনে আরো একটা সম্পর্ক শেষ হতে চলেছে। এতেও খুব বদনাম হবে শীঘ্রই। তাতেও পরোয়া নেই, লড়াই জারি আছে।

লেখাফেখা বিশেষ হচ্ছে না, যা হচ্ছে তাও অপাঠ্য। সেই ক্লিশে কথাটাই বলতে হচ্ছে আবার- লেখা আমার দ্বারা হবে না। তবে ছেড়েও দেব না এক্ষুনি। শেষ চেষ্টা করতেই হবে। লড়াই জারি আছে।

আমি বোধহয় অ্যালকোহলিক হয়ে যাচ্ছি। এটাই দুশ্চিন্তার। কারণ, এর বিরুদ্ধে যে লড়াই জারি আছে বিশেষ, এমনটা নয়।'(রাত ১২.২৪ মিনিট,  ৩/৩/৯২)


অবশ্য সাসপেনশন উঠে যাবার খবরটা নিয়ে দিচ্ছেন ডিসেম্বর মাসে। যেটা লক্ষণীয় যে এর মাঝে একটাও এন্ট্রি নেই। আরও বোঝা যায় যে ডিসেম্বরের এন্ট্রিটা শুধু সাসপেনশন ওঠার খবর দেওয়ার জন্য লিখতে বসেননি জয়দেব, আরও বৃহত্তর এক সংকট সম্ভাবনায় আঁতকে উঠেছেন তিনি। কারণ এর মাত্র চারদিন আগে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভাঙা হয়েছে।

'দেশজোড়া আগুন এখনো নেভেনি। কারফিউ জারি আছে এখানেও। গত রবিবার যখন বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা হচ্ছিল, তখন আমি ছিলাম শান্তিনিকেতনে। গতকাল ফিরেছি। ফিরতে পেরেছি, কারণ গুজবে কান দিইনি মোটেই। পার্টি অফিসে যেতে পারছি না। কারণ যানবাহন নেই। ফলে একটু নিজের কথা লেখা যাক।

সাসপেনশন উঠে গিয়ে সগৌরবে পার্টিতে ফিরেছি, সে কবে?... অগাস্ট মাসে বোধহয়। তার আগে একটা বে-আইনী শনি-মন্দির বানানো রুখতে গিয়ে আমাকে একটু বেশি রকমই মার খেতে হয়। তখনো আমি সাসপেণ্ডেড। তাতে কিছু আটকায়নি। পার্টির প্রতিক্রিয়া হয় দ্রুত এবং দুভাবে। লোকাল পার্টি (নিচু মহল) আমায় যারা মেরেছিল, তাদের আগলাবার প্রাণপণ চেষ্টা চালায় এবং রাজ্য পার্টি অপরাধীদের দেয় শাস্তি। স্থানীয় মাতব্বরেরা জিততে পারেনি শেষাবধি।
  তারপর আমাকেই এলাকার 'দাদা' করে তোলার চেষ্টা হয়েছে। আমি যে তা হতে পারিনি, সেটাকে নিজেরই অক্ষমতা বলতে হবে।।

ও হ্যাঁ, খোদা জব্ দেতা... সূত্র অনুযায়ী গত ২৩ শে নভেম্বর দমদম মতিঝিল কলেজে আমি অধ্যাপকের চাকরি পেয়েছি। এবং, গণশক্তি এবং নন্দন দুটো কাগজেই কবিতা দেখার দায়িত্ব।

এবং আরো একটি ঘটনা - যা প্রার্থিত সম্পর্কে পৌঁছলে, বলতে নেই দুশ্চিন্তাতেই পড়ে যাবো আমি। একটা মানুষ যা চেয়েছে, সবই পেয়ে গেলে সেটা দুশ্চিন্তার ব্যাপার হয় না?

খুব যে দুশ্চিন্তা হবে এমন নয়। কেননা, এত বছর চেষ্টা সত্ত্বেও লেখা আমার দ্বারা হচ্ছে না। এই আগুনের মধ্যে বসেও যদি লিখতে না পারি, তবে আর কবে পারব?

