Saturday 17 March 2018

অর্ণব পণ্ডা

গভীর অনাড়ম্বর কবিতা:দেবাশিস্ তরফদারের কবিতা




কীভাবে যে অনুবর্তন পত্রিকায় দেবাশিস্ তরফদারের লেখা চোখে পড়ে গিয়েছিল আমার!তারপর থেকে কবির লেখা খুঁজে বেড়িয়েছি।কিন্তু কলকাতা থেকে প্রায় একশ মাইল দূরে থাকার ফলে সেসবের কোনও সন্ধান আমার কাছ পর্যন্ত পৌঁছয় না।বিজ্ঞাপনে কোনও একদিন দেখলাম তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা বেরিয়েছে অভিযান পাবলিশার্স থেকে।এক দুপুরে কিনে আনি,আর সন্ধে থাকতে থাকতেই বাড়ি ফিরে ঢুকে পড়ি মলাটের ভেতর।আমি আমাদের মফস্বল বাজারকে দেখতে পেলাম এক মুহূর্তেই।কত শান্ত নিবিড় এক আয়োজন তাঁর কবিতায়।অথচ কোলাহল নেই কোনও।আধুনিক ,উত্তর আধুনিক সপ্রতিভতা থেকে কিছু দূরে নিশ্চিন্ত তাঁর কবিতা।অন্যমনস্ক কিন্তু দৃঢ়বদ্ধ তার মাটি ।যেন বৃক্ষ,যেন গাছ।আমাদেরই অন্তর্গত হয়ে থাকা জীবন।যে জীবনের ভেতরে রয়েছি,প্রত্যক্ষ করছি,অথচ একটু বাইরে থেকেবিচ্ছিন্ন হয়ে দেখতে পারছি না।ফলে যাতায়াতের পথে থমকে,একটু থেমে দশকর্মাভান্ডারের ঘ্রাণ নিতে সময় পাচ্ছি না আমি।হয়তো পারছিও না।কিন্তু পড়তে গিয়ে দেখতে পাচ্ছি শাঁখা-শঙ্খ-কড়ি-ঝিনুক-সিঁদুরকৌটোসহ জীবনের ছোটখাটো অথচ অব্যর্থ উপকরণে ভরে উঠছে তাঁর কবিতা।দেখি,আধো অন্ধকারে চা-দোকানে বসে বৃদ্ধ চা খাচ্ছে,দিদি মালা কিনে আনছে।তুলসিকাঠের মালা খবরকাগজে মুড়ে নিয়ে এল বাড়ি।এইভাবে আপেলের বিকল্পথেকে নদীপর্যন্ত বিস্তৃত কাব্যগ্রন্থের কবিতা পড়তে পড়তে টের পাই,পরিপূর্ণ মফস্বলের রৌদ্রঝাপটা এসে লাগছে চোখেমুখে।এবাড়ির গাছ থেকে ওবাড়ির গাছে রৌদ্রসেতুবন্ধ হল।আমি দেখলাম,পায়রা হাঁটছে।তার বুকের পালক ভীরু,শাদা।একদিক থেকে দেখলে দেবাশিস্ তরফদারের লেখা একধরণের মফস্বলবৃত্তান্ত।
"মাটির ভাঁড়ের গুণ গাই,ওরা নিন্দা করে,মৃন্ময়ের অপযশ করে"পঙক্তিটির দিকে যখন চোখ পড়ল,বিদ্যুৎ খেলে গেল মাথায়।পুরো কবিতাটির থেকেই চোখ সরে গেল আমার।বই বন্ধ করে দিলাম।আমার মাথার মধ্যে অবিরাম বাহিত হয়ে চল এই লাইন।মনে মনে বলি।বিড়বিড় করি।কাজে বেরোই।কিন্তু মাথার মধ্যে চলতে থাকে লাইন,মাটির ভাঁড়ের গুণ গাই..বাসে বসে থাকি।দাঁড়াই ভীড়ের মধ্যে।কিন্তু মাথা থেকে ছেড়ে যায় না সে।বাড়ি ফিরি।আবার বসি এই কবিতার কাছে।ধীরে ধীরে পুরোটাই পড়তে পারি এবার।মাটির ভাঁড়ের গুণ গাই।কবিতার পাঠকমাত্রেই জানেন এই মাটি শব্দের গভীরতা।আর আমাদের জীবনে ভাঁড় অর্থাৎ ভান্ডের গুরুত্ব অপরিসীম।ভান্ড কিছু ধরে রাখে।হতে পারে শস্যরাশি,হতে পারে তৃষ্ণার পানীয়।একটা সঞ্চয়ের আধার।মাটির পাত্র সর্বশ্রেষ্ঠ।সবচেয়ে শুদ্ধ।পবিত্র।বিন্দুসার একবার তাঁর পুত্রদের পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন।তিনি জানতে চাইছিলেন তাঁর পরে রাজা হিসেবে কে বেশি উপযুক্ত?