Saturday 17 March 2018

রাতুল চন্দ রায়

‘তুমিও সাধক যেন, অক্ষরের’, লালনদুহিতা…


              পৃথিবীর সব জল, সীমান্ত ছুঁয়েছে বারবার
                                এ তো শুধু প্রেম নয়, রক্তে ভেজা শরীর আমার

বেবী সাউয়ের ‘গান লেখে লালনদুহিতা’ যখন হাতে পেলাম, তখন শীত যায় যায়, বসন্ত দরজায়। চারিদিকে যেন প্রকৃতি তুলি বোলাচ্ছে। বিভিন্ন রঙ ফুটে উঠছে এই মধুঋতুতে। তবু আমাদের মত কারুর কারুর কান পেতে বসে থাকার নিয়তিটাই হল সেই স্বর শুনতে পাওয়া, যাকে আপাত ভাবে মনে হয় মিলনের গান, কিন্তু যা প্রকৃত অর্থে হল  বিষাদের। যেন কোথাও, কোনও এক সময়ে ঘটে গেছে কোনও বিরহের ঘটনা, বা কোথাও কারো জীবনে ঘটতে চলেছে বিরহের, বিচ্ছেদের সেই মুহূর্ত। আর সেই একাকী কোকিলটি যেন শেক্সপীয়রের কিছু কিছু জেনে যাওয়া সেই সুন্দরী, যে নিজেই জেনে যাওয়ার দুঃখে একা গান গেয়ে চলে। বা মনে আছে, সেই স্কটল্যান্ডে পাহাড়ের মধ্যে একা একা এক স্কটিশ তরুণীর গান গেয়ে চলা বেদনার গান? হয়ত সে শস্য কাটছে, কিন্তু গলায় তার বেদনার গান, কণ্ঠে তার বিষাদ। কিন্তু এ সব মনে এলো কেন? বিশেষ করে এমন একটি বইয়ের আলোচনা প্রসঙ্গে, যার সম্পর্কে চাইলে নানা কিছু লেখা যায়। বইটিকে যেকোনও জায়গা থেকে শুরু করা যায়, যে কোনও জায়গায় শেষ করা যায়। আমার সঙ্গে সব ভাল বইয়ের সম্পর্ক মনে হয় এমনই হয়। যে কোনও জায়গা থেকে শুরু করা যায় আর শেষ করাও যায়। খুব বাড়াবাড়ি ভাবে মনে আসে বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ফিরে এসো চাকার নাম, কিন্তু না তার কথা বলছি না, কারণ কবিকে এত প্রশংসা করার আমার কোনও দায় নেই। বরং বলি, গান লেখে লালনদুহিতার কথা। কবিতাগুলি পড়তে পড়তে আমি সেই একাকী গান গেয়ে যাওয়া কোকিলের ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম। না, সে খুব ঘন ঘন ডেকে চলেছে এমনটা নয়, বরং সে একটু থেমে, একটু মন্থরতার সঙ্গে, ডাকছে, বলছে কথা। আবার সে নিজেই নিজের মতো ঘোরে বিস্ময়ের সঙ্গে দেখছে, বলছে- দ্যাখো তো, এত কিছু থাকা সত্ত্বেও, কেমন সুন্দর বসন্ত!
তুমি তো চাওনি কিছু, পেতেছ যে অনন্তের ধ্যান
সমস্ত বিরহে আঁকা, প্রেমীদের, অনন্ত শয়ান
আমিও নীরব থাকি, আকাশ ভরেছে শুধু রোদে
বিবাগী এ ঘরদোর,অভি সার, গোপন বিচ্ছেদে

তো দেখা হয় এই বিষাদের গায়িকার সাথে। কিন্তু সেই গায়িকা অবসাদে ভোগেন না। বরং এ এক বৃহত্তর বিষাদ। কিন্তু তার মানে এও নয়, দর্শনের ভার তাঁর কবিতায় চেপে বসে। দর্শন থাকে বন্ধুর মত কবির পাশে। যেমন-
জলের ভিতরে জানো কোনও পদশব্দ স্থায়ী নয়
মাছেদের দৃশ্যকল্প অযুত নিযুত চিত্রকর
এঁকেছে শীশার শীত। বোধহীন। ক্ষুধা মনে হয়
সমস্ত অভিসারের পথে লেখা দুরারোহ চর

এই কবির কবিতা তো আগে পড়িনি আমি। এমন সত্য উচ্চারিত হচ্ছে কোথা থেকে! কীভাবে এমন চিরকালীন কিছু কথা এমন একজন কবির কণ্ঠে ধ্রুপদী সনেটে (প্রতিটি কবিতাই সনেট। চতুর্দশপদী।) উচ্চারিত হচ্ছে, যিনি প্রথম দশকের, প্রায় সদ্য লিখতে এসেছেন এবং এই বই পড়ে অনুভব করছি, তিনি যদি আর একটিও কবিতার বই না লেখেন, স্রেফ এই একটি কবিতার বইতেই বাংলা কবিতাকে শাসন করার ক্ষমতা রাখেন। কারণ এমন সহজ শাশ্বত সত্য কথাগুলি লেখা হয় না, লিখিত হয়। এর জন্য প্রয়োজন কবির মতোই নিভৃতে যাপন, দরকার পড়লে বাংলা কবিতার আবহ, পরিমণ্ডল থেকেই দূরে যাপন। ভাগ্যিস তিনি দূরে যাপন করেন, তাই তো কবিতাগুলি লিখিত হল তাঁর কলমে, ভাষা পেল। প্রকৃতি তো এভাবেই তার কথা বলার আধার খুঁজে নেয়।
তো, যেটি বলছিলাম, প্রচুর রঙ, কিন্তু সেই সব রঙে প্রাজ্ঞ ধূসর ছায়া আছে। কিন্তু কেমন সে সুর! সারা বই জুড়ে গানের অনুষঙ্গ। তিনি নিশ্চয় গান করেন। তিনি নিশ্চয় এমন এক গায়িকা, যাঁর গান আমরা শুনতে পাই না। আমি নিজে সঙ্গীতের সামান্য উপাসক হিসেবে জানি, এই সাধনার নিজেরও এক কষ্টবোধ আছে। কেমন সে কষ্ট?

নিজেকে পোড়াই ফের, কাশবনে হাঁটে কেউ একা
পা-ছাপে আলতা মেশা বিষন্ন আলোক মুখে পড়ে
লিখে রাখা শবচিহ্ন, স্মৃতিভ্রমে হরিধ্বনি লেখা
গান তো লেখে না মেয়ে, গান ভেবে সুর দিয়ে বসে

হ্যাঁ সেই গান আমি সারা গ্রন্থ জুড়ে পেয়েছি। বিভিন্ন গান। সত্যিই কে এই লালনদুহিতা? এও তো এক রূপক। এক বিশুদ্ধে ফেরার রূপক। যে আধুনিক বিচ্ছিন্নতায় আমরা খণ্ডের সাধনা করে চলেছি, তাকে যেন ঘাড় ধরে এই লালনদুহিতা টেনে আনেন সেই হারিয়ে যাওয়া জগতে। একবিংশ প্রথম দশকে। টেনে আনেন সেই মন্থরতায়, যা বাংলার নিজস্ব মন্থরতা, যার মধ্যে রয়েছে বাংলার মাঠ, ঘাট, লুকিয়ে থাকা নিজস্ব শস্যক্ষেত, কৃষিকাজ, দেবীজন্ম, পুকুরের ঘাট, শিউলির গন্ধ, - আরও কত কী! এই কবির বিষাদ তো যান্ত্রিক বিষাদ নয়, যে যান্ত্রিক বিষাদের মধ্যে আমরা হারিয়ে ফেলছি আমাদের ক্রমাগত। এই কবির বিষাদ তো বাউলের বিষাদ, যা থেকে সুর জন্ম নেয়।

বিশুদ্ধে এবার ফেরো, বিপ্লবের রক্তাক্ত মেশিন
বর্জ্যতার গান লেখো, বাউলিয়া পাখি যে অচিন

কোথা থেকে পেলেন কবি এই ডাক? ইনি যে বুকের মধ্যে, মনের মধ্যে চাপ চাপ হয়ে থাকা কষ্টকে জাগিয়ে তুলতে পারেন। হয়ত সেই কষ্টকে বহুদিন শুনিনি আমরা। বহুদিন সে হয়ত লুকিয়ে ছিল আমাদের মনের মধ্যে। তিনি শুনেছেন। তিনি বলেছেন। আর ছন্দের কাঠামোয় এক এক করে তুলে এনেছেন অজস্র রূপক। কখনও সাবভার্সিভ যৌনতার রূপক, তো কখনও তার সমসময়ের এই ক্ষয়ে যাওয়ার বেদনার রূপক। বারবার তার কবিতার ভিতর ফিরে এসেছে কৃষিকাজের মতো শব্দ।

যেমন-

১) শস্যের শরীরে আজ গান লেখো বিষাদবালক
নামুক নামুক ঝড় পৃথিবীর জন্মমৃত্যুশোক

২) একমাত্র প্রেমিক সে হিমালয় পেতেছে আসন
আমিও তাপসী সাজি ফুল হাতে পার্বতী যেমন

৩) তৃষিত পথিক সেও আমি তার একমাত্র নদী
   প্রেম বলে বুঝিয়েছে সাধনার খাত ও দেওয়াল
   শ্রাবণ আসলে বোঝে আলপথ শূন্য কিছুকাল
   ভালোবাসা অবশেষে কৃষিক্ষেত হয়েছে বিবাগী

৪) নির্লিপ্ত চোখের জল, মৃত নদী বরাবর ক্ষেত
খড়ের প্রতিমা সেও, শিখে নেবে জলজ সংকেত

এবং এরকম আরও অনেক। যৌনতার সুনিপুণ, পরিমিত ব্যবহার। উচ্ছসিত ঘোষণা নেই। মৃদু, অথচ সুস্পষ্ট। সমকালীন ঘোষণার লাউডস্পিকারের মত নয়। বরং কবিতার নতুন নতুন প্রতীকে। সম্পর্কের বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত আছে। ফুটে উঠেছে। কিন্তু তা সরল ন্যারেটিভে না, যা তাঁর সমকালীন কবিতার এক বদ-অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। যেন বা ন্যারেটিভে ঘটনার বিবরণ লেখাই নতুন কবিতা। কিন্তু আমাদের সৌভাগ্য বেবী কবিতার লোক। আত্মঘোষণার নয়। সে কারণে প্রেমের কবিতাও হোক, বা যৌনতার কবিতাও হোক, তাঁর এই চতুর্দশপদী কবিতাগুচ্ছে সব কিছুই বহুস্তরীয়। একটা টেক্সটের মধ্যে আরও অনেকগুলি টেক্সট। হায় উত্তরাধুনিক! এইগুলিই তো উত্তরাধুনিক কবিতা। কিন্তু ধ্রুপদী, চিরন্তন এবং শিকড়সন্ধানী। নতুন ভাষার অনুসন্ধান কীভাবে হতে পারে, তার নমুনা আপনারা পাবেন এই বইয়ের কবিতায়, যেখানে নতুনের আহ্বান সজোরে ঘোষণায় নয়, বরং আলতো করে মৃদু, একাকী, নির্জনে বলা। কিন্তু তাই বলে তার ভাষা অনাধুনিক তা নয়। বরং তাঁর সমসময়ের ভাষাকে ব্যবহার করেই তিনি ধ্রুপদী ফর্মে চলে গেছেন চিরন্তন কথার দিকে। ব্যবহার করেছেন সমসময়ের প্রেক্ষিত।

১)  দখলের অভিযোগ মন্ত্র দিয়ে জয়ধ্বনি আঁকা
জলজ মানুষ তারা গিনিপিগ রঙের বাহার
শাড়ির নীলাভ রঙে ভরে আছে রাজনীতি খেলা
নুনের কামড়ে ঠোঁট জ্বলে মিথ্যে প্রেম বারবার

২) গুরুতর এ অসুখ, পাথরে জন্মেছে চারাগাচ
  শহর ভেবেছে মৃত্যু! নিয়তিই সে, প্রেম দুর্নিবার
ফিরেছ সাধক বেশে জড়িবুটি ছন্দ অলঙ্কার
তোমাতে মরেছি ফের শস্যের শরীরে কৃষিকাজ

৩) সঁপে দেওয়া সবটুকু শিকারীর অন্ধকার খেলা
সমর্পিত সাধকের । গান লেখে লালনদুহিতা
জন্মলোভে জাগে রাত নিশিডাকে জেগে ওঠে পাড়া
আপেলের গতিপথ ধীরে ধীরে নীলাভ শূন্যতা

আসলে এই বই নিয়ে লিখতে চাইলে লিখেই যেতে হবে। কারণ প্রতিটি কবিতার আছে অনেকগুলি টেক্সট। কেউ এই কবিতাগুলির মধ্যে খুঁজে পেতে পারেন আধুনিক সমসাময়িক ভাষায় শিকড়ে ফেরার আকুতি, কেউ এই কবিতাগুলির মধ্যে পেতে পারেন প্রেম ও যৌনতার এক সংযমী ভাষ্য, আবার কেউ পেতে পারেন এক তন্ত্রসাধিকার একাকী যাপন। তবে আমি ভ্রমণ করেছি তার মনন আর বোধের বিশ্ব থেকে একাকী সংগীতে। কিছু খুঁতের কথা বলার থাকে। কারণ খুঁত না থাকলে তা আর শিল্প কীসের আর জীবনই বা কীসের! খুঁত আছে বলেই তা শিল্প। না হলে তো প্রাণহীন্ পারফেকশন হয়ে যেত। বিষাদবালক জাতীয় কিছু শব্দ আছে, যা ঘুরে ফিরে এসেছে এই বইয়ে। একই শব্দের বারবার ঘুরে ফিরে আসা ভাল লাগে না। কিছু কিছু জায়গায় ছন্দ আর অন্ত্যমিল নিয়ে একটু ভাবলে ভাল হত। তবে সংখ্যায় তা অনেক কম। অন্ত্যমিলে কিছু কিছু জায়গায়  আরোপ করা হয়েছে বলে মনে হয়েছে। সেগুলি সংশোধন করা যায়। তবে চমকপ্রদ বিষয়টি হচ্ছে এক মাত্রায় অন্ত্যমিলের কিছু জায়গা আছে। আর আছে কভু- এর মতো কিছু পুরনো শব্দের ব্যবহার। অনেকের হয়ত খারাপ লাগবে। আমার খুব সাহসী মনে হয়েছে এই পরীক্ষা। কারণ শব্দ কখনও ব্রাত্য হয় না। তাকে নতুন ভাবে ব্যবহার করে পুনর্জন্ম দেওয়া যায়। আরও একটি বিষয়ের জন্য ধন্যবাদ জানাই। অনবদ্য হিরোইক কাপলেট, যা সনেটের প্রাণভোমরা। বেবীর হাতে মনে হয় এই হিরোইক কাপলেট আপনা থেকে ধরা দেয়। 
আশা করি বইটি আরও সমাদৃত হবে এবং বইটি অনেকেই পড়বেন। কারণ এই বই হারিয়ে যাওয়ার নয়। দীর্ঘদিন ধরে বারবার পড়ার।

বইটির প্রচ্ছদ কবিতাগুলির মতোই অনন্য। কিন্তু প্রডাকশন হতাশ করেছে। আবহমান-এর কাছ থেকে আরও নিখুঁত কাজ আশা করি। আবার ধন্যবাদ জানাই, এরকম একটি গ্রন্থকে খুঁজে , প্রায় আবিষ্কার করে প্রকাশ করার জন্য। বেবী সাউয়ের আগে কোনও বই আছে কিনা জানি না। কিন্তু এই বইটি শুধু থাকলেই একজন কবির জীবনে যথেষ্ট। বেশি লেখার দরকার আছে কি?

পাঠকের উদ্দেশ্যে একটাই কথা বলার। বইটি পড়ুন। 

গ্রন্থঃ গান লেখে লালনদুহিতা/ বেবী সাউ/ প্রচ্ছদশিল্পী- রানা দাস/ আবহমান/ ৫০টাকা


1 comment:

  1. মুগ্ধ। আমার বাস্তবকেও আপনি যেভাবে খুঁজে পেয়েছেন আমার কবিতার মাধ্যমে, তারপরে আর কিছু বলার থাকে না। ধন্যবাদ তো দেব না। শুধু এই শেয়ার করাটুকু গান হয়ে ছড়াক। ভালোলাগা।

    ReplyDelete