Sunday 18 March 2018

সৈকত সরকার



সৌমাভর কাব্যগ্রন্থ "যতটা না ছিলে সম্পর্কে ": অসম্পর্কের সুতোয় গাঁথা অনুভূতিমালা






কবিতায় যাপন আর অক্ষর ওতপ্রোত মিশে যায়। যে বিশ্বাস থেকে শব্দের জন্ম, ঠিক সেই বিশ্বাসেই কঙ্কাল থেকে রক্তমাংসের আকার নেয় কবিতা। তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে তখন জীবনের উত্তেজনা, ছন্দ বা মিলের সাফল্যের উর্ধে সে অনেক বেশি অনুভূতির প্রাবল্য নিয়ে থাকে। সৌমাভর "যতটা না ছিলে সম্পর্কে" ঠিক তেমনই এক শব্দ-অস্তিত্বের স্মারক। অবয়বের তুলনায় ব্যাপ্তির দিকে যার গতি। তার অর্থ এই নয় যে অবয়ব এখানে অপ্রাসঙ্গিক,কারণ ওটুকু খোলস ছাড়া তো কবিতাও প্রাণধারণ করতে পারে না। বইয়ের সূচনায় কবি পাবলো নেরুদার সেই বিখ্যাত পংক্তি উদ্ধৃত করছেন- "It is a single hour long as a vein " - শিরার মতো দীর্ঘ সেই সময় জুড়ে গেঁথে রাখা অনুভূতিমালার কথা আমরা পড়ব এই কাব্যগ্রন্থে। শব্দের পাশে কিছু কিছু অনুষঙ্গ আমাদের প্রসঙ্গান্তরে নিয়ে চলে,যেমন 'ডার্ক সার্কল' কবিতার এই লাইন- "সেরে ফেলছ পর্ণমোচী ঋতু/ মেঘের যুবতীবেলায়"- এখানে ঋতুর পাশাপাশি অবধারিত ভাবেই মনে আসবে গাছের কথা,যে সমস্ত পাতার ভার ঝরিয়ে দেয়। কিন্তু তবে ঋতুর কথাই কেন লিখলেন কবি? কারণ হয়তো বা এটা কবির নয়,  কবিসত্তার আড়ালে কোনো গাছের কল্পনা,যে প্রয়োজনীয় মরশুমে ভারমুক্ত হতে চায় যুবতী মেঘের কাছে। অনুভূতি প্রকাশের আধার এবং আধেয় এভাবে আবর্তিত হচ্ছে ক্রমাগত।এই গাছের কথাই পাবো তার পরের কবিতায় - "হাওয়াও রাগে একদিন। ধ্বজা ধরে রাখে দম্ভী গাছ "  গাছের ভঙ্গিতে কবিতার কথকের এ যেন কোনো আত্মজৈবনিক শিলালেখ। সমস্ত ফিরে আসাই ফেরা নয়, কিছু কিছু ফেরাও মানুষকে না ফেরার আত্মপ্রত্যয় দিয়ে চলে,কবি লিখছেন- "সবাই ফিরলে ফিরি আমি / ফেরার পর ফেরারি।" শরীর আর মনের দ্বন্দ্ব এই কাব্যগ্রন্থের অন্যতম  বিষয়। কখনও শরীর সংক্রমিত হয় মনে, আবার কখনও মন সংক্রমিত হয় শরীরে, কুসুমের শুধু শরীরই ছিল?  নাকি মন সংক্রমিত শরীর? তাদের এভাবে আলাদা করা যায় নাকি?  -"মনের আজ শরীর খারাপ,তবে আরশোলা খুব ভয় দেখাক।/ কলিং বেলে রাখছি আঙুল।দরজা খোলো চিচিং ফাঁক। " আরশোলা শুধু মনের জুগুপ্সাকেই জাগিয়ে দেয়, আর শরীরকে জাগানোর জন্য চাই সঠিক আমন্ত্রণ, ঐ কলিং বেলের আর্তিটুকু।কিছু কিছু কবিতা কোনো নির্দিষ্ট শিরোনামের আধারে লেখা হয়। অর্থাৎ বিষয়ের পথ ধরে তারা যাত্রা করে আরও অন্যান্য পথে।এই কাব্যগ্রন্থে "সিগারেট" তেমনই একটি কবিতা। সিগারেটের ধর্মকে অনুসরণ করেই তা সংক্রমিত হয়েছে অন্যান্য প্রসঙ্গে। সিগারেট এখানে কথকের বিপরীতে দাঁড়িয়ে রয়েছে,কথক তাকে বলছেন - "তোর মুখে রঙ দিই/ আগুনের রঙ/ তুই জেগে থাক আমার বারোয়ারি ঠোঁটে"-   ঠোঁট বারোয়ারি - অর্থাৎ তার কোনো একক সিগারেটের প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতা- এই অকপট স্বীকারোক্তি কথককে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে। প্রেমের বহুবিধ এবং বহুমাত্রিক আবেদন সিগারেটকে কেন্দ্র করে পল্লবিত হয়। তারপর সুদূরপ্রসারী কর্মফলের মতোই মারণরোগের যন্ত্রণা বহন করে আনে।