দাসীপুত্র কদাকার বালক অশোককে তিনি দুচোখে দেখতে পারতেন না।তাই সেই স্বর্ণমন্ডপে বাকি পুত্ররা যেখানে রত্নখচিত আসনে উপবিষ্ট ছিল,অশোক কিছুটা তফাতে,রাজার চোখের আড়ালে,মাটির ওপর ধুলায় বসেছিল।তার অন্য ভাইয়েরা যখন রত্নপাত্রে ফল মিষ্টি আহার করছিল,দাসীপুত্র অশোক মৃৎপাত্রে দধি-চিড়াসহ গরিবের আহার সারছিলেন।গুরু ভিক্ষু পিঙ্গল কিন্তু অশোকের মধ্যেই রাজচক্রবর্তীলক্ষণ দেখেছিলেন।কিন্তু রাজা অশোকের নাম শুনলে ক্রুদ্ধ হবেন,শাস্তি দেবেন,এই আশঙ্কায় তিনি ব্যক্তি নির্বিশেষে ঘোষণা করলেন,যিনি শ্রেষ্ঠ আসনে বসে আছেন,যিনি শ্রেষ্ঠ পাত্রে শ্রেষ্ঠ আহার গ্রহণ করেছেন,তিনিই ভবিষ্যতের রাজা হবার উপযুক্ত।বলা বাহুল্য,রাজা বিন্দুসার এবং তাঁর অন্য পুত্রেরা এই ঘোষনার অর্থ ধরতে না পারলেও বালক অশোক কিন্তু নিজের ভবিষ্যৎ দেখতে পারছিলেন।তিনি জানতেন পৃথিবীর ওপর,বসুন্ধরার ওপরই একজন রাজার প্রকৃত আসন।আর মৃৎপাত্রের চেয়ে শ্রেষ্ঠ পাত্র হয় না।এই পাত্র পবিত্র।শুদ্ধ।দেবতাদেরও প্রিয়।যেমন দেবতাদের প্রিয় আহার ধান্য আর দুগ্ধ।
দেবাশিস্ তরফদারের এই কবিতাটিও সেই মৃৎপাত্রের গুণ বর্ণনা করেছে।থরে থরে সাজানো বিভিন্ন ধরনের পাত্র কুমোরপাড়ায় তৈরি হচ্ছে,আগুনে সেঁকে পোক্ত হচ্ছে।এই ভান্ডগুলিই যেন ভান্ডার হয়ে ওঠে আমাদের।মানুষের তাই প্রার্থনা।প্রতীক্ষাও।কবিতার শেষ পঙক্তিতে"বসুন্ধরা সরা হয়ে ধরা দেয় বারবার"(কুমোরপাড়া) পুরো পৃথিবীটাই শস্যের ভান্ডার হয়ে উঠে আসে!
এই হল অন্তর্ভেদী চোখ দিয়ে দেখা মানুষের জীবন।আছে তাঁর নিজস্ব দর্শন।মানুষের বেঁচে থাকা,তা যত সাধারণই হোক না কেন,তার মধ্যেও প্রাণ আছে।কচুওয়ালী তাই তাঁর খুব আপনজন হয়ে ওঠেন।রাত নটায় কড়াই নামে।রসগোল্লার কড়াই।নামানোর আগে ময়রা একটা গোল্লা চিমটে করে ছুঁড়ে দিল আগুনে।দেবতার সন্তোষ।আরও অনেকে এসে বসেছে খোড়ো আবছা দোকানে।আলো পড়েছে গামলায়।মানুষের মুখে।কবির মনে হচ্ছে প্রাণ,রসগোল্লার কড়াইতে টলমল করছে।
 তাঁর কবিতায় ছোট ছোট হাসি-কান্নার মধ্যে মধ্যে রোদ ওঠে।বৃষ্টিপাত হয়।কিন্তু জীবনের যেন কোনও ক্ষয় নেই।একটা কোনও অদৃশ্য শক্তি জগতের অন্তরাল থেকেচালিত করছে জীবন।যেন তারই টানে নদী বয়ে যাচ্ছে।পাতা আসছে গাছে।পাতা ঝরছে।পাখি ডানা ঝাপটে উড়ছে।বসছে কিছুক্ষণ ডালে,আবার উড়ে যাচ্ছে।আর এরকম স্রোত থেকে মানুষও বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না।জীবনের প্রবাহ চলতে থাকে সমগ্রতা নিয়ে।
