কোলাহল
তো বারণ হল, এবার কথা কানে কানে…
"আমাদের কী হবার থাকে
বিভিন্ন কবিতা থেকে শব্দ উড়ে উড়ে এসে
জুড়ে বসে বিধি দুর্বিপাকে!
...............
সমর্থন খোঁজাখুঁজি, আমাদের অপূর্ণ পাঠের পাশে
স্থির হয়ে এসে বসে কবিতার মায়া;
শক্তি হেঁটে যান ঋজু, আধুনিক ভাষাযুদ্ধে
ডালপালা মেলে দেন জীবনানন্দের ছায়া...
নেমে আসে প্রিয় বই, এই করে' বলুন তো
শূন্য নাকি আমরাই
প্রথম দশক?"
(লেখা)
কবিতার মধ্যে দিয়ে একজন কবির কিই বা হওয়ার থাকে? লেখা
একজনকে কী দেয়? পনটিয়াক গাড়ি,সহস্র ক্রীতদাসী, না ত্রিপাদ ভূমি? এক কথায় বলতে গেলে
'কিছুই না'... তবু, এই দৈবদুর্বিপাকে জুড়ে বসা শব্দগুচ্ছই কবিকে পথ দেখায়, টেনে নিয়ে
যায় অস্তিত্বের এক তীব্র দোলাচলতায়, অন্তর্দাহ আর আত্মসংকটে। এই কবিতাটির প্রতিটি শব্দে
ছড়িয়ে রয়েছে সেই অস্তিত্বসংকট, যা প্রবলভাবে যুগপ্রতিভূ। সমসাময়িক। কবিতাটি সংকলিত
হয়েছে কবি কস্তুরী সেনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'ধীরে, বলো অকস্মাৎ' এ। এই মুহূর্তে বাংলা
কবিতাকে শাসন করছে যে একঝাঁক তরুণ কলম, কস্তুরী তার অন্যতম। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই
বাঙালি কবি ও পাঠককুলে কস্তুরী নিজের জায়গাটি পাকা করে নিয়েছেন।ব্যক্তিগত সংকটকে এভাবে
গোষ্ঠীর সংকট বা যুগযন্ত্রণার প্রতিভূ করে তুলতে যিনি পারেন, তিনি নিঃসন্দেহে শক্তিশালী
কলম। ফলত, সবদিক দিয়েই কস্তুরীর প্রথম কাব্যগ্রন্থটি পৃথক আলোচনার দাবি রাখে।
কস্তুরী আনখশির শহুরে কবি। একবিংশ শতাব্দীর শহর জীবনের
স্বেদ ও ক্লেদ, স্বপ্ন ও সংকট, বিরাগ ও বিচ্ছিন্নতা ঘিরে আছে তাকে। তার কবিতায় ফিরে
ফিরে এসেছে নাগরিক ক্লান্তি, রাজপথের ধুলোমাখা সংলাপ। কিন্তু তা কখনোই খসখসে, নির্মোকহীন
শহুরে ভাষাশরীর পায়নি। বরং কস্তুরীর গভীর সঙ্গীতপ্রীতি, রাবীন্দ্রিক অনুসঙ্গ, প্রাচীন
নাটগীতিধারার প্রতি ফল্গু-আগ্রহ তার কবিতাভাষায় এনেছে এক অনন্য গীতিময়তা, অশ্রুতপূর্ব
ঝংকার... এই গীতিস্বভাব কস্তুরীর অধিকাংশ কবিতারই
প্রাণ
১.
"নমস্য বর্ণনাসূত্রে অনিবার্য
জ্বলে নিভে ওঠা
নমস্য হে জাগরণ আ শরীর ও শরীর কুলে!"
(তথাপি)
২.
"ফিরে
এসো, বন মথিত কী ফুলবাসে
রবীন্দ্রমাসে সব বোধিগাছে ছাড়
হে বজ্র মম তন্ত্র পেরোক সীমাও,
তুঁহুঁ শ্রীচরণ চারণ আদিখ্যেতার "
(পর্যায়ভাগে
ভুল)
৩.
“আমরা যে সন্ধ্যাভাষা শিখি
আর শিখে ভুলে যাই
আমরা যে সহস্রারে মুকুলিত
হাতে হাত রাখি "
(সব
ভাঙা পথ)
৪.
“ আজ আমাদের, এবং সবার
দগ্ধ গূঢ় দোষের কাছে
একটি শুভশাঁখ বেজেছে
কান পাতালেই রশিতে টান,
সুমাঙ্গলিক, শাঁখ বেজেছে! “
(আরম্ভ)
এমন বিবিধ বর্ণময় উদাহরণ তুলে দেওয়া যায় বইটি থেকে। এই ছন্দ, বাকবিন্যাস পাঠক মনে দোলা দেবে অবধারিত।
কিন্তু এই অব্দি পাঠ করে যদি মনে হয় কস্তুরীর কবিতা কেবলই গীতিময়, ধ্বনিসর্বস্ব, লিরিক্যাল
পোয়েট্রির মন্ময়তাই তার উপাস্য তাহলে মস্ত ভুল হয়ে যাবে। এই কবিতার বুকেও রয়েছে বাস্তব
মরপৃথিবীর শ্বাসপ্রশ্বাস... রয়েছে শব্দের আপাতগভীরে লুকোনো উপকথা আর মিথের পুরোনো পৃথিবীটিও।
তাই কস্তুরী লিখতে পারেন...