কাব্যগ্রন্থে আরও চমক রয়েছে দৃশ্যকল্পের অভিনবতায়। দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে যেতে যেতে তার মাত্রাগত বদল ঘটে যায় অনেকখানি। এই ছিল প্রকৃতি, হয়ে গেল শরীর, অথবা শরীর থেকে তার আরও অনুপুঙ্খ নিরীক্ষণে। " আদুল গায়ে নরম অমল ঘাস / হাঁসের পায়ে ঘুঙুর হয়ে ছোটো।তুমি কাজের মেয়ের কালো ভরাট স্তন / মেঝের ওপর সকাল হয়ে ফোটো।"-  শরীর আর প্রকৃতির এই মিলিত নির্যাস দৃশ্যকল্পকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে। দেখার সূক্ষতাতেই তার সার্থকতা। কবি যেন মাইক্রোস্কোপ চোখে দিয়ে দেখে নিচ্ছেন এসব দৃশ্য-বিপর্যাস।অনেকগুলো প্রশ্ন আর তার সদুত্তরের সন্ধান নিয়ে এগিয়ে চলে কবিতাগুলি। "একি কোন গাছ?  / আজীবন স্থবির... সূর্যমুখী"   আর খুব প্রাসঙ্গিকভাবেই কবিতার নাম 'সম্পর্ক'। সূর্যমুখীর মতোই সূর্য মুখাপেক্ষী এক সম্পর্কের স্থবিরতা। আসলে উপজীব্য এই - "এ কেমন সম্পর্ক?  " সূর্যমুখীর উপমায় তাকে অবয়ব দিয়েছেন কবি। "একি কোন বৃষ্টি?  হলে পরে সরে যায় মেঘ?  সম্পর্কের পাথরগুলো সরে যায়,কান্না ঘনীভূত হলে। অথবা তার পরের কবিতা "-সম্পর্ক" - "দাড়ি ভর্তি ব্রেক আপে আমি কাঙাল অভুক্ত ভিখিরি / কলাপাতা পেড়ে আছি,গোগ্রাসে চিবিয়ে নেব/ শাঁখা পলা আঙুল...গৃহস্থালী ভাপ" - অনবদ্য প্রকাশভঙ্গি। ব্রেক আপের যন্ত্রণা যাকে অগোছালো, অসজ্জিত করে, গালভর্তি দাড়ি তারই বিরহের দ্যোতক। একজন অভুক্ত ভিক্ষুকের মতোই তার ক্ষুধার তীব্রতা। এরপর ছুঁয়ে ছু্ঁয়ে গেল কিছু দাম্পত্যের চিহ্ন 'শাঁখা' 'পলা' অথবা 'গৃহস্থালী ভাপ'  মনে হয় সেই তীব্র ক্ষিদের কাছে দাম্পত্যই তখন একমাত্র ভোগ্য এবং আরোগ্যের পথও। সমস্ত কিছুকে শুষে ফেলার মতো ক্রোধ তাকে গ্রাস করেছে।"-সম্পর্ক"ও এক রকমের নৈকট্য তৈরি করে। সম্পর্কে যে শারীরিক নৈকট্য থাকে, -সম্পর্কে তা অস্তিত্বহীন,অথচ রয়ে গেছে দহনের মধ্যে আগুনের নৈকট্য, না-থাকার সাথে অভিমানের নৈকট্য, বিপ্রলম্ভ শৃঙ্গারের এই ভাবগুলো অ-সম্পর্ককে একটা নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করে।একাকিত্বের সাথে  অস্তিত্বের অদ্ভুত  কাঁথাস্টিচ কিছু কবিতায় ধরা পড়ে। যেমন ধরা যাক "ঢেউ সরে গেলে" কবিতাটির কথা। নির্জন সমুদ্রের তীরে এক বীভৎস ষাঁড়ের মুখোমুখি হয়েছেন কথক। এ কি আত্মসাক্ষাৎ নয়? আর যেখানে ঢেউগুলোই স্পর্শকাতর, তেমন বালুচরে লাল কাঁকড়ার সন্ধানে থাকে কথকের বারোজন বন্ধু। সম্পর্কের থেকে বেরিয়ে নিজেকেই নতুন করে চিনে নেওয়া। "আপন হতে বাহির হয়ে" নিজেরই মুখোমুখি হওয়া তো আত্মমন্থনের প্রয়োজনেই। একাকিত্বের এই তীব্র বোধে এসে মিশে যায় মিথ আর কিংবদন্তির পরিসর। ক্রুশবিদ্ধ যীশুর কাতরতা অথবা জুডাসের প্রসঙ্গ আসে সেই সূত্র ধরেই। কবিতা এভাবেই আত্মকথন থেকে উত্তীর্ণ হয়ে বৈশ্বিক মাত্রা পায়।যন্ত্রনার মধ্যেও যেখানে স্থবিরতা আর প্রশান্তি, সেখানে যীশুর পুরাকল্প আসাও অনিবার্য।

