Friday 16 March 2018

দীপ্তিপ্রকাশ দে



            ভাবের ঘোর, আড়ির ঘোর






কথার মধ্যে যখন গড়ে ওঠে না-কথার একটা প্রচীর, প্রচলিত পাঠভ্যাস তখন ব্যর্থ হয়ে যায়! আর পাঠককে সন্ধান করতে হয় আশ্চর্য কোনও কষ্টিপাথরের, যা ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে যাচাই করে নেওয়া যায় সমস্ত কথাহীনতাকে। হাতে ধরে আছি দেবব্রত কর বিশ্বাসের চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ ‘ভাবের ঘর আড়ির ঘর’। আমরা যারা তার সাথেই বেড়ে উঠেছি, তিন দশকের সমস্ত সাফল্য আর ব্যর্থতাকে স্পর্শ করেছি একই আঙুল দিয়ে, তারা সেই কবে থেকেই জানি, দেবব্রত ঝাঁকের কই নয়। সমষ্টির ভাষায় সে কথা বলে না। তার বলা তারই নিজস্ব। এ-যাত্রায় সে একক এবং অনন্য। ঠিক যতটা সে বলে, ততটাই সে বলে না। ফলত পাঠককে পা ডোবাতে হয় জলে। ছেঁকে ছেঁকে তুলে আনতে হয় জায়মান কাব্যিকতার সমস্ত অবাচ্যতাকে।
কাব্যগ্রন্থটিতে আছে মাত্র আঠারোটি কবিতা। চরিত্রধর্মে প্রতিটিই এক। আবার সার্বিকভাবে গোটা কাব্যগ্রন্থটিই হয়ে উঠেছে একটি চরিত্র। যে-কোনও স্বল্পাতনের গ্রন্থে যা জরুরি। বার্ধক্য আর তারুণ্যকে একই সঙ্গে ধরেছে এ-বইয়ের উৎসর্গের পাতা-‘ভালোবেসে দূরে চলে যাওয়া বৃদ্ধ গাছ/ এখনও প্রেমিকের ছায়া দেয় তরুণ যন্ত্রণায়।’ এখান থেকেই বেদব্রত তার গ্রন্থের অভিমুখ অনেকটা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। ফলত, আমরা যারা গ্রন্থনামটি পড়েই ভেবে নিয়েছিলাম এটি নিছক প্রেমের কাব্য, তারা শুরুতেই হোঁচট খাই। দেবব্রতর একাব্যের পরতে পরতে প্রেম আছে, কিন্তু সে-প্রেম আত্মগত, সে প্রেম বিপন্নতাবোধের, সে প্রেম সিদ্ধান্তহীন এক জীবনের। যে শুধু এঘর-ওঘর করে। একবার ভাবের ঘর আর একবার আড়ির ঘর করতে করতে যে প্রেমে জুড়ে যায় এক অনন্ত হাইফেন। আর সামঞ্জস্যের এক অনুভূতি-প্রদেশ থেকে উঠে আসে দেবব্রতর নিজস্ব স্বর-‘কাকে ধরব, কাকে ছাড়ব বুঝতে বুঝতে/ আগুন ক্রমশ নীল হয়ে নিভে আসছে এবং ইনবক্স/ উপচে পড়ছে শুভকামনায়।’ সামাজিক সমস্ত ভান থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বারবার দেবব্রত ডুবে যায় এক একক দেবতার সন্ধানে। অভ্যস্ত বুলি, পরিচিত আদর, যুক্তিহীন গুণকর্তীন আর আলোকময় মঞ্চসর্বস্বতার বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে কবির উচ্চরণ আমাদের স্তব্ধ করে দেয় মাঝে মাঝে। মনে করিয়ে দেয় অমরত্বের সেই ঈশ্বরের কথা, তাড়াহুড়োয় যাঁর সম্মতি নেই।