এরকমই প্রবাহ থেকে একটি মিষ্টির দোকান তুলে আনেন কবি।না,রসে ডুবে থাকা রসগোল্লার কড়াই সেখানে নেই।কী আছে?একটা অপ্রত্যাশিত দৃশ্য দিয়ে শুরু হয় কবিতাটি।অনেকদিন পর দেশে ফিরে কবি দেখলেন দোকানের মোটা লোকটি,যিনি তাঁর পূর্বপরিচিত হয়তো,ফটোতে বাঁধানো।এবং এই ঘটনা খুব বেশিদিনের পুরানোও নয়।সবেমাত্র ঘটেছে মনে হয়।কেন না,কাউন্টারে তার শিশুছেলেটির মুখমন্ডলে এখনো যেন শোকের ছায়া লেগে আছে।ফটোর দিকে তাকিয়ে ধক্ করে ওঠে বুক।ছিল,নেই!কিন্তু আছে।কী আছেআছে জীবনপ্রবাহ।বেঁচে থাকার কিন্তু কোনও ছেদ নেই।এ কবিতা এক আশ্চর্য জীবনের কথা বলে।যে জীবন মৃত্যুকে স্বীকার করেও বাঁচতে চায়।তাই শোক করবার অবসর নেই।দোকানে এসে বসেছে বালক।জীবিকা,অন্নের সংস্থান।হয়তো এই অন্নের সংস্থানের জন্যই বাইরে গিয়েছিলেন কবি।অনেকদিন পর দেশে ফিরছেন।তাই একবিতার নাম দেশে ফেরা।এই একই নামে আরও একটি কবিতা আছে।ঠিক আগেই।লক্ষ্যনীয়,এদের কোনও সংখ্যাচিহ্ন দিয়ে পৃথক করা নেই।আলাদা দুটি কবিতা।একই নামে।সেখানেও দেখতে পাই "কতদিন পর আজ পুরোন বাজারে/বেড়াতে এসেছি।"এবং বেড়াতে বেড়াতেই এই মিষ্টির দোকানে এসে পড়েছেন তিনি।কবিতাটি একটু এগোলে আমরা দেখতে পাব বালকটি শুধু নয়,তার দিদিও আছে দোকানে।তাকে সাহায্য করতে।ভীষণ রোগা।ভাঙা গালে চোয়ালের হাড় স্পষ্ট।ভাই বোনের চেহারায় স্পষ্ট কষ্টের দাগ।কর্মচারী রাখবার ক্ষমতা নেই তাদের।দেখে একঝলক দাঁড়িয়ে যান কবি।মনে প্রশ্ন জাগে বিক্রিবাট্টা কেমন হয়?সেই সঙ্গে উদ্বেগও ঘনিয়ে আসে মনে,পারবে কি দাঁড়াতে এরা?পাশেরই মিষ্টিদোকানে যেন একটু বেশি ভীড় দেখতে পান কবি।তার মানে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই প্রতিযোগিতায় পড়তে হচ্ছে তাদের।হেরে যাবে?ভাবতে ভাবতে যেন চুম্বকের টানে ঢুকে পড়েন বালকটির দোকানে।মিছিমিছি মিষ্টি কেনেন তিনি।প্রয়োজনহীন এই কেনা কবিতাটিতে এক অপূর্ব আলো ফেলল মুহূর্তেই।হেরে যেতে বসা মানুষদের পাশে গিয়ে দাঁড়াল কবিতা।কবিতাটি শেষ হয় দিদির ধূপ জ্বালা এবং ভাইয়ের টাকা গোনার মধ্য দিয়ে।ভাই টাকা গোনে।এটা আসলে একটা শুরুর কথা বলছে।নতুন জীবন শুরু হচ্ছে পিতৃহারা বালকটির।
দেবাশিস্ তরফদারের শ্রেষ্ঠ কবিতা বইটির প্রথমবার মলাট খুলে যে কবিতাটি চোখে পড়েছিল সেটি ছিল,জুলাই ১৯৮০। প্রথম লাইন দুটি এমন ছিল:
"একদিন ছুটি নিয়ো।চলে এস ঠান্ডা চুপ মফস্বলে।
বারান্দাটি লন্ঠনের মত অনাড়ম্বরে জেগে আছে।"
কবিতাগুলি এইসব গভীর অনাড়ম্বরের দিকে আন্তরিক আহ্বান জাগিয়ে দেয়।


গ্রন্থঃ শ্রেষ্ঠ কবিতা/ দেবাশিস তরফদার/ অভিযান

2 comments:

  1. যাক, এতদিন পরে হলেও, এইটুকুও লিখল কেউ, এই মহাগ্রন্থটি নিয়ে... অনেক লেখা হবে আরও, ক্রমে-ক্রমে... এই সবে শুরু... ধন্যবাদ নয়, অভিনন্দন এই লেখককে... তিনি জানেনও না হয়ত, যে তিনি, অতি সংক্ষেপে হলেও, একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করলেন এতদ্দ্বারা... পাপস্খালন হল, সাম্প্রতিক বাঙলা কবিতার... ...

    ReplyDelete
  2. খুব ভালো লেখা। "মাটির ভাঁড়ের গুণ গাই,ওরা নিন্দা করে,মৃন্ময়ের অপযশ করে" নিয়ে কি অসামান্য ব্যাখ্যা... দারুণ লেখা।

    ReplyDelete