বিজেপি ক্ষমতায় আসছে। নিশ্চিতভাবে আজ আমি লিখে রাখছি - ক্ষমতায় আসছে অবিলম্বেই। তারপর পাঁচ অথবা দশ বছর শাসনের পর মানুষ তাদের নির্বাসন দেবে অন্তত পঞ্চাশ বছরের জন্য। কিন্তু, তার মধ্যেই, তাদের শাসনকালেই হয় আমি খুন বা পঙ্গু হব। নয়তো ওদের সঙ্গে আপস করব ভয়ে।

অর্থাৎ, দুটো ক্ষেত্রেই, আমার সর্বনাশই হচ্ছে। 

এবং, এই সর্বনাশ হচ্ছে লালকৃষ্ণ আডবানিদেরই কৃপায়।

হাইল্, আডবানি। 

হাইল্ হিন্দু জনগণ, তোমাদের পরবর্তী দশটি প্রজন্ম যেন তোমাদের ঘেন্না ছাড়া কিছু না করে।' (১০/১২/৯২)

দু'টি প্রয়াণের কথা দীর্ঘ এন্ট্রিতে লিখেছেন জয়দেব। তাঁর মধ্যে প্রথমজন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, এই এন্ট্রিতে অতি অল্পে উঠে এসেছে নিজের মায়ের চলে যাবার কথাও।
'গতকাল মধ্যরাতে সুভাষ মুখোপাধ্যায় মারা গেছেন।

বাঙালীর কবিতার ইতিহাস কোনদিনই সম্যক বুঝবে  না সে কী হারাল। তাতে খেদ নেই, লজ্জা তো সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের না, লজ্জা বাঙালীর। 

কিন্তু এই মৃত্যু থেকে আমরা কী শিখলাম? এই নির্বিত্ত অসহায় উপেক্ষিত মত্যু থেকে? শুধু কবিতা লিখতে হবে বলেও শেষ জীবনে এইসব ভোগ করে যেতে হবে? এইভাবে জীবন কাটাতে হবে?

হয়ত হ্যাঁ। হয়ত- না। আমি নিশ্চিত নই। তবে এবার একটা সিদ্ধান্তের দিকে যাওয়ার সময় এল।

সি পি আই (এম) নিশ্চয়ই এই মৃত্যু নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাবে না। সি পি আই (এম) ভয়ংকর দল। মৃত শত্রুও তার কাছে সহনীয় নয়।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার কিছু রেষারেষি ছিল। গোপনে। একেবারে নিজের মনের মধ্যে। একলব্যের মতো। সুভাষ মুখোপাধ্যায় সে কথা জানতেনও না কোনোদিন। অনেকটা 'গুরু গুড় চেলা চিনি' ধরনের ব্যাপার। প্রায় আঠার বছর আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে এক বিকেলে আমি স্যারকে বলেছিলাম - যতই যা হোক, সুভাষ মুখোপাধ্যায় পার্টি ছেড়ে ভুল করেছিলেন। তাঁর মাটি কামড়ে পড়ে থাকা উচিত ছিল। আমি অন্তত সে ভুল করব না।

করিনি। মাটি কামড়েই পড়ে থেকেছি। পার্টি ছাড়িনি। কিন্তু, এখন সুভাষ মুখোপাধ্যায়ই যখন নেই, তখন এসব কিছুই কেমন অর্থহীন লাগছে।

২০০২-এর ৮ ডিসেম্বর, রবিবার, আমার মা-ও মারা গেছে। এক অর্থে বেঁচে গেছে বলা যায়। বড্ড একা হয়ে গিয়েছিল। 

শুধু স্যার বাকি। তারপর আমি সর্বার্থে  অনাথ।' (সকাল ৮.২৫ মিনিট, ৮/৭/০৩)

আর দ্বিতীয়জন অনিল বিশ্বাস।

'অনিলদা মারা গেলেন। বোধহয় আগের দু'-একদিন আগেই গিয়েছিলেন।

আমার জীবনের ১০/১২ বছর শেষ করে দিয়েছিলেন  এই লোকটি।

তবুও, সেরা নেতা। ভারতের লেনিন না হোন, ভারতের মাও সে তুং না হোন, ভারতের গ্রামশি না হোন... আর, সত্যি বলতে হবেনই বা কেন? আমাদের রাজনীতি আমাদের। সেই রাজনীতির কার্ল হাইনরিখ মার্কস্- অনিল বিশ্বাস-এর মৃত্যুসংবাদ একটু আগে স্বীকার করে নেওয়া হল। 