" দেখেছে কলস পূর্ণ
দেখে গেছে মেঘ ডাকল,
শিলা ফেলে ফেলে
পিপাসা এসেছে উঠে,
কাহিনীতে জলচিহ্ন নেই। "
(সপ্তক:
কার মিলন চাও বিরহী)
মিথকে আশ্রয় করে জীবনের অপার তৃষ্ণা আর লুকোনো অশ্রুজলের
চিহ্নের কথা কত সাবলীলবভাবে বলে দিলেন কবি।প্রকাশের এই সাবলীলতা একের দশকের কবিতার
অন্যতম লক্ষণ।কস্তুরী তাকেই সফলভাবে মিশিয়ে দিয়েছেন সঙ্গীতময়তার মধ্যে, শব্দঝংকার ও ছন্দের সুষম মিশ্রণে।
"ঈর্ষা এমন অগ্নি, যেন নি:স্ব
মুখচ্ছবির মতো
চিত্তহারী, রাস্তা দিল, স্বাধীন, তবু
ওতপ্রোত "
(গান
ফুরাবার আগে)
আমরা জানি
যে, চিত্রকলা ও সাহিত্য আন্দোলনে রিয়ালিজম, ইম্প্রেশনিজমের পরবর্তী স্তরে দেখা দিয়েছিলো
প্রতীকবাদ বা সিম্বলিজম। জড়বাদী বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে প্রথমে ফ্রান্সে
ও পরে ইউরোপের একাধিক শহরে এই আন্দোলন দানা বাঁধে। বাংলাকবিতাও এই আন্দোলনের প্রভাবমুক্ত থাকতে পারেনি। একটু দেরিতে হলেও জীবনানন্দের হাত
ধরে বাংলা কবিতার রোম্যান্টিক ধারাতেও প্রতীকবাদের কামড় বসে। কস্তুরী হয়তো সরাসরি
symbolic কবিতা লেখেননা, কিন্তু অজ্ঞাতে বা জ্ঞাতসারে তার লেখাতেও ছড়িয়ে রয়েছে পূর্ববর্তী
সাহিত্য আন্দোলনের চিহ্নসকল। তাই তিনি লিখছেন
"আর এই ডিসেম্বরে, হাত তুলে দিতে
দিতে দেখি
রোদ ও কমলালেবু সমেত
প্রায় যথাযথ শীতছাদে,
অসম্ভব অবিশ্বাস আমাকেই এসে বলে;
'চাদর সরাবে?... দয়া?..."
(দয়া)
অথবা
"সন্দেহের বর্ণময় 'পদতল মুছাতে
মুছাতে হাত' কাঁপে বড়ো,
কাঁপবেই, জানি,
সে কাঁপা হাতের টানে ঈশ্বর হেঁটে যান
নিকটেই
চিনতে পারিনি...
অত কাছাকাছি দেখে চিনতে পারিনি"
(নিকটেই)
আবার টুকরো
টুকরো কোলাজ জুড়ে কোথাও একটা গোটা ছবি উঠে আসছে, যখন তিনি লিখছেন
"এই পথে বৃষ্টি ছাড়া আর কিছু
নেই
এই পথে বাড়ি ফিরছে একা ছাতা, আধাআধি
লোক
অগাস্ট ছাতার নীচে এপ্রিলের সন্ধেবেলা,
কেউ না দেখুক
শোন সখি বলি তোরে, আজ বলি তোরে
এপ্রিলের সন্ধ্যাটির বাকি অর্থ এইমাত্র
এসে নামল
রবীন্দ্র সরোবরে-"
(কেবলমাত্র
গানে গানে : ৩)
অথবা যখন লিখছেন
"বরং এভাবে কিছু অন্ধকার লিখে
রাখি
প্রথমে যা লাল মেঝে, দ্বিতীয়তে
আমাদেরই সচমক বেগম আখতার-
বরং অধিকন্তু পর্দা কিছু উড়ে যাক,
তাকাব না
শুধু এসে দাঁড়ালেই খুব বলা হবে ইহজীবনের
মতো,
আমাদের গতমভিসার!"
(রতিসুখসার)
এইভাবেই স্পন্দমান খন্ড খন্ড শব্দে, দৃশ্যে নিপুণভাবে
তিনি পাঠকমনে এঁকে দিচ্ছেন একের পর এক ছবি। জলরঙের সেই মহিমায় প্রেমের রক্তিমে মিশে
যাচ্ছে গোলাপাভ অভিমান, নীলচে বিষাদ আর ধূসর অন্তরালের গল্প। কস্তুরীর একাধিক কবিতায়
উঠে এসেছে উক্তি প্রত্যুক্তির আদল। মনে হয়, খুব ব্যক্তিগত আবেগ এই কবিতাগুলির নির্মাণের
মূল চালিকাশক্তি। কিন্ত সেই ব্যক্তিগত মুহূর্তগুলি যেন ঢাকা রয়েছে এক আবছা পর্দার ওপাশে।
কবি সচেতনভাবেই লুকোচুরি খেলেছেন পাঠকের সাথে। তার কবিতা তাই স্পষ্ট নয়, তাতে লেগে
অধরামাধুরীর পারিজাত গন্ধ।
কবি তাই কখনো নিজেকে হাট করে মেলে ধরেননি পাঠকের সামনে।
তিনি শুধু ইঙ্গিতে ভাসিয়ে দিয়েছেন কিছু কলি, যার রেশটুকু তুলে ধরে পাঠকই একদিন গেয়ে
উঠবে সম্পূর্ণ গান।
গ্রন্থনাম:
ধীরে, বলো অকস্মাৎ/ কবি
: কস্তুরী সেন/ প্রকাশক:
ধানসিড়ি/ মূল্য
: নব্বই টাকা
No comments:
Post a Comment