প্রচলিত ধারণার বিপরীতে দাঁড়িয়ে কিছু কিছু পংক্তি ব্যতিক্রমী চায়। তাদের পুরাতন চালে ভাত ভালো হয়, আর শস্যও তেমন। নিষেধাজ্ঞ ঠেলে উঠে আসে কিছু সোচ্চার বাক্যবন্ধ। যেমন এই পুরনো ত্রিপদী চালে বাঁধা এই লাইন- "পোকায় কেটেছে    শস্যসকল / বিনিদ্র চাষীজন/ সুখের নাম যে     মাজরা পোকা / জানে ফসলের স্তন। "  বিনষ্টির আড়ালেও যে সম্ভোগের প্রাপ্তি থাকে,কবি সেদিকেই ইঙ্গিত করেন। আবার কয়েকটি কবিতায় রইল ফর্ম বিষয়ে গবেষণার পরিচয়।যেমন "ঘটমান" কবিতাটি। সিনেমায় নাটকীয়তা সৃষ্টির নানা ধাপগুলি এখানে কবিতা হয়ে ওঠে, সেখানে ক্লাইম্যাক্স অংশে বলা হয় "পেট চেরা হল/ উত্তরাধিকার নষ্ট করা হল " - কবিতার একেবারে শেষে ফ্ল্যাশব্যাক অংশে জানা যায়,এরা সকলেই মানুষের রসনার শিকার অ্যাকোয়ারিয়ামের লাল হলুদ মাছ। কবিতাটি থ্রিলারের মতো আচরণ করে,বা একে কি থ্রিলার-কবিতা বলা যায়?  কবি কোনো একটা দেখাকে পাল্টে নেন আরও অনেকগুলো দেখার নিরিখে। যা প্রত্যক্ষ, উঠে আসে তার বাইরে থাকা ব্যাপ্ত অদেখার দেশ। "দেওয়ালের ভিতরে সাঁটা একটা পেরেক / পেরেকের চারপাশে অনেকগুলো দেওয়াল " - দেখার এই ভিন্নতা নিয়েই স্বতন্ত্র হয়ে ওঠে সৌমাভ'র কবিতা।এই বইয়ের কবিতায় রয়েছে অসংখ্য প্রথা ভাঙার চিহ্ন। প্রাতিষ্ঠানিক প্রথাবিরোধিতা নয়, শব্দের প্রচলিত প্রয়োগ আর শব্দের অর্থান্তর ক্রিয়ায় বদল আসে। "এক মিনিট সরবতা পালন হল / যারা বেঁচে আছে তাদের সহিষ্ণুতার দীর্ঘায়ু কামনায়।এও তো এক বদল। শোকের পরিশেষে নীরবতা আসে, কিন্তু সরবতাই যে প্রতিবাদের আয়ুধ, যারা বেঁচে আছে তাদের সহিষ্ণুতার রক্ষক। কবিতা গড়ে ওঠার পথও তত সরল নয়।তার জন্মও তো আসলে শব্দের কাঠামোয় প্রাণপ্রতিষ্ঠার মতো, তারও রয়েছে নির্দিষ্ট আঁতুরঘর, এমনকি দাইমা-- "দেখবে প্রতিটি প্রসূতিগৃহে দাইমাদের হাতে সব নিঃশ্বাস/ফুটে অবিচ্ছেদ্য কবিতার নাভি/ শুধু কবিতার নাভি হয়ে"  "ভাবনালতা" নামের এক মফঃসলে সমনামী অনেকগুলি ব্যক্তির সন্ধান মেলে,কার্যত কল্পনার সাথে কল্পনারই সাক্ষাৎ ঘটে, কবির সাথে কবিরই অন্যান্য সত্তার সহাবস্থান। নিজেকে খুঁজে নেওয়ার এ এক অমোঘ অভিযান, ভাবনাপুর হয়তো তেমনই প্রতিবিম্বের কাছে এনে দেয় কথককে।