এই সেই অনিল বিশ্বাস, যিনি আমাকে অকারণ- সত্যিই অকারণ - শাস্তিতে আমার জীবনের দশ-দশটা বছর শেষ করে দিয়েছিলেন।

তবে, আমারও কথা - কে হে অনিল বিশ্বাস? আমি যদি লিখব ঠিক করি- তবে, সে কে? ঠিক। ঠিক। অনিলদা-ও কেউ না। তাই আজ ব্যক্তিগত কথা বলব না। আদৌ বলব কিনা পরে ঠিক হবে। কিন্তু অনিলদা, যে কী ছিলেন...

আমি কি একটু আগে ওঁকে - মার্কস বলেছিলাম..বোকা-বোকা কথা... বলেছিলাম।

কিন্তু, ঠিক-ঠিক কথা বলতে গেলে-

অনিলদা - অনিলদা। টম-ডিক-হ্যারি, মাও-লেনিন-গ্রামশি- ও সব বললে- ভাবলে হবে না।'(সন্ধ্যা ৭.২৫ মিনিট, ২৬/০৩/০৫)

মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।

সারা ডায়েরি জুড়ে ছড়িয়ে আছে নিজের পরিবার সংক্রান্ত ছোটখাটো খবরাখবর, বাবা-মা'র শরীর নিয়ে উদ্বেগ, ছোটভাই জয়ন্তদেবের কথাও। ১০।৪।৯১ তারিখের এন্ট্রিতে একটা খুশির খবর দিচ্ছেন জয়দেব:

'অবিশ্বাস্য মনে হলেও, এটা ঘটনা যে - আমি একটা চাকরি পেয়েছি। একটা স্কুলে। নিমতা হাইস্কুল। মোটামুটি ভালো। আজই প্রথম কাজে যোগ দিলাম।

১৯৮৭ সালের ২৬ শে ফেব্রুয়ারি প্রথম সল্টলেকের একটা স্কুলে চাকরির পরীক্ষা দিতে গেছিলাম। তার ঠিক দু দিন আগে আমার এম এ পরীক্ষা শেষ হয়েছে। সেই চাকরিটা পাইনি। তারপর, একটার পর একটা... পাইনি, পাইনি আর পাইনি। অবশেষে, চার বছর চৌদ্দ দিন পর - সেই স্কুলেই চাকরি। অন্য একটা পর্ব শুরু হল তবে।

এই চার বছর বেকার থাকার পর্বটাও খুব জরুরি। জীবনে কখনো, কোনো অবস্থাতেও যেন এই অভিজ্ঞতাটা না ভুলি। এই চার বছর জীবন আমাকে পায়ের নীচে মাড়িয়ে যেভাবে দলে-পিষে-চটকে ফেলেছে, এবং সেই সঙ্গে নামিয়ে এনেছে আমারই দেশের অসংখ্য মানুষের সঙ্গে সমতলে, সেই অভিজ্ঞতাটা ভুলে যাওয়া কৃতঘ্নতা হবে।

অবশেষে সামান্য একটু অবকাশ। ভাবার জন্য, লেখার জন্য, বাঁচার জন্য। অথবা, তাও হয়তো নয়। যাই হোক, এর আর অন্য মানে নেই। নিজের ভাত নিজে উপার্জন করা ছাড়া।' (রাত ১১.৩০ মিনিট, ১০।৪।৯১)

ডায়েরির সর্বশেষের এন্ট্রি মন-ভালো-করা, যা একইসঙ্গে বিষন্নতা আনে, কারণ এই পডায়েরি লেখা শেষ হওয়ার মাত্র সাত বছরের মধ্যে অকালে চলে যাবেন জয়দেবও।

'আরে, আমাদের যে একটা ছেলে হয়েছে - সেটাও তো কখনো লিখিনি। আজ রবিবার। ওকে প্রথম চিড়িয়াখানায় নিয়ে গেছিলাম। ও- জুরা।' (২৬।৩।০৫)