পৃথিবীর সমস্ত ভালাবাসাময়-নৈকট্যের এক বিপরীতমুখী চোরাটান থাকে। পরিষেবা-সীমার বাইরে গিয়ে যে দেখে নিতে চায় তার প্রেম। দেবব্রতও সেভাবেই সমর্পিত এক ভালোবাসায় সরিয়ে রাখতে চেয়েছে তার প্রেম। বলেছে -‘তোমাকে সরিয়ে রাখলাম পাশ থেকে। অবহেলে।/ যাতে দূর এবং সুদূরপ্রসারী মায়ায় আড়ি পাতা যায়।’ কখনও আবার সে চূড়ান্ত ভ্রামণিক। নিজের কাজেই নিজের বিস্ময় ফিরে আসে তার-‘কেন যে পাহাড়ে না গিয়ে বেঁচে ছিলাম/ মনে পড়ছে না’। কিন্তু এসব পাড় হয়ে আমরা যখন ১০ নম্বর লেখাটির কাছে এসে পৌঁছাই, সমস্ত প্রেম আর আত্মপ্রত্যয় টাল খেয়ে যায় আমাদের। মেধার সমন্বিত নির্যাসে ফুটে ওঠে এক একটি পংক্তি। ভয়ার্ত দৃষ্টি মেলে আমরা দেখি গুজবের আগুনে পুড়ে যাচ্ছে কলকাতার রাস্তঘাট। আর তার নাড়িভুঁড়ি চিরে উঠে আসছে সমকাল- ‘তবু তো দেখে নিচ্ছে লোকজন। এ ওকে। সে তাকে।/ উত্তুরে হাওয়াও দেখে নিচ্ছে দক্ষিণপন্থাকে।/ আমরা যে যার মতো ছড়িয়ে পড়ছি গুজবে।...আমরা আর আগুনে গল্প জ্বেলে গোল হয়ে বসি না,/ শুধু আগুন জ্বালাই। শুধু আগুন জ্বালাই।’ ১২ নম্বর কবিতাতেও এই আর্ত অসহায়তাই ফুটে ওঠে-‘দম বন্ধ লাগে, যখন শাটার নামানো হয় দোকানে।’
আগেই বলেছি, দেবব্রতর কবিতায় প্রেম আছে, কিন্তু সে প্রেম সাময়িক উত্তেজনার দাবি মিটিয়ে মিইয়ে যায় না। বরং অবচেতনের মহাফেজখানা থেকে সে তুলে আনে নির্মম রাষ্ট্রীয়-সত্যকে। আমরা দেখি ‘রাত বাড়লে সবাইকে বের করে’ দিচ্ছে সরকার। এই যে দেখা, সামান্য দৃশ্যের মধ্যে বহুকৌণিক আলো জ্বেলে দেওয়া, শিল্পের এই বাহুবলীত্ত্বই অন্যদের থেকে আলাদা করে দেয় কবিকে। যেখানে সে একা, নিঃসঙ্গ। যেখানে ‘কারোর সঙ্গে কারোর বনিবনা নেই’। ১৬ সংখ্যক কবিতাটি এই কাব্যে পাঠকের শ্রেষ্ঠ অর্জন। কী মায়াময় আর আশ্চর্য রূপকে দেবব্রত তুলে এনেছে  ‘বয়স’ নামক একটি অর্বাচীন ‘মিথ্যে’কে। কবিতার শেষ দু’টি পংক্তিই উদাহরণের পক্ষে যথেষ্ট- ‘আমি জানি, ভাত ডাল মাছ হতে পারার/ অন্নবোধে বয়স খোলা চুলের মতো মৃত।’ পার্থিব সব চাওয়া-পাওয়ার অন্ধকার ধাপ পেরিয়ে দেবব্রত শেষ পর্যন্ত উঠে যায় নিঃসঙ্গ এক চিলেকোঠার ঘরে। যেখানে সে একা। যেখানে সে এক সংজ্ঞাহীন সজীব মৌননতার আবিষ্কারক। আমরা আশ্চর্য হয়ে দেখি, সে ঘরে ‘ভাবের জন্ম’ হচ্ছে, ‘আড়ির অভিমানে’।

ভাবের ঘর আড়ির ঘর
দেবব্রত কর বিশ্বাস
প্রকাশক: আঙ্গিক মাস্তুল


No comments:

Post a Comment