Friday 16 March 2018

অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়



ইতিহাস, স্বগতোক্তি ও অনিয়ম



কবির স্বভাব বিরোধিতা। আর বিপক্ষে যখন স্বয়ং কবিতা? আমরা সেই বিরোধিতার নাম রেখেছি না-কবিতা। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের ডাডাইজম হোক, ১৯৫৪ সালে না-কবিতার জনক নিকানোর পাররা-র না-কবিতাগুচ্ছ প্রকাশ অথবা ষাটের দশকে একেবারে বাংলার ঘরের হাংরি আন্দোলন - মূল সুর হল বিরোধিতা। উদ্দেশ্য, কবিতাকে তার চিরাচরিত গঠনতন্ত্র, নিয়মকানুনের খাঁচা ও সেই খাঁচার প্রতি সমসাময়িক কবিতালেখকদের অন্ধ আনুগত্য ও শুচিবায়ুগ্রস্ততা থেকে মুক্তি দেওয়া। কবিতাকে আরও নীল, আরও মুক্ত একটা আকাশ দেওয়ার চেষ্টা। না-কবিতাও শেষমেশ কবিতাই। শুধুমাত্র বিরোধিতার চোখে দেখতে গিয়ে কবিতার মূল ধারা থেকে তাকে খণ্ডিত করে দেখাটা অন্ধতার নামান্তর।
চব্বিশ পাতার আলোচ্য কবিতাবইটি পড়তে পড়তে এই স্বল্পবুদ্ধি পাঠকের মনে হয়েছে, এই কবি না-কবিতার একজন উত্তরসূরি। 'রোজনামচা', 'একটি স্বাভাবিক না-কবিতা', 'কবি বা জেলে', 'পিতা-পুত্র সংবাদ', 'জাদুশহর', 'ইতিহাসে লেখা নেই' - লেখাগুলোর সবচেয়ে জোরের জায়গা এদের 'ডিরেক্ট অ্যাপ্রোচ'। আরোপিত রহস্য নেই, শৃঙ্গার নেই, যেন চাঁদমারির প্রত্যাশাহীন একেকটি দুর্নিবার তির। এবং এই নির্ভার লেখাগুলোর মধ্য দিয়ে বড় অনায়াসে সমান্তরাল উঠে এসেছে কবির ব্যক্তিচেতনা, জীবনদর্শন ও সমাজবোধ। বিশেষত উল্লেখ্য, সমাজের কথা বলার দায় নিতে গিয়ে দুর্ভাগ্যবশত কবিতা অনেক সময় ম্যানিফেস্টোর চেহারা নেয়, আমাদের কবি সেই নেতিবাচক প্রবণতা থেকে নিজের কলমকে মুক্ত রাখতে পেরেছেন বলেই মনে হয়।
তবে, একেবারে আজকের না-কবিতা কিন্তু যতিচিহ্নের ব্যবহার নিয়েও যথেষ্ট সাহসী ও ব্যতিক্রমী। সেখানে এই বইয়ের কবিতাগুলো যতিচিহ্নের চিরাচরিত প্রথার প্রতিই অনুগত। যদিও কবি না-কবিতাই লিখছেন বা লিখবেন বলে দাগিয়ে দেওয়াটা মূঢ়তা। তবে একটি কবিতাবইয়ের সামগ্রিক অভিমুখ ও প্রবণতার দিকে তাকিয়ে সাধারণ পাঠকের মননে কিছু প্রত্যাশা তৈরি হওয়া নিতান্ত অন্যায় নয়। সেই প্রত্যাশায় কিছুটা হলেও আঘাত দেয় 'খিদে', 'ঘেন্না দিয়ে ভাত মেখে খাই', 'হাসপাতালে কিতকিত' - এই তিনটি কবিতার লঘু ছন্দ ও অন্ত্যমিল।
আলোচকের মতে গদ্যকবিতার সবচেয়ে ইতিবাচক দিকটি হল, কবি একেবারে শেষ সীমা পর্যন্ত কবিতার শরীর থেকে সমস্ত অপ্রয়োজনীয় মেদ ঝরিয়ে ফেলতে পারেন। বইটির কিছু কবিতার ক্ষেত্রে ( যেমন 'একা হাইফেন' কবিতার শেষ স্তবকটিই আলোচকের মতে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কবিতা) কবি হয়ত এই দিকটি নিয়ে আরেকটু সচেতন হতে পারতেন। এছাড়া, 'মৃত ছেলে' কবিতায় '২১' কথাটি সংখ্যায় না লিখে শব্দে লিখলে অথবা 'কতিপয় কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সমীপেষু ' কবিতায় ব্যবহৃত  'The customer is always right.' উদ্ধৃতিটি বাংলা হরফে লিখলে হয়ত বেশি দৃষ্টিসহ হত।
কবিতা লেখার জন্য কবির কি পাঠকের কাছে কৈফিয়ত দেওয়ার দরকার হয়? আলোচকের বিনীত প্রশ্ন থাকল কবি, প্রকাশক এবং পাঠকের কাছে, উৎসর্গ পাতার 'নান্দীমুখ' অংশটি নিয়ে। কাগজের গুণমান, মুদ্রণ, বাঁধাই, হরফ ইত্যাদি আশানুরূপ। তবে প্রতি বাম পাতার শীর্ষে কবির নাম এবং প্রতি ডান পাতার শীর্ষে বইয়ের নাম, আলোচকের মতে এই ধাঁচ পাঠ্যবইয়ের, কবিতাবইয়ের নয়। প্রচ্ছদ নির্মাণে চিন্তন ও দক্ষতার ছাপ স্পষ্ট,  কিন্তু নামাঙ্কন নিয়ে বোধহয় আরও যত্নশীল হওয়া যেত।
যেমনটা শুরুতেই বলেছি, আমাদের কবি না-কবিতার উত্তরসূরি। পূর্বমানুষদের প্রভাব থেকে তাঁর কবিতা প্রথমেই পুরোপুরি মুক্ত হবে এমনটা আশা করা উচিত নয়। তবে নিজের স্বতন্ত্র কাব্যভাষা নির্মাণের পথে কবির এই প্রথম কবিতাবই সন্দেহাতীতভাবে এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। কবির মননের সুসংহত আগুন অনির্বাণ হোক। পাঠকের খিদে জিতে যাক বারবার।