এর পরে ডায়েরিতে আর কোনও এন্ট্রি নেই। তাই কবির নিজের বয়ানে আমরা জানতে পারছি না বামফ্রণ্ট জমানার শেষের দিকে নানা গণআন্দোলন ও পার্টির ক্রম-ক্ষয়িষ্ণু আধিপত্য নিয়ে ঠিক কী ভেবেছিলেন তিনি। জানতে পারছি না তাঁর হঠাৎ অশান্ত হয়ে যাওয়া দাম্পত্যের কথাও।
 

কিন্তু এই বিশ বছরের রোজনামচা জুড়ে ব্যক্তিমানুষ, সমাজকর্মী জয়দেবের অভিজ্ঞতার জটিল ওঠাপড়ার মধ্যেও বারবার মুখ দেখিয়েছে তাঁর কবিসত্ত্বা, যে কবিসত্ত্বা আবার ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সমাজতন্ত্রের ওপর তাঁর অগাধ বিশ্বাসে।

'সামন্তবাদের যুগে বুর্জোয়াদের বিপ্লবী ভূমিকাকে অস্বীকার করে একমাত্র নৈরাজ্যবাদীরা আর লেনিন বলেন: 'শেখো, শেখো আমাদের শত্রুদের থেকেই। মানবসভ্যতা এতদিন যে সম্পদ জমিয়ে তুলেছে, আমাদের হয়ে উঠতে হবে তারই সুনিয়মিত বিকাশ, ঐতিহাসিক এই সম্পর্কের উত্তরসূরী।' সারাক্ষণ এর পিছনে ওর পিছনে কাঠি না দিয়ে লেখো, ইডিয়ট, লেখো। শতাব্দী শেষ হয়ে আসছে, যদি পারো এই ফাঁকে আরো কয়টি কবিতা সংযোজন করে যাও মানুষের স্মৃতির পাতায়। কয়েকটি কবিতা মাত্র।
যে কবিতায় প্রখরতপনতাপ, যে কবিতায় হেমন্তের সন্ধ্যা, যে কবিতায় শীতের প্রথম রোদ।'

অত্যন্ত সুমুদ্রিত এই বই হাতে নিলে মনটা ভালো হয়ে যায়। অতি যত্নে বইটি ছেপেছেন সপ্তর্ষি প্রকাশন। প্রথমেই চোখ টানে একটি বিষয়সম্পৃক্ত প্রচ্ছদ, যার এককোণে মলিন রক্তপতাকা ও খোদিত কাস্তে-হাতুড়ি-তারা-র সামনে মুখ বাড়িয়ে আছে একটি কাক। ভেতরে ঝকঝকে পৃষ্ঠায় একদিকে রোজনামচা, অন্যদিকে সেই রোজনামচার পাণ্ডুলিপির প্লেট। মুদ্রণপ্রমাদ প্রায় নেই বললেই চলে। সুমুদ্রিত শুধু নয়, বইটিও সুসম্পাদিতও। কবির লেখা বানান অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। ডায়েরিতে উল্লিখিত প্রতিটি ব্যক্তিনাম ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে টীকা সহযোগে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে, এমনকি তাতে দেশ পত্রিকা, শঙখ ঘোষ, ও মাও সে তুং-এর বিস্তারিত পরিচয়ও বাদ যায়নি।

সমাজবদলের স্বপ্ন দেখা সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী জয়দেব বসু, অকালে বিদায় নেওয়া শক্তিমান কবি জয়দেব বসু ও তাঁর সময়কে রক্তমাংসে আরও কাছাকাছি নিয়ে এল এই বই।


---------------------------------------------------
ডায়েরি থেকে। জয়দেব বসু। সপ্তর্ষি প্রকাশন।
প্রকাশকাল- জানুয়ারি ২০১৬। দাম-  ২০০ টাকা (পেপারব্যাক), ২৫০ টাকা (বোর্ডবাঁধাই)

                          


2 comments:

  1. লেখাটা খুব মূল্যবান। ডায়েরীটা যদি দলিল হয়, এই লেখাটা তার জরুরী মুখবন্ধ।

    ReplyDelete
  2. পড়তে গিয়ে ওই সময়টায় ফিরে গেলাম - ওই সময়ের রাজনৈতিক ঘটনার রেফারেন্স -

    ReplyDelete