দৃশ্যকল্পের বিচিত্রতায় কবি গেঁথে রাখেন সাসপেন্স, যেন কোনো গভীর দ্যোতনা থেকে তারা উঠে এলো এইমাত্র। সশব্দ স্লোগানের বদলো তেমন তেমন প্রয়োগ মৃদু অথচ অনির্বচনীয়। "একেক দিন পৃথিবী বিরলভাবে শান্ত হয়ে যায়/ কোনো ঝটাপটি নেই,কলরব নেই,নেই কোনো সান্ত্বনা /থেকে থেকে শুধু টাইপের খটখট শব্দ" - কেমন নীরবতার মধ্যেও বজ্রগর্ভ মেঘ রেখে দেওয়া হল,তাও এক যান্ত্রিক শব্দ দিয়ে যাকে উপেক্ষা করা কঠিন। নিষ্ঠুর আবহ কি তবে টাইপের শব্দের মতোই প্রচ্ছন্নে ঘনিয়ে ওঠা ঘূর্ণবাত,যার প্রতি শব্দে আসন্ন কোনো শঙ্কার ইশারা থাকে!কাব্যগ্রন্থের সামগ্রিক ভাবনা তিনটি পর্যায়ে আধারিত, পর্ববিন্যাসগুলিও শুরু হচ্ছে প্রবাদপ্রতীম প্রণম্য কবিদের পংক্তি উদ্ধৃত করে। এই তিনটি পর্ব হল যথাক্রমে - . যতটা না ছিলে সম্পর্কে
. লাল কাঁকড়ার গর্ভগৃহ
. যারা ভাবে আমি ভুল করেছি
এযাবৎ আলোচনার সূত্রে এসেছে প্রথম দুটি পর্বের প্রসঙ্গ। আর এই শেষ পর্বের সূচনা ঘটেছে গালিবকে উদ্ধৃত করে। আর এই পর্বের কবিতাগুলোও গালিবের রচনার অবয়বেই লেখা, তেমনই বিন্দুতে সিন্ধু দর্শনের প্রয়াস। রয়েছে গালিবের অনুকরণে তেমন ভণিতাও - "তুমি যে নাস্তিক,এ তো সকলেই জানে অবোধ সৌমাভ/তবুও পাখিদের ঘুম ভাঙার আগে ভোরের আজানে আমি হাঁটুমুড়ে মাথা নোয়াবো"এই অণুকবিতা সিরিজে কিছু সংক্ষিপ্ত শব্দের কোলাজ আরও গভীর অর্থের দিকে পাঠককে নিয়ে যায়, যেমন এই লাইন দুটি— “শিউলিফুলকে ভালোবেসে জড়িয়ে ধরেছিলে শিউলিগাছকে/ শিউলিও গেল ঝরে আর তোমার সারা শরীরে শুঁয়োপোকার কাঁটা”। সামগ্রিকভাবে কাব্যগ্রন্থটি কবির আত্মমন্থনের সাথে সাথে কবিতার-অবয়ব নিয়ে গবেষণার কিছু কিছু চিহ্ন রেখে যায়।



কাব্যগ্রন্থ- “যতটা না ছিলে সম্পর্কে”,
কবি- সৌমাভ
প্রকাশক- সপ্তর্ষি প্রকাশন
প্রচ্ছদ- মারুত কাশ্যপ
দাম- ৭৫ টাকা।

No comments:

Post a Comment