বইটি থেকে আলোচকের নির্বাচিত কয়েকটি কবিতা :

' রোজ একই নদীর পাড়ে গিয়ে বসি,
সে একই নুড়িতে হাত রাখি।
জলে চোখ মেললে দেখতে পাই
আমার সমস্ত মুখ জুড়ে
শ্যাওলারা ভেসে বেড়ায়;
আমার পায়ের ধার ঘেঁষে
যে মাছটি খেলা করে যায়,
সে রোজ অপেক্ষায়
একলা, আরও একলা হতে থাকে।

বহু বছর ধরে
আমি রোজ আসলে একই কবিতা লিখি। '
                                                              (রোজনামচা)
' সাড়ে তিন মিনিটে একটা কবিতা লিখে
প্রেম আসে না।
তবে মাথার কাছে
একটা পুকুর পাওয়া যায়।
পুকুরের জলে পুরনো বটের ছায়া পড়ে।
পাড়ে বসে কবি ছিপ ফেলে,
ছিপের মুখে কখনো উঠে আসে
রমণী মাছ;
ঝুড়িতে মাছ নিয়ে কবি ভাবতে বসে
কাটবে না জলে ফেরত দেবে।
                                                            (কবি বা জেলে)

' তিনি বিধান দিলেন
সমস্ত যোনিমুখ সেলাই করে দাও-
ও ছিদ্র দিয়েই পাপ বেয়ে নামে
আমাদের প্রাচীনতায়,
শুধু স্বামীসঙ্গ করার আগে
সেলাই কাটা যাবে।
আর সেলাই থাকবে না
বারোয়ারি মেয়েমানুষের গায়ে
যদিও নরম মাংসে
সূচের বেদনা কিঞ্চিত বেশী লাগতে পারে,
কিন্তু শয়তানের রাস্তা বন্ধ করতে
এটুকু তো সহ্য করাই যায়।

তিনি আবার বিধান দিলেন-
পায়ুদ্বারও সেলাই কর,
শয়তানকে বিশ্বাস নেই
যে কোনো দরজা দিয়েই নেমে আসতে পারে
অসহায় মানুষের ঘাড়ে।
আর শয়তান ঘাড়ে বসলে যে
সব ফুটোই সমান লাগবে
তাতে আর দোষ কি!
তার চেয়ে সমস্ত গহ্বর ঢেকে দাও
সেলাই করে।


এত অবধি যীশু ধৈর্য ধরে শুনছিলেন
আর থাকতে না পেরে বলে উঠলেন-
"খুব যে পুরকি দিচ্ছেন,
বলি আমার ফুটোগুলো সেলাই করবে কে?"  '
                                                                          (পিতা-পুত্র সংবাদ)












কাব্যগ্রন্থ : ইতিহাসে লেখা নেই
কবি : রাজর্ষি দে
প্রকাশক : সোমাদ্রি সাহা
উদ্যোক্তা : অপদার্থের আদ্যক্ষর
প্রচ্ছদ নির্মাণ ও অক্ষরবিন্যাস : সোমাদ্রি সাহা
বিনিময় : ৩০ টাকা




No comments:

Post